রাজকুমারী তুষারকণা

রাজকুমারী তুষারকণা

এ দেশে ছিল এক রাজা আর রাণী। তিনি ছিলেন খুব সহানু রাজ। এমনকি রানী ছিলেন । দেশের প্রজারা রাজা-রানীকে খুব ভালোবাসত।

কিন্তু রাজা-রানীর মনে কোন সুখ নেই। কারণ তাদের কোন সন্তান ছিল না। অনেক অনেক দেশের নামকরা সব হেকিম, বদ্যি, কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করানোর পরও তাদের কোন সন্তান হয়নি।

একদিন রানী চমৎকার ফুলের নকশা সেলাই করছিলেন। সেলাই করতে করতে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন-আকাশজুড়ে শাদা শাদা তুলোর মত লো ফুলো মেঘ উড়ে যাচ্ছে। মেঘের দিকে দেখতে গিয়ে হঠাৎ তার হাতে মুচটা বিঁধে গেল।সাথে সাথে কয়েক ফোঁটা রক্ত আঙুলের ডগা থেকে গড়িয়ে পড়লো।

তিনি চমকে উঠে সেই রক্তের রঙের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন-আহা। আমার যদি ঐ মেঘের মত ফর্সা আর ঐরকম রক্তের আভার মত টুকটুকে লাল গালের একটি মেয়ে থাকতো তাহলে খুব ভাল হতো।

সেইসময় রাজপ্রাসাদের সামনের রাস্তা দিয়ে একজন ফকির যাচ্ছিলেন। তাঁর অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। তিনি রানীর মনের কথাগুলো শুনতে পেলেন। তারপর দুই হাত তুলে পরম করুণাময় আল্লাহপাকের দরবারে রানীর হয়ে ফরিয়াদ জানালেন।

ফকিরের দোয়া আল্লাহপাক কবুল করলেন। অল্পদিন পরেই রানীর একটি মেয়ে হলো । তার রং শরৎকালের শাদা মেঘের মতো। তার গালদুটি হলো লাল টুকটুকে আর চুলগুলি ছিলো কালো কুচকুচে। রানী তাঁর মেয়ের নাম রাখলেন তুষারকণা।

রাজা সুখী, রানী সুখী, প্রজারা সুখী। এমনকি আশেপাশের সাত রাজ্যের সকলেই সুখী। কিন্তু এতো সুখ বেশিদিন কপালে সইলো না। মেয়ে অনুগ্রহণ করার বছরখানেক পরেই রানী মারা গেলেন।

রানী মারা যাবার পর ভীষণ বিপদে পড়লেন রাজা। একদিকে রাজকার্য আর একদিকে মেয়ের দেখাশোনা। রাজার তো আর রাজকার্য্য ফেলে মেয়ের দেখাশোনা করা সাজে না। কিন্তু এই অবস্থায় ছোট্ট এই মেয়েটির দেখাশোনা করবে কে? রাজা মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন।

একসময় রাজপরিষদের পরামর্শে রাজা বিয়ে করে নতুন রানী নিয়ে এলেন রাজপ্রাসাদে। এই যে নতুন রানী ইনিও ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। কিন্তু আর কেউ যে তার চেয়ে সুন্দরী হবে, এ তিনি কোনমতেই সহ্য করতে পারতেন না।

তিনি বেশ কিছু যাদু জানতেন। সেসব যাদু তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের ওপর প্রয়োগ করতে ভালোবাসতেন।

রাজা যদিও চেয়েছিলেন, নতুন রানী প্রাসাদে এসে তুষারকণার যত্ন নেবেন। তাকে নিজের মেয়ের মতো আদর-যত্ন করবেন।

কিন্তু নতুন রানী রাজপ্রাসাদে আসার পর তুষারকণার দিকে ঘুরেও তাকালেন না। ছোট তুষারকণা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেও নতুন রানী সেই বাড়ানো হাতের দিকে খেয়াল করলেন না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন।

নতুন রানীর সাথে সবসময় একটা যাদুর আয়না থাকতো। সেই আয়নাকে নতুন রানী কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সেটা উত্তৰ দিতে পারতো। রানী সেই আয়নাটাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন-

"আয়না আয়না বলো তো দেখি - আমার চেয়ে কে আছে আর সুন্দরী?” এই কথার উত্তরে সেই আয়নাটি বলতো-"আপনার চেয়ে সুন্দরী এই পৃথিবীতে নেই কোন।"

রানী খুব খুশি হয়ে যেতেন। মনের সুখে সারা ঘর জুড়ে নাচতেন আর গান গাইতেন।

এদিকে নতুন রানীকে বিয়ে ঘরে এনেও রাজার কোন লাভ হলো না। কারণ, রাজা আবার বিয়ে করেছিলেন তুষারকণার যত্নের জন্য। কিন্তু নতুন রানী তুষারকণার কোন খোঁজখবরই রাখতেন না। তিনি শুধু নিজের রূপচর্চায় ব্যস্ত থাকতেন।

আর নিজের রূপচর্চায় ব্যবহৃত রাজ্যের সব ওষধি গাছগাছড়ার জন্য খাটিয়ে মারতেন দাস-দাসীদের। ওদিকে তুষারকণা দাসী- বাঁদীদের তত্ত্বাবধানেই বড় হতে লাগল। রাজাও ব্যস্ত হয়ে গেলেন তাঁর রাজকার্য্যে। একসময় তিনিও তেমন খোঁজখবর করতেন না তুষারকণার ।

