বন্ধুরা,ফুটবল, ফিফা বিশ্বকাপঃ কাতার ২০২২
★আন্তঃর্জাতিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মহারণ ফিফা বিশ্বকাপ।মোট ২১৩ টি দেশের মধ্যে থেকে বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসা ৩২ টি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ।প্রতিটি আসরেই দারুণ সব জাদুকরি মূহুর্তের জন্ম দেয় বলে ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপকে বলা হয় দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ!
বিশ্বকাপ চলে যায়,তবে থেকে যায় বিশ্বকাপের স্মৃতি। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে স্বাগতিক রাশিয়ার দারুণ পারফফর্মেন্স,মাঠে-মাঠের বাইরের নানা সমস্যাকে সামলে লুকা মদ্রিচের নেতৃত্বে ক্রোয়েশিয়ার ফাইনাল জয়,২০ বছর পর ফ্রান্সের শিরোপা উঁচিয়ে ধরা,
এবং পেলের পর সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে কিলিয়ান এমবাপ্পের গোল কিংবা মাঠে নেইমার-রোনালদোর বোবা কান্না কিংবা ফ্রান্সের সাথে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পরার পর মেসির কান্না লুকানোর চেষ্টা।সুখ - দুঃখের হাজারো স্মৃতি এখনো মনে রেখেছে ফুটবল প্রেমিরা।৪ বছর ঘুরে আবারো চলে এসেছে দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ!
★ দল,গ্রুপ,ম্যাচের দিনক্ষণ সবই হয়ে গেছে চূড়ান্ত।মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে ২০২২ সালের ২০ই নভেম্বর শুরু হবে বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মহারণ।৩২ দলের ৬২ ম্যাচের লড়াই শেষে ১৮ই ডিসেম্বর কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে মুখোমুখি বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হবে সেরা দুই দল।
★২০২২ এ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ আয়োজন করছে কাতার। ২০১০ এ ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ আয়োজনের জন্য যে বিডিং হয়েছিলো সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,দক্ষিণ কোরিয়া,জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াকে পেছনে ফেলে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় কাতার। বিশ্বকাপ সফলভাবে আয়োজন করতে গত এক যুগে কঁাড়ি কঁাড়ি অর্থ খরচ করেছে কাতার।
২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতারের ব্যয় হয়েছে মোট ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার,বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ২২০০০০০ কোটি টাকা! তাছাড়া বিশ্বকাপ আয়োজন করতে কাতারের খরচ করা অর্থের পরিমাণ ২০১৪ এর আয়োজক ব্রাজিল আর ২০১৮ এর আয়োজক রাশিয়ার থেকে ১৫ গুণ বেশি!অন্যদিকে,এত খরচের বিপরীতে বিশ্বকাপ থেকে কাতারের আয় হবে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার, বিশয়টি জানিয়েছেন কাতারের বিশ্বকাপ সিইও নাসের আল-খাতের।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা ফুটবল বিশ্বের দেশগুলোর কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা আর পরিচিত আরো বাড়ানোর জন্যই বিশ্বকাপ আয়োজন করছে কাতার।বিশ্বকাপ উপলক্ষে শুধু নতুন নতুন স্টেডিয়াম নয়; স্টেডিয়াম,শপিং মল,হোটেল,মসজিদ নির্মাণ করেছে কাতার।বিশ্বকাপ উপলক্ষে নতুন একটা শহর ও নির্মাণ করেছে কাতার!
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ কাতার এবং এর জনগণ বরাবর ই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল।বিশ্বকাপ আয়োজনেও তাই বিশ্বকাপের বল,মাস্কট এবং বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামগুলোতে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে কাতারের ইতিহাস,ঐতিহ্য আর সংংস্কৃতি। পাগড়ি,পাল তোলা নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে স্টেডিয়াম।চলুন দেখে নেওয়া যাক কাতার বিশ্বকাপের বল,মাস্কট আর স্টেডিয়াম গুলো....
