বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি তে খ্রিষ্টধর্ম ও সম্রাট শার্লামেইনের অবদান

বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটির উৎপত্তি মধ্যযুগের ইউরোপে।বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে,যে প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি,সেই প্রেক্ষাপট পৃথিবীর কোথাও অন্য কোনো কালে সৃষ্টি হয় নি।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

আর সে প্রেক্ষাপটের অন্যতম অংশ জুরে আছে খ্রিষ্ট ধর্মের সাথে জ্ঞান চর্চার সম্পর্ক এবং সম্রাট শার্লামেইনের ভূমিকা।

জ্ঞানচর্চার আলো কখনও সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয় নি।জ্ঞান ও সুকুমার কলার চর্চার ক্ষেত্রে প্রথমে গ্রীক,তারপর রোমানদের অভূতপূর্ব অর্জনগুলোর কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি।

খ্রীষ্টীয় শতাব্দী শুরু হওয়া কিছু আগে থেকেই রোমানরা  আল্পস পার হয়ে কেল্টিক দেশ Gaule(এখনকার ফ্রান্স) দখল করে।

পরবর্তী তিন শতক ধরে রোমান ও গল জাতির(গল দেশের নাম,আবার জাতির নামও বটে) সংমিশ্রণে 'গালো-রোমান' নামে নতুন এক জাতি ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।

ধারণা করা হয় এই সংকর জাতির শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি ছিল লাতিন ভাষা,গ্রীক ও রোমান সাহিত্য কর্ম।রোমান সংস্কৃতি ছিল তাদের অন্যতম অনুকরণীয় জীবনদর্শন।

পঞ্চম শতকে উত্তরের বর্বর জাতি রাইন নদী পার হয়ে গল দেশে প্রবেশ করে।এর পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে গথ,ফ্রাংক ইত্যাদি জার্মান জাতি এবং হুনদের আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম ভাগ বিপর্যস্ত হয়ে গালো-রোমান সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ে যায়।

কিন্তু তাই বলে ইউরোপে বিদ্যাচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য কখনো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নি।বহিরাক্রমণের সমস্যা সত্ত্বেও এক একটি যুগ তার জ্ঞানের আলোকবর্তিকা পরবর্তী যুগের হাতে তুলে দিতে পেরেছিল।

পাশ্চাত্য রোমান সম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে শিক্ষিত বলতে ছিল গির্জার পুরোহিত ও সাধুরাই।বর্বর আক্রমণে রোমান ও গালো-রোমান আমলে রাজা ও নগর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্থাপিত বিদ্যালয়গুলো বিলুপ্ত  হয়ে গিয়েছিল।

এই বিদ্যালয়গুলোর স্থান দখল করেছিল বিভিন্ন গির্জা ও মঠের বিদ্যালয়।বর্বরদের আক্রমণ সত্ত্বেও প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির কিছু পরিমানও যদি মধ্যযুগে এসে পৌঁছাতে পেরে থাকে তবে সেটা সম্ভব হয়েছে খ্রীষ্টধর্মের সাথে তার সম্পর্কের কারণে।

কীভাবে?জীবন বাঁচাতে কোনো জাতিগোষ্ঠী বা ব্যাক্তিমানুষকে যদি পালাতে হয় তখন সে নুন্যতম সম্পদ নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে।

এমন পরিস্থিতে কার্যত অপরিহার্য বা প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়-এমন সাংস্কৃতিক অভ্যাসগুলোই কেবল টিকে থাকতে পারে।

বর্বর আক্রমণ পরবর্তী যুগে বিদ্যাচর্চা একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত,যদি না খ্রীষ্টধর্ম চর্চার প্রয়োজনে বিদ্যাচর্চা কমবেশি অপরিহার্য হতো।

শিক্ষার প্রয়োজন আগলে রাখতে প্রথমেই যাঁকে ধন্যবাদ দিতে হয়,তিনি হচ্ছেন অষ্টম শতকের সম্রাট শার্লামাইন।

তাঁর সময়ে লুটেসিয়া পারিসিওরুম (প্যারিসের পুরোনো নাম) শহরে একটি রাজকীয় প্রসাদ-বিদ্যালয় ছিল।এই বিদ্যালয়ের পরিচালক ছিলেন আলকুইন,যিনি একাধারে শিক্ষকও ছিলেন,আবার একধরণের শিক্ষামন্ত্রী ও ছিলেন।

দরবারের লোকজনের  সন্তান,এমনকি সম্রাট নিজেও আলকুইনের প্রসাদ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।এমন হওয়া সম্ভব নয় যে এই বিদ্যালয় ছিল মূলত রাজকীয় গির্জার অংশ।

কারণ,১.সে যুগে যাজকেরাই শুধু পড়ালেখা জানতেন এবং ২.খ্রিষ্টীয় ধর্ম যাজকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এই প্রসাদ বিদ্যালয়ের অন্যতম দায়িত্ব ছিল।

প্রসাদ বিদ্যালয়ে শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল বটে,এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখিছিল।

সম্রাট শার্লামেইন শুধু যে জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং তার রাজসভায় জ্ঞানীদের স্থান দিতেন,তা-ই নয়,তিনি চাইতেন,তাঁর প্রজারা সবাই যাতে কমবেশি পড়ালেখা পারে এবং বিশেষ করে শিক্ষার অংশবিশেষ যাতে যাজকদর কাছে পৌঁছাতে পারে।

তিনি এ মর্মে আদেশ জারি করেন যে প্রতিটা গির্জায় বিদ্যালয় খোলা হোক এবং সেই বিদ্যালয় সব ছাত্রে জন্য উন্মুক্ত থাকুক।

এই আদেশ যাতে পালিত হয়,শার্লামেইন তার ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা কখনও কখনও পুনরায় সেই আদেশ জারি করেছিল।

শার্লামেইনের আদেশে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম দিকে প্রায় সব বিদ্যালয়ই ছিল মূলত ধর্মীয় বিদ্যালয়।একসময় যাজক হওয়ার উদ্দেশ্যে নয়,নিছক জ্ঞান চর্চা করতে ইচ্ছুক-এমন তরুণেরও এ ধরণের বিদায়ালয়ে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল।

নবম শতকের শুরু থেকে তুলনামূলকভাবে বিখ্যাত মঠগুলোতে দুটি বিদ্যালয় ছিল,একটি যাজকদের জন্য,অন্যটি বহিরাগতদের জন্য।সে সময়ে আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই মঠে শিক্ষালাভ করতেন।

শিক্ষিত ব্যাক্তিদের সিংহভাগ ছিলেন যাজক।ছাত্রজীবনের শেষে মঠের ছাত্ররাই মঠের বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতেন।

দুখের বিষয় এই যে,নরমান বর্বরদের আক্রমণ,যাজকদের মূর্খতা ও আলস্য এবং দশম শতকের বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে শার্লামেইনের বিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ অব্যবহৃত থাকতে থাকতে ধ্বংস হয়ে যায়।

তবে বিদ্যচর্চার বাতি একেবারে নিভে যায় নি।অষ্টম শতকে সম্রাট শার্লামেইনের উদ্যোগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ত্রয়োদশ শতকে প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে প্রায় চার শতাব্দীর ব্যবধান এবং এই চার শতাব্দীতে  ফরাসী দেশের সীমানার মধ্যে বহু বিখ্যাত শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা জানা যায়।

এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্বিবদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল।যেমন ক্যাথেড্রালের সঙ্গে যুক্ত একটি বিদ্যালয় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল।

তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই যে শার্লামেইন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলো ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