এরপর বহুদিন কেটে গেল। রাজপ্রাসাদে দাসী-বাদিদের তত্ত্বাবধানে তুষারকণার দশ বছর বয়স হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল সুন্দরী। দিনে দিনে সে আরও অপরূপ সুন্দরী হয়ে উঠতে শুরু করলো। তার এই রূপের কথা রানী জানতেনও না বুঝতেনও না।

তিনি ছিলেন নিজের রূপের গর্বে বিভোর। অনেকদিন পর রানী একদিন তার আয়নাকে জিজ্ঞাস করলেন,“আয়না আয়না বলো তো দেখি- আমার চেয়ে কে আছে আর সুন্দরী?” এই কথার উত্তরে সেই আয়নাটি বললো-

"আপনার চেয়ে সুন্দরী আছে এই রাজ্যে একজনই, সে হলো তুষারকণা।”

একথা শুনে রানী ভীষণভাবে চমকে গেলেন। ভুল শুনছেন মনে করে আবার জিজ্ঞেস করলেন। আয়না তখন একই উত্তর দিল।

এই কথা শুনে রানীর ভয়ানক রাগ হলো। এমনিতেই তিনি তুষারকণার কোন যত্ন নিতেন না বা কোন খোঁজখবর রাখতেন না। একথা শোনার পর তিনি তুষারকণাকে দিয়ে দাসী-বাদিদের কাজ করানো শুরু করলেন।

তিনি ভাবলেন, এভাবে কাজ করলে নিশ্চয় তুষারকণার রূপ কমে যাবে। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরও তুষারকণার স্তূপ তো কমলোই না বরং যেন বেড়েই চললো।

নতুন রানী তুষারকণার দিকে সবসময় রাগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেন। কিন্তু তাকে বাড়তি কোন শান্তি দিতে পারতেন না রাজার ভয়ে। তাই যতই দিন যেতে লাগলে ততই রানীর রাগ আরও বাড়তে লাগলো ।

শেষে একদিন তিনি ঠিক করলেন তুষারকণাকে মেরে ফেলতে হবে। কিন্তু কাজটি করতে হবে সুযোগ মতো। দুই রানী তাই সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন।

তুষারকণাকে দিয়ে দুই রানী তাঁর ঘর মোছাতেন। এমনকি সিঁড়ি পর্যন্ত মোছাতেন। তাছাড়া তাঁর নিজের কাপড়চোপড় তুষারকণাকে দিয়ে কেচে পরিষ্কার করাতেন। রান্নাঘরে রানীর বিশেষ খাবারও রান্না করতে হতো তুষারকণাকে। তুষারকণা কোন প্রতিবাদ না করেই এসব কাজ করতো।

তার সঙ্গী-সাথি ছিল রাজপ্রাসাদের পোষা কবুতর আর বাগানের খরগোশ এবং কাঠবেড়ালি। ওদিকে রাজা ছিলেন তাঁর রাজকার্য্য নিয়ে ব্যস্ত। তিনি এসবের কিছুই জানলেন না।

ইতোমধ্যে একদিন পাশের রাজ্যের রাজা দাওয়াত করলেন এই রাজাকে। রাজা তুষারকণার কাছে বিদায় নিয়ে কয়েকজন সহচরসহ ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা দিলেন পাশের রাজ্যের উদ্দেশ্যে।

রাজা বিদায় নেয়ার পর নতুন রানীর মনের ভেতর খারাপ উদ্দেশ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো । রাজবাড়ীর এক চাকরকে ডেকে তাকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে তিনি বললেন, সে যেন গভীর বনের মধ্যে তুষারকণাকে নিয়ে পিয়ে হত্যা করে।

সেই চাকরটা কাপড়ের মধ্যে একখানা ধারালো ছোরা লুকিয়ে তুষারকণাকে সঙ্গে করে বনের দিকে রওনা হলো। যেতে যেতে তারা একসময় গভীর বনের মধ্যে পৌঁছে গেল। এখানে কোথাও কোন মানুষের সাড়াশব্দ নেই । এমনকি গাছে গাছে কোন পাখিও ডাকছে না।

এখানে পৌঁছে চাকরটি তার কাপড়ের মধ্যে থেকে লুকানো ছোরা বের করে তুষারকণারে হত্যা করতে চাইল।

চাকরটির হাতে ধারালো ছোরা দেখে তুষারকণা ভয় পেয়ে গেল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে তাকে অনুরোধ করলো, “তুমি আমাকে মেরো না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি আর কখনও রাজপ্রাসাদে ফিরে যাব না। আমাকে না মেরে, এখানে একা ছেড়ে দিয়ে যাও।"

এই কথা শুনে চাকরটি ভাবল, এতটুকু বাচ্চা মেয়েকে মেরে কী লাভ বরং তাকে এই বনে ছেড়ে দিয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ব ভালুকের নজরে পড়বে। তারপর তাদের খাবার হয়ে যাবে। তাই সে তুষারকণাকে বনের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলো।

সারাদিন ধরে তুষারকণা বনের ভিতর ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কখনোয় কাঁটা বনের ধার দিয়ে, কখনোবা ঝর্ণার পাশ দিয়ে সে চলতে লাগলো।চলতে চলতে দিন ফুরিয়ে গেল। বনে নেমে এলো সন্ধ্যা। ইতিমধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে ক্লান্তও হয়ে পড়েছে।

এছাড়া, মাঝে মাঝে বুনো জীব-জন্তুর গর্জন শুনে ভয়ও পাচ্ছে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে সামনের দিকে এগিয়ে চললো। একসময় খানিকদূরে একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘর দেখতে পেল।