★বিশ্বকাপের বলঃ কাতার বিশ্বকাপের অফিসিয়াল ফুটবলের নাম "আল-রিহলা।" আরবি এই শব্দের অর্থ
'যাত্রা'।বলটি তৈরি করেছে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড "অ্যাডিডাস" এবং বলটি তৈরি করা হচ্ছে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে অ্যাডিদাসের বল তৈরির ফ্যাক্টরিতে।বলটির ডিজাইনেও কাতারের সংস্কতি ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে।বলটির ত্রিকোণাকার খোপ গুলো বলটিতে বসানো হয়েছে কাতারের বিখ্যাত ধো -নৌকার(ত্রিকোণাকার পাল বিশিষ্ট এক ধরনের নৌকা)আদলে।
বলটির সাদা রং আরবদের ইতিহ্যবাহী সাদা কাপরের প্রতীক এবং রাতের বেলা নানা রঙের আলোয় কাতারের রাজধানী দোহাকে যেমন দেখা যায়,তেমন রং ব্যবহার করা হয়েছে বলটিতে।বলটি ২০ টি প্যানেল দ্বারা তৈরি এবং বলটি তৈরিতে পরিবেশবান্ধব পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান এবং পানি দিয়ে তৈরি ২০ টি কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে।
★মাস্কটঃ কাতার বিশ্বকাপের মাস্কটের নাম "লায়িব" যার অর্থ দারুণ দক্ষ খেলোয়াড়। সাদা রঙের কাতারি পোশাক পরা এক কিশোরের আদলে তৈরি করা হয়েছে লায়িবকে। তার সামনে বল ও তার পোশাকে কাতারি আঙ্গিকে নকশা।লায়িবের গল্প হিসেবে বলা হয়েছে সাহসী ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এ তরুণ আগের সবগুলো বিশ্বকাপ দেখেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ও গুরুত্বপূর্ণ গোলে ভূমিকা রেখেছেন।ড্র অনুষ্ঠানের আগে এক বিশেষ অ্যানিমেশন ফিল্মের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয় লায়িবকে।
★বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামঃ বিশ্বকাপ উপলক্ষে ৮ টি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে কাতার। বিশ্বকাপ উপলক্ষে শুধু স্টেডিয়াম বানাতেই কাতার খরচ করেছে ১০ বিলিয়ন ডলার; বাংলাদেশি টাকায় যা ১০০০০০ কোটি টাকা!কাতার বিশ্বকাপের প্রতিটি স্টেডিয়ামেই থাকবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি যা ব্যাবহার করে স্টেডিয়ামের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়ে ফেলা যাবে।এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি চালাতে ব্যবহার করা হবে সৌরশক্তি।স্টেডিয়ামের নকশাগুলো করা হয়েছে কাতারের ঐঐতিহ্যবাহী জিনিস গুলোর আদলে।
★লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামঃ বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারের তৈরি করা স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম হচ্ছে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম। ৮০,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট স্টেডিয়ামটিতে ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল সহ মোট ১০ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।স্টেডিয়ামটির নকশা করেছে ব্রিটিশ সংস্থা ফস্টার+পার্টনারস এবং নির্মাণ করেছে এইচবিকে কন্ট্রাক্টিং এবং চায়না রেলওয়ে কন্সট্রাকশন কর্পোরেশন।
স্টেডিয়ামটির ভিতরের অংশে প্রাচীন আরবদের বাটির আদলের কারুকাজ প্রতিবিম্বিত হয়েছে এবং বাইরের অবয়বটি তৈরি করা হয়েছে কাতারের ঐতিহ্যবাহী ধাও নৌকার পালের আদলে।
স্টেডিয়ামটি কাতারের রাজধানী দোহা থেকে ২৩ কি.মি উত্তরে কাতারের লুসাইলে অবস্থিত।বিশ্বকাপের পর লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের ৪০,০০০ আসন খুলে ফেলা হবে এবং অনুন্নত বা সল্পোন্নত কোনো দেশের কোনো স্টেডিয়ামকে উপহার দেওয়া হবে। স্টেডিয়ামটি বানাতে খরচ হয়েছে ৭৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
★আল-বাইত স্টেডিয়ামঃ কাতারের ২য় বৃহত্তম স্টেডিয়াম এটি। ৬০,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামটিতে কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ সহ মোট ৯ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।স্টেডিয়ামটির নকশা করেছনে 'দার আল হান্দাশাহ' কন্সাল্টিং কোম্পানি।আরব যাযাবরদের তাবুর আদলে তৈরি করা হয়েছে স্টেডিয়ামটি।স্টেডিয়ামটি বানাতে খরচ হয়েছে ৪ বিলিয়ন কাতারি রিয়াল অর্থাৎ ১.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশ্বকাপের পর স্টেডিয়ামটির ৩২,০০০ আসন সরিয়ে ফেলা হবে এবং অনুন্নত বা সল্পোন্নত কোনো দেশের কোনো স্টেডিয়ামকে উপহার দেওয়া হবে অথবা ২০৩০ এশিয়ান গেমস এর জন্য ড়েখে দেওয়া হবে।স্টেডিয়ামটি কাতারের রাজধানী দোহা থেকে ৩৫ কি.মি. দূরে কাতারের আল খোরে অবস্থিত।
