সন্ধ্যা নাগাদ পৌছতে পারতাম কিন্তু মাঝির একগুয়েমির কারণে রাত দশটা বাজলো। ধরলা নদীর দিয়ে নৌকা চলছিল। নৌকা যখন ব্রাক্ষণভিটার কালীমন্দির পেরিয়ে গেল, তখন সোজা নদী পার হলেই পশ্চিম পাড়ে আমার নানির বাড়ি। মাঝিকে নদী পার হতে বললাম।
সে বেঁকে বসলো।আমি বললাম,সমস্যা কী?সে কোনো কথা বলে না। তারপর যখন তাকে কড়া গলায় বললাম:পশ্চিম পাড়ে শান্তিনগর গ্রামে আমার নানাবাড়ি,সেটা তো আপনাকে আগেই জানিয়েছিলাম।এখন ওখানে যাচ্ছেন না কেন?
কুড়িগ্রামের খাস আঞ্চলিক ভাষায় তিনি যা বললেন,তার মর্মার্থ এই:শান্তিনগর যাওয়ার কথা তার মনে আছে কিন্তু কালীমন্দিরের অপর পাড়ের হাফ কিলোমিটারের মধ্যে সে নৌকা ভেড়াবে না। যেহেতু হাফ কিলোমিটার আগে চরাঞ্চল তাই সে গিয়ে নৌকা ভেড়াবে হাফ কিলোমিটার পরে।
এর আগে সে যে কোনোভাবেই ধরলা নদীর পশ্চিম পাশ ঘেঁষে নৌকা চালাবে না লাখ টাকা দিলেও না,মেরে ফেললেও না।আমি হতবাক হয়ে জানতে চাইলাম,কারণ কী?সে এবারও বললো,কোনো কারণ নাই।নানাবাড়িতে পৌঁছলাম রাত দশটায়।
মামাতো ভাই আরিফ রহমান তনয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো শুভ চল ঘুমাতে যাই।কাল দিনের বেলা সব বলবো।আমার রাগ লাগে।সবাই এ রকম চেপে যাচ্ছে কেন?
মামির কাছে জানতে চাইলাম।তিনি কড়া ধমক দিয়ে বললেন,যাও ঘুমাও গিয়ে।জার্নি করে এসোছো।
অতঃপর নানির ঘরে বকবকানিতে সবাই বিরক্ত যদিও কেই তা মুখ ফুটে বলে না।
তাঁর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা খোলাসা হলো।অনেক কথায় তিনি যা বললেন সংক্ষেপে তা এই: কালীমন্দিরের উল্টাপাড়ে শান্তিনগর গ্রামের যে নৌকা ঘাট,সে ঘাটে গত বছর খানেক যাবৎ ভূতের উপদ্রব চলছে।নদীর পাড় ঘেঁষেই বিরাট একটা তেঁতুল গাছ।
ওই গাছে ওনারা থাকেন।গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি আতিয়ার রহমান বুলবুলকে রাতের বেলা ডাকাতেরা ধরে নিয়েছিল।
সেই সাথে নিয়ে যায় তাঁর জমানো টাকা-পয়সা, সোনা-দানা।কিন্তু অবাক কান্ড।
আতিয়ার রহমান সাহেব ঠিকই খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসেন,আর তেরো জন ডাকাতের গলাকাটা লাশ ঝুলতে দেখা যায় তেঁতুল গাছে।
এরপরই গাছের গোড়ায় দেখা যায় অদ্ভুত এক সুড়ঙ্গ যে সুড়ঙ্গ থেকে নানা রকম শব্দ ভেসে আসে কখনও আর্ত চিৎকার কখনো অট্রহাসি কখনো নূপুরের ঝল্কার।
চাঁদতি রাতে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে তেঁতুল গাছটির শেকড়ে হেলান দিয়ে যে লোকটি বসে থাকে সে অবিকল আতিয়ার রহমান সাহেবের মতো।
গ্রামের সাহসী যুবকেরা তার দিকে দু এক পা এগিয়ে গেলে লম্বা লম্বা হাত বাড়িয়ে খনখনে গলায় তিনি বলেন যে আইস দাদুরা,একনা আলাপ করি।অমনি সবাই দেয় ঝাড়া দৌঁড়।
পেছন থেকে শোনা যায় তার চাপা কন্ঠস