বনের মাঝে এইরকম একটি ঘর দেখে প্রথমে সে ভয় পেল। তারপর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘরের একটি নরজা। সে আস্তে করে দরজা ঠেলা দিল। আশ্চর্য হয়ে দেখল, দরজা খোলাই আছে। একটু ভয়ে ভয়ে সে ঘরের ভেতর ঢুকলো।

ঘরের মধ্যে সব জিনিস বেশ সাজানো গোছানো। আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটি টেবিলের উপর একটি শাদা পরিষ্কার কাপড় পাতা। আর সেই টেবিলের উপর সাত থালা খাবার সাজানো। থালার পাশে একটি করে পানিভর্তি সুন্দর গ্লাস।

ঘরের একপাশে পাশাপাশি সাতটা বিছানাও পাতা ছিলো। তুষারকণা বনে বনে ঘুরে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আর তার ক্ষিদেও পেয়েছিল খুব। তাই সে প্রত্যেক খালা থেকে একটু একটু করে খাবার খেল । প্রত্যেক গ্লাস থেকে এক চুমুক করে পানি খেয়ে তার তেষ্টা দূর করলো।

তারপর সে ঘুমোবার জন্য প্রত্যেক বিছানায় উঠে দেখতে লাগলো যে কোন বিছানাটা সবার চেয়ে নরম। সব বিছানা পরখ করে সে সপ্তম বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমোবার আগে সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। কারণ, একমাত্র তিনিই সকল বিপদের রক্ষাকর্তা।

ইতিমধ্যে বাইরের জঙ্গলে রাত নেমেছে। পাখ-পাখালি একে একে তাদের ঘরে ফিরে গেছে। জঙ্গলে রাতের শিকার খুঁজতে বেরিয়েছে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার। রাত আরেকটু গভীর হতে এই বাড়ীর মালিকেরা ফিরে এলো।

তারা বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতার মানুষ। তাদেরকে বলা হয় ৰামন। এই বাড়ির মালিক সাতজন বামন। তারা সারাদিন পাহাড়ে পাহাড়ে গর্ত করে সোনার খনি খুঁজে বেড়ায়। যেদিন সোনা পায় সেদিন তারা অনেক আনন্দে থাকে। আর যেদিন সোনা পায় না- সেদিন কষ্ট বুকে নিয়ে ঘরে ফিরে।

পাহাড়ে পাহাড়ে সোনা খোঁজাই তাদের প্রধান কাজ। আজ অনেকদিন পর তারা বেশ অনেক সোনা পেয়েছে। তাই তাদের মন আনন্দে ভরপুর। গান গাইতে গাইতে তারা ঘরে ঢুকলো।

ঘরে ঢুকে তারা তাদের প্রত্যেকের সাতটি বাতি দেশলাই দিয়ে জ্বেলেই বুঝলো তাদের ঘরে নতুন কোন মানুষ এসেছে।

খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে একজন বলে উঠলো, "আমার চেয়ারে বসে এটাকে এমন করে ঘুরিয়ে দিয়েছে কে?"

দ্বিতীয় জন বললো, “কে আমার খাবার খেয়েছে?”

তৃতীয় জন বললো, “কে আমার গ্লাস থেকে পানি খেয়েছে?” এভাবে প্রত্যেকেই তাদের খাবার পরখ করে দেখে বুঝলো কেউ না কেউ এই ঘরে ঢুকেছে।

তারপর তাদের মধ্যেকার এক বামন লক্ষ্য করলো তার বিছানায় কে যেন শুয়েছিল। এই দেখে আরেকজন বললো, “আরে! আমার বিছানায় রে যেন শুয়েছিল।”

এভাবে প্রত্যেকেই বলাবলি করতে লাগলো, আমাদের সকলের বিছানায় কে যেন শুয়েছিল।

সপ্তম বামন ভালভাবে লক্ষ্য করে বললো, “দেখ দেখ, এদিকে এসো।” তখন সেই সাতজন বামন বাতি হাতে করে সপ্তম বামনের বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। দেখে তার বিছানায় একটি অসামান্য সুন্দরী মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। বামনরা ঘুমন্ত তুষারকণার বিছানার চারিদিকে ভীড় করে দাঁড়াল।

ছোট্ট এই সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখে তারা অবাক হয়ে গেলো। প্রত্যেকেই মনে মনে বললো, বাহ্ কি সুন্দর চাঁদের মতো ফুটফুটে মেয়ে। আহারে! এত্তটুকুন ছোট্ট মেয়ে। না জানি কোন মায়ের বুক খালি করে এখানে চলে এসেছে?

রাজকন্যাকে দেখে তারা অবাক হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু কেউ কোন শব্দ করলো না। মেয়েটির ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে সকলে সেখান থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল। সে রাতে সাত বামন পালা করে ছয় বিছানায় শুয়ে কোনরকমে রাত কাটিয়ে দিল।

সকালবেলা তুষারকণার যখন ঘুম ভাঙলো, তখন সেই ছোট ছোট বেঁটে মানুষগুলোকে দেখে সে ভীষণ ভয় পেল। কিন্তু বামনরা তাকে অভয় দিল । তারপর তারা খুব আদরের সঙ্গে তার নাম জিজ্ঞেস করলো। এবার তুষারকণার ভয় কেটে গেল। সে জানাল তার নাম তুষারকণা।