★আল-জানুব স্টেডিয়াম ঃ বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারের নির্মিত অন্যতম সেরা স্টেডিয়ামটি হচ্ছে ৪০,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট আল জানুব স্টেডিয়াম।স্টেডিয়ামটি নির্মাণে মোট খরচ হয়েছে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।স্টেডিয়ামটির নকশা করেছেন স্থপতি যাহা হাদিদ।
অনেকের মতে,স্টেডিয়ামটির নকশা তৈরি করা হয়েছে আরব লোকদের পাগড়ির আদলে।কিন্তু,স্থপতিদের মতে স্টেডিয়ামটির নকশা অনুপ্রাণিত হয়েছে কাতারের ঐতিহ্যবাহী ধাও নৌকার পালের থেকে।বিশ্বকাপ শেষে আল জানুব স্টেডিয়ামটির ২০,০০০ আসন সরিয়ে ফেলা হবে এবং অনুন্নত বা সল্পোন্নত কোনো দেশের স্টেডিয়ামকে উপহার দেওয়া হবে।স্টেডিয়ামটি কাতারের আল ওয়াকরাহ নামক স্থানে অবস্থিত।
★এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম ঃ কাতার ফাউন্ডেশনের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম কাতারের আল - রাইয়ানে অবস্থিত।৪৫,৩৫০ দর্শশ ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট স্টেডিয়ামটি অনেক গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতর অবস্থিত।
স্টেডিয়ামটি বানাতে ২০% সবুজ কঁাচামাল ব্যবহৃত হয়েছে, যার ফলে স্টেডিয়ামটি বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব স্টেডিয়ামগুলোর একটি।বিশ্বকাপের পর স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেট ও দর্শশকদের জন্য ২৫,০০০ আসন রেখে বাকি আসনগুলো সরিয়ে ফেলা হবে এবং অনুন্নত বা সল্পোন্নত কোনো দেশের স্টেডিয়ামকে উপহার দেওয়া হবে।এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপের ৮ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।স্টেডিয়ামটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
★খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম ঃ ৪৫,৪১৬ আসন বিশিষ্ট খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম কাতারের রাজধানী দোহাতে অবস্থিত। স্টেডিয়ামটি দোহা স্পোর্টস কমপ্লেক্স এর অংশ। স্টেডিয়ামটির নকশা করেছন দার আল হান্দাশাহ কন্সাল্টিং কোম্পানি।বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামটির সংস্কার বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৩৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।স্টেডিয়ামটিতে বিশ্বকাপের ৮ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।
★আল থুমামা স্টেডিয়ামঃ কাতারের হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এর কাছেই আল থুমামাতে অবস্থিত আল থুমামা স্টেডিয়াম।৪০,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামটি তৈরি করা হয়েছে কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী 'তাকিয়াহ্' টুপির আদলে।এমনটিই জানিয়েছেন স্টেডিয়ামটির স্থপতি ইব্রাহিম যাইদাহ্।
বিশ্বকাপের ৮ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে আল থুমামা স্টেডিয়ামে।বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামটির সংস্কার বাবদ ব্যয় করা হয়েছে মোট ৩৪২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।বিশ্বকাপের পর স্টেডিয়ামটির অর্ধেক আসন অনুন্নত বা সল্পোন্নত কোনো দেশের স্টেডিয়ামকে উপহার দেওয়া হবে।
★আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামঃ আহমদ বিন আলি স্টেডিয়াম কাতারের আল রাইয়ানে অবস্থিত।দারুণ সুন্দর এই স্টেডিয়ামটির দর্শক ধারণক্ষমতা ৪৪,৭৪০ জন।তবে,বিশ্বকাপের পর এর আসন সংখ্যা কমিয়ে ২১০০০ করা হবে এবং বাকি আসনগুলো অনুন্নত বা সল্পোন্নত কোনো দেশের কোনো স্টেডিয়ামকে উপহার দেওয়া হবে।
ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ এর ৭ টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামে।স্টেডিয়ামটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
★স্টেডিয়াম ৯৭৪ ঃ স্টেডিয়াম ৯৭৪ ফিফা বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম অস্থায়ী স্টেডিয়াম। আশ্চর্য হলেও সত্যি স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করা ৯৭৪ টি শিপিং কন্টেইনার দিয়ে।
You must be logged in to post a comment.