এরপর বামনদের কাছে সে একে একে সব কথা খুলে বললো। তার কাহিনী শুনে বামনদের চোখে পানি এসে গেল। সবাই গোল হয়ে ঘিরে তুষারকণাকে অভয় দিল। তারপর বললো, “আজ থেকে তুমি আমাদের এখানে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকবে।

তোমাকে কিছুই করতে হবে না। আমরা তোমার খাবার তৈরি করবো, তোমার চুল বেঁধে দেব, বিছানা ঠিক করে দেব। তুমি সারাদিন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘরের মধ্যে থাকবে। আর জানালা দিয়ে আমাদের আসার অপেক্ষা করবে।”

তুষারকণা তাদের কথায় খুব মজা পেল। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠে সে সম্মতি জানাল।

বেলা বেশি হতেই বামনরা সোনার খোঁজে বাইরে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যাবার আগে তুষারকণাকে সাবধান করে দিল, সে যেন কোনমতেই বাড়ির বাইরে না বের হয় । এমনকি কাউকে যেন বাড়ির ভেতরও ঢুকতে না দেয়।

কারণ, তার সমা নিশ্চয় এই বাড়ি খুঁজে বের করে তুষারকণার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। এসব বলে বাড়িটার চারপাশে বামনরা মন্ত্র পড়ে দিয়ে গেল। যাতে ভেতর থেকে না খুললে অন্য কেউ এই বাড়ির ভেতর ঢুকতে না পারে ।

বামনরা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার পর তুষারকণা কিছুক্ষণ চুপচাপ জানালার ধারে বসে রইল। তারপর উঠে ঘর গোছাতে লাগলো । এলোমেলো ঘরটি কিছুক্ষণের মধ্যেই দারুন সুন্দর গোছানো হয়ে গেল।

এরপর পাশের ঘর থেকে রান্নার জিনিসপত্র এনে গান গাইতে গাইতে রান্না করতে লাগলো। এই সাথে গুনগুন করে গানও গাইতে লাগলো সে। তার গানের সুরে জানালার বাইরে বনের যত পাখ-পাখালির ভীড় জমে গেল। এমনি করে বনের জীবজন্তনের সাথে তুষারকণার ভাব জমে উঠলো।

সন্ধ্যার পর বামনরা ঘরে ফিরে দেখে তাদের ঘরের চেহারা বদলে গিয়েছে। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখে ছোট ছোট থালাগুলোতে মজাদার সব খাবার রান্না করে রাখা হয়েছে। এসব দেখে তারা প্রথমে রেগে উঠলো।

তারা তুষারকণাকে বললো, কেন সে তার নরম কোমল হাত দিয়ে এত ক করে এসব রান্না করেছে। তাদের কথায় তুষারকণা কিন্তু রাগ করলো না। বরং দারুন উজ্জ্বল হাসি নিয়ে জানাল, এসব কাজ করতে তার আনন্দই হয়েছে। এছাড়া একা একা এই ঘরে তার করারই বা কী আছে?

বামনরা তার কথায় হেসে ফেলল। তারপর সকলে মজা করে সেই খাবার খেল। অর্ধেক রাত পর্যন্ত সাত বামন নাচ-গান করে আনন্দ দিল তুষারকণাকে। তুষারকণাও ওদের সাথে নাচলো, গাইলো। এত আনন্দ সে জীবনে কখনও পায়নি।

একসময় তার মায়ের কথা মনে পড়লো। তার চোখে পানি চলে এলো। সাথে সাথে সাত বামন তার কাছে এসে চোখের পানি মুছিয়ে দিল। তারপর বললো, আজ থেকে তুষারকণা একা নয়। তার সাথে রয়েছে তার সাত বামন ভাই। যারা জীবন দিয়ে হলেও তুষারকণাকে পৃথিবীর সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে।

ওদিকে চাকরটা যখন রানীকে গিয়ে খবর দিলে যে, সে তুষারকণাকে মেরে ফেলেছে, তখন রানী খুব খুশি হয়ে ভাবলেন যে তিনি সকলের চেয়ে সুন্দরী। কিছুদিন পরে একদিন তিনি তার আয়নাটাকে বের করে জিজ্ঞেস করলেন, আয়না, আমি কি সবচেয়ে সুন্দরী?

আয়না উত্তর দিল, আপনি এই রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি অন্য সাত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। কিন্তু অনেক দূরে এক গহীন বনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা। সে থাকে পাহাড়ের গায়ে এক ছোট্ট ঘরে।

আয়নার এই উত্তর শুনে রানী রাগে পাগলের মতো হয়ে উঠলেন । বুঝতে পারলেন এ নিশ্চয় তুষারকণা ছাড়া আরও কেউ নয় । তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যেমন করে হোক তুষারকণাকে হত্যা করবেনই ।

কিন্তু কীভাবে কী করা যায় এসব উপায় চিন্তা করতে লাগলেন। অনেক ভাবনার পর রানী ঠিক করলেন তিনি ফেরিওয়ালা সেজে তিনি তুষারকণার কাছে যাবেন।

একদিন রানী বুড়ি ফেরিওয়ালার বেশ ধরে, মাথায় পাগড়ী বেঁধে, মুখে রঙ-চঙ মেখে চেহারা একেবারে বদলে ফেললেন।

এরপর তিনি একটি ঝুড়ির ভিতর নানারকমের খেলনা ও রঙিন ফিতে নিয়ে তুষারকণার কুটিরের দরজায় গিয়ে হাঁক দিলেন-খেলনা চা-ই-ই। রঙিন ফিতা চা-ই-ই। ফেরিওয়ালার ডাকে তুষারকণা জানালা কাছে গিয়ে দেখল, ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে রঙ- বেরঙের নানারকম সুন্দর ফিতা রয়েছে। তাই দেখে তার ভারি ইচ্ছা হলো এরকম রঙিন ফিতা দিয়ে চুল বাঁধবে।

সে ভাবলো আরে আমার কি ক্ষতি করবে এই ফেরিওয়ালা। এতো আর সেই রানী নয়। ডাকিই না ওকে। এই ভেবে সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বললো, “আমাকে কিছু নীল রঙের ফিতে দাও।”

দুষ্টু ফেরিওয়ালা বললো, “দেখি মা এই ফিতে দিয়ে তোমার মাথার চুলে বেণি করলে কেমন মানাবে?”

এই কথা শুনে তুষারকণা যেই ফেরিওয়ালার কাছে এগিয়ে গেল, অমনি ফেরিওয়ালার বেশধারী দুষ্টু রানী তাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ফিতা দিয়ে তার গলা এমনি কষে বেঁধে ফেললেন যে দম বন্ধ হয়ে তুষারকণা মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

তুষারকণাকে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখে দুষ্টু স্যা মনে করলেন, এবার নিশ্চয়ই তুষারকণা মারা গিয়েছে।

আসলে কিন্তু তুষারকণার দম একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। তার একটু। একটু নিঃশ্বাস পড়ছিলো। তাকে ঐ অবস্থায় রেখে সৎমা দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন।

রাত্রে সাত বামন বাড়ী ফিরে এসে বেচারী তুষারকণাকে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তারা সবাই ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে তুলে বিছানায় শোওয়াল। তারপর তাড়াতাড়ি তার গলার ফাঁসটা খুলে দিল।

তখন তুষারকণার নিঃশ্বাস একটু একটু করে পড়তে লাগলো। এবং সে জ্ঞান ফিরে পেল । বামনরা তার কাছ থেকে সব কথা শুনে বুঝতে পারল সেই ফেরিওয়ালা নিশ্চয়ই তুষারকণার স্যা। এবার তারা তুষারকণাকে আরও সাবধানে থাকতে বললো। এবার কোনমতেই যেন কাউকে বাড়িতে ঢুকতে না দেয় ।

বাড়ী এসে সেই দুষ্টু স্যা যখন তার আয়নাটাকে বের করে জিজ্ঞেস করলেন, আয়না, আমি কি সবচেয়ে সুন্দরী? আয়না সাথে সাথে উত্তর দিল, অবশ্যই আপনি এই রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি সাত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ।

কিন্তু অনেক দূরে এক গহীন বনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা। সে থাকে পাহাড়ের গায়ে এক ছোট্ট ঘরে।

আয়নার এই উত্তর শুনে রানী আবারও রাগে পাগলের মতো হয়ে উঠলেন। বুঝতে পারলেন তুষারকণা এখনও মারা যায়নি । আবার রানী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন-এবার আমি নিশ্চয়ই তাকে শেষ করবো।

কয়েকদিন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলেন। তারপর এক উজ্জ্বল সকালে রানী সম্পূর্ণ অন্য এক বুড়ির বেশ ধারণ করলেন। তারপর একটি ঝুড়িতে নানা জিনিসের সঙ্গে একটি বিষ-মাখানো চিরুনি নিয়ে বনের ভিতরকার সেই কুটিরে পৌঁছলেন ।

এবার এই বুড়ি ফেরিওয়ালার ডাক শুনে তুষারকণা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললো, “যত যাই নিয়ে আস না কেন, আমি আর কাউকে ঘরের ভেতরে আসতে দিচ্ছি না।"

তার কথা শুনে ফেরিওয়ালা মিষ্টি করে হাসলো। তারপর তাকে সুন্দর সুন্দর সব চিরুনি দেখিয়ে বললো, “ঠিক আছে ঘরের ভেতরে আসতে দিতে হবে না।

এই জানালার ফাঁক দিয়ে এই চিরুনীটি নিয়ে নিজের মাথায় বুলিয়ে দেখ । তাহলেই তোমার চুলগুলো হয়ে উঠবে রেশমি কোমল আর ঝলমলে।”

তুষারকণা এই বুড়ি ফেরিওয়ালার মিষ্টি কথায় গলে গেল। তাছাড়া এই বুড়ির সাথে রানীর চেহারারও কোন মিল নেই। সুতরাং সে জানালা একটু ফাঁক করে চিরুনী নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। ফেরিওয়ালা তখন তার হাতে ধরিয়ে দিল সেই বিষ মেশানো চিরুনী।

তুষারকণা চিরুনীটি নিয়ে যেই তার মাথায় বুলালো আর সাথে সাথে সে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে ।

রানী ভাবলেন যে, এবারে তিনি নিশ্চয়ই সফল হয়েছেন। তখন তিনি আনন্দে নাচতে নাচতে ফিরে গেলেন।

সন্ধ্যার আগেই সেদিন বামনরা বাড়ী ফিরে এলে । ঘরে ঢুকে তারা দেখল তুষারকণার এই অবস্থা। সাথে সাথে বুঝলো এ নিশ্চয়ই সেই দুষ্টু হিংসুটে রানীর কাজ।

তারা যত্ন করে তুষারকণাকে মাটি থেকে তুলে বিছানায় শোয়ালো। তার মাথায় পানি দিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। একসময় মাথার চুলে গোঁজা চিরুনিটা তাদের নজরে পড়লো।

যেই তারা চিরুনিটা তুষারকণার মাথা থেকে বের করে নিল-অমনি তুষারকণা জ্ঞান ফিরে পেল। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে সব ঘটনা সেই বামনদের বললো।

এবার বামনরা সত্যি সত্যি খুব রেগে গেল। বুঝলো তুষারকণার ক্ষতি না করে রানী থামবে না । কিন্তু ঘরে যে কাউকে রেখে যাবে সেই উপায়ও নেই। কারণ, সোনা খুঁজতে হলে সাতজনকে সাত রকম কাজ করতে হয় ।

তারা সিদ্ধান্ত নিল, এরপর থেকে তারা কাছাকাছি পাহাড়ে সোনা খুঁজবে। যাতে তুষারকণা ডাকা মাত্র তারা শুনতে পায়। আর ছুটে বাড়ি চলে আসতে পারে। আর সেই সাথে তুষারকণাকে সাবধান করে দিল-কোনমতেই যেন সে বাইরের কাউকে ভেতরে না ঢুকতে দেয়। এমনকি জানালাও যেন না খোলে।

ওদিকে বাণী আবার তিনি তার আয়নাটাকে বের করে জিজ্ঞেস করলেন, আয়না, আমি কি সবচেয়ে সুন্দরী? আয়না উত্তর দিল, আপনি এই রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি সাত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী।

কিন্তু অনেক দূরে এক গহীন বনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা। সে থাকে পাহাড়ের গায়ে এক ছোট্ট ঘরে। আয়নার এই উত্তর শুনে রানী রাগে পাগলের মতো হয়ে উঠলেন। বুঝতে পারলেন তুষারকণাকে আবারও তিনি মারতে পারেননি ।

কোন না কোন উপায়ে সে আবার বেঁচে উঠেছে। কিন্তু তাকে তো মারতেই হবে। নইলে যে তিনি বিশ্বের সেরা সুন্দরী হতে পারবেন না।

এবার রানী হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে প্রতিজ্ঞা করলেন, তুষারকণাকে আমি মারবোই, এতে যদি আমি মরি সেও ভাল । এই প্রতিজ্ঞা করে তিনি এবারে এক কৃষকের বেশ ধরলেন। মাথায় একটি ঝুড়ি ভরে তিনি কয়েকটি কমলালেবু সঙ্গে নিলেন।

সেই কমলালেবুর মধ্যে একটি কমলালেবুতে পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক বিষ মাখিয়ে নিলেন। যাতে তার একটি মাত্র টুকরো মুখের মধ্যে দেয়া মাত্র মানুষটি মারা যায়।

কৃষকের বেশে তিনি এসে দাঁড়ালেন তুষারকণার জানালার কাছে। দরজায় ধাক্কা শুনে তুষারকণা ভিতর থেকে উত্তর দিল, “আমি আর কখনও কাউকে ভেতরে আসতে দেব না। আমার সাত বামনভাই আমাকে নিষেধ করে গেছে।"

কৃষকবেশধারী রানী খুব মিষ্টি-মধুর স্বরে বললেন, “আমি তো কিছু বিক্রি করতে আসি নি মা। আমি তোমাদের বাড়ির পাশের এক বাগানের মালী। তুমি এই বনে নতুন এসেছো। আমাকে চেন না। আমি আমার বাগানের কয়েকটা কমলালেবু তোমাকে উপহার দিতে এসেছি।”

তুষারকণা জানালার একটু কাছে এসে উকি দিয়ে বাইরে দেখল। কিন্তু একজন অপরিচিত কৃষককে দেখে উত্তর দিল, “অসম্ভব আমি তোমার কমলা নেব না।

কারণ আমার মোটেই ভরসা হয় না তোমার কথায়। তুমি নিশ্চয় কৃষকবেশধারী আমার সৎমা।”

সেই চাষাটি এই শুনে আবার বললে, “কী যে বল তুমি মা। তুমি কি ভয় করছো যে এতে বিষ মাখানো আছে? এই দেখ।

আমি একটি আপেল খাচ্ছি তাহলে তো বুঝবে এতে কোন কিছু নেই।” এই বলে, সেই কৃষকবেশী রানী ঝুড়ি থেকে একটা বিষ ছাড়া কমলার আধখানা খেয়ে ফেললেন।

লাল টুকটুকে কমলা দেখে তুষারকণার খুব ইচ্ছা হলো একটি কমলা খাবার। জানালাটা একটুখানি ফাঁক করে সে কৃষকবেশী রানীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কমলা নেয়ার জন্য। রানী তার হাতে তুলে দিলেন বিষ মাখানো কমলাটি।

তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে কমলালেবু মুখে দিতে না দিতে তুষারকণা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সেই রানী সাথে সাথে জোরে হেসে উঠলেন। এবার আর তোমার রক্ষা নেই তুষারকণা। এবার তুমি মরবেই মরবে। এবার আর তোমার সাত বামন ভাই তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।

বাড়ী পৌঁছে তিনি তার আয়নাটাকে বের করে জিজ্ঞেস করলেন “আয়না, আমি কি সবচেয়ে সুন্দরী?”

আয়না এবার উত্তর দিল, “আপনি এই রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি সাত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি হাজার রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী।”

একথা শুনে রানী এবার নিশ্চিন্ত হলেন, তুষারকণা আর জীবিত নেই তিনিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দরী।

ওদিকে বামনরা সন্ধ্যার আগেই বাড়ী ফিরে এসে দেখলো, তুষারকণ নিস্তব্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তারা খুব খুঁজে দেখলো কোথাও কোনও বিষের চিহ্ন আছে কি না । কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। তারা গলায় কিছু বাঁধা আছে কি না দেখল, তার চুল নেড়েচেড়ে দেখলো।

কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। তুষারকণার হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা। তখন তারা বুঝতে পারল, তুষারকণা আর জীবিত নেই। একসাথে সকলে কেঁদে উঠলো।

তিনদিন তিন রাত তারা তুষারকণার বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকল আর কাঁদল । প্রতি মুহূর্তেই তারা ভাবছিল এই বুঝি তুষারকণা জেগে উঠবে।

কিন্তু তুষারকণা আর জেগে উঠলো না। চার দিনের দিন বামনরা স্থির করলো তুষারকণাকে কবর দিতে হবে।

কিন্তু তারা কিছুতেই ভাবতে পারছিল না-কি করে ঐ ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটিকে তারা মাটি চাপা দিয়ে কবর দেবে। তারা তুষারকণাকে এমনই ভালোবাসতো যে, তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে সত্যি সত্যি মারা গিয়েছে।

অনেক ভেবে তারা তুষারকণার জন্য একটি সুন্দর বড় বাক্স তৈরি করলো। তার চারপাশে কাঠের বদলে ব্যবহার করলো সোনার পাত।

উপরে লাগালো স্বচ্ছ কাঁচ। যাতে সব সময় বাইরে থেকেও তাকে দেখা যায়। বাক্সের উপরে খুব সুন্দর করে সোনালি অক্ষরে লিখল “রাজকন্যা তুষারকণা।”

এই বাক্সে তারা তুষারকণাকে শোওয়াল। এরপর এক গাছগাছালি ভরা পাহাড়ের ধারে সেই বাক্সটা নিয়ে গিয়ে সাতজন পালা করে সেটিকে পাহারা দিতে লাগলো। তারা ভাবতো একদিন নিশ্চয় তুষারকণা মৃত্যু-ঘুম থেকে

বিষের চিহ্ন আছে কি না । কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। তারা গলায় কিছু বাঁধা আছে কি না দেখল, তার চুল নেড়েচেড়ে দেখলো।

কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। তুষারকণার হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা। তখন তারা বুঝতে পারল, তুষারকণা আর জীবিত নেই। একসাথে সকলে কেঁদে উঠলো।

তিনদিন তিন রাত তারা তুষারকণার বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকল আর কাঁদল । প্রতি মুহূর্তেই তারা ভাবছিল এই বুঝি তুষারকণা জেগে উঠবে।

কিন্তু তুষারকণা আর জেগে উঠলো না। চার দিনের দিন বামনরা স্থির করলো তুষারকণাকে কবর দিতে হবে। কিন্তু তারা কিছুতেই ভাবতে পারছিল না-কি করে ঐ ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটিকে তারা মাটি চাপা দিয়ে কবর দেবে। তারা তুষারকণাকে এমনই ভালোবাসতো যে, তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে সত্যি সত্যি মারা গিয়েছে।

অনেক ভেবে তারা তুষারকণার জন্য একটি সুন্দর বড় বাক্স তৈরি করলো। তার চারপাশে কাঠের বদলে ব্যবহার করলো সোনার পাত। উপরে লাগালো স্বচ্ছ কাঁচ। যাতে সব সময় বাইরে থেকেও তাকে দেখা যায়। বাক্সের উপরে খুব সুন্দর করে সোনালি অক্ষরে লিখল “রাজকন্যা তুষারকণা।”

এই বাক্সে তারা তুষারকণাকে শোওয়াল। এরপর এক গাছগাছালি ভরা পাহাড়ের ধারে সেই বাক্সটা নিয়ে গিয়ে সাতজন পালা করে সেটিকে পাহারা দিতে লাগলো। তারা ভাবতো একদিন নিশ্চয় তুষারকণা মৃত্যু-ঘুম থেকে জেগে উঠবে।

বনের পশু-পাখিরাও তুষারকণার বাক্সের কাছে এসে কাঁদতো । কাছাকাছি যতো ফুল ফুটতো তারা দিনের কোন একসময় কয়েকগুচ্ছ ফুল এনে ফেলতো বাক্সের উপর। এমনকি, আকাশের মেঘরাও উড়ে যাবার সময় কয়েক ফোঁটা করে পানি ফেলতো । যেন তুষারকণার মৃত্যুতে কেউ আর দুঃখ চেপে রাখতে পারছিল না।

এভাবে পেরিয়ে গেল বেশ কয়েকটি বছর। তুষারকণা সেই কাঁচের বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে। কিন্তু সকলের ভালোবাসায় তার শরীরে কোন বিকৃতি দেখা যায় নি।

বরং দিনে দিনে তার চেহারা আরও সুন্দর হয়েছে। দিন বদলের সাথে সাথে বালিকা থেকে বড় হয়ে উঠেছে পরমাসুন্দরী রাজকুমারী তুষারকণা। আগের থেকেও সুন্দর হয়েছে তার চেহারা। দেখে যেন মনে হয় এইমাত্র সে ঘুমিয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় জেগে উঠবে।

একদিন এক রাজপুত্র শিকার করতে করতে পাহাড়ের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। বাক্সের মধ্যে তিনি অপরূপা তুষারকণাকে দেখতে পেলেন ।

সাথে সাথে তিনি ভালোবেসে ফেললেন তুষারকণাকে। তার কাছ থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে না আর। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি তুষারকণার দিকে। দিন গেল, রাত গেল, এমনি করে সাত দিন পার হয়ে গেল ।

রাজপুত্র সেই বাক্সের কাছে দাঁড়িয়েই আছেন। অষ্টম দিনে রাজপুত্র বামনদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর সেই বামনদের বললেন-মনে হচ্ছে শুধু তোমাদের ভালোবাসাতেই রাজকন্যা এখনও পুরোপুরি মারা যায়নি।

আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তুষারকণাকে বাঁচিয়ে তুলতে চাই । তোমরা আমায় এই বাক্সসমেত তুষারকণাকে দাও। আমি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো। ভালো ভালো অনেক হেকিম-কবিরাজ দেখাবো।

বামনরা প্রথমে তুষারকণাকে দিতে চাইলো না। কিন্তু যখন তারা শুনলো তাদের প্রিয় তুষারকণা আবার বেঁচে উঠতে পারে-তখন তারা রাজী হলো ।বাজকুমার তখন বাক্স থেকে তুষারকণাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বের করে নিয়ে এলেন ।

তারপর নিজের সঙ্গী-সাথীদের হুকুম করলেন, সেই বাক্সটিকে তাঁর ঘোড়ার পিঠে বেঁধে দিতে। এরপর তুষারকণাকে আস্তে করে শুইয়ে দিলেন বাক্সের মধ্যে। তারপর খুব সাবধানে ঘোড়া চালিয়ে চললেন নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে।

ঘোড়া চলছে দুলকি চালে। খাড়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা। একপাশে পাহাড় আর অন্য পাশে গভীর খাদ। একটু এদিক ওদিক হলেই গভীর খাদে গড়িয়ে পড়তে হবে। তাহলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু। হঠাৎ সামনের একটা গর্তে হোঁচট খেল রাজকুমারের ঘোড়া। কাত হয়ে পড়ে যেতে চাইল খাদের দিকে।

আর সাথে সাথে ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল বাক্সটি। রাজকুমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে নামলেন ঘোড়া থেকে। 

বাক্স থেকে বের করে নিয়ে এলেন তুষারকণাকে । ততক্ষণে বাক্স আর ঘোড়া | দুটোই গড়িয়ে পড়ে গেল খাদের ভেতরে।

রাজকুমার | দুহাতে আগলে ধরে রাখলেন তুষারকণাকে। আর একটু হলেই রাজকন্যা তুষারকণা গড়িয়ে পড়তেন গভীর খাদে। এদিকে এই | ঝাঁকুনিতে তুষারকণার গলায় আটকে থাকা বিষাক্ত কমলার কোয়াটা বেরিয়ে এলো।

আর তখনই সে দুচোখ মেলে জেগে উঠলো । আসলে বিষাক্ত কমলার কোয়া তুষারকণার পেট পর্যন্ত যায়নি। এজন্যই তুষারকণা পুরোপুরি মারা যায়নি।

তুষারকণার জেগে ওঠা দেখে রাজপুত্রসহ সকলে অবাক হয়ে গেলেন। তুষারকণা খুব ভয়ের সঙ্গে বলে উঠলো, “আমি কোথায়?”

রাজকুমার তাকে অভয় দিয়ে বললেন, “আমি নিঝুম দেশের রাজপুত্র, আমি তোমায় আমার রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে তোমার কোন ভয় নেই।” এই বলে রাজকুমার তাকে অন্য একটি ঘোড়ায় বসিয়ে লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলেন।

তুষারকণাও এমন অপরূপ রাজকুমারকে দেখে আর তার কথা শুনে খুব আশ্বস্ত বোধ করলো। বুঝলো এবার তার কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই ।

রাজকুমার তাঁর নিজ রাজপ্রাসাদে পৌঁছে বাবা-মায়ের কাছে তুষারকণাকে কি করে পেলেন তা সব খুলে বললেন। রাজা-রানী দুজনেই তুষারকণার মত সুন্দরী মেয়ে আগে কখনও দেখেন নি ।

রাজা এবং রানী তখন রাজপুত্রের সঙ্গে তুষারকণার বিয়ে ঠিক করলেন। বিয়ের ভোজে সেই সাত বামনকেও দাওয়াত করা হলো ।

তারা এসে তাদের প্রিয় তুষারকণাকে বেঁচে উঠতে দেখে খুব আনন্দিত হলো। কিন্তু নিমন্ত্রণ খেয়ে ফিরে যাবার সময় তারা দুঃখিত মনে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল। কারণ, তাদের বাড়ীতে তো তুষারকণা ফিরে যাবে না।

কিন্তু তারা এই ভেবে আনন্দিত হলো, তুষারকণা রাজপ্রাসাদে থাকলে তার সত্মা আর কখনও তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

এদিকে সেই দুষ্টু রানীও এই বিয়েতে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। বিয়েতে আসার জন্য সাজগোজ করে তিনি তার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "আয়না, আমি কি সবচেয়ে সুন্দরী?”

আয়না সাথে সাথে উত্তর দিল, “অবশ্যই আপনি এই রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী। আপনি কয়েক রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। কিন্তু যে বিয়েতে আপনি যাচ্ছেন সেই বিয়ের পাত্রী রাজকন্যা তুষারকণা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী। তার মতো সুন্দরী এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।"

একথা শোনার সাথে হিংসুটে রানীর বুক ফেটে গেল। বুকের ভেতর থেকে তার কুৎসিত হৃদয় বেরিয়ে এসে ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সাথে সাথে সে মারা গেল। ওদিকে রাজকন্যা তুষারকণা আর রাজকুমার সুখে শান্তিতে রসংসার করতে লাগলো ।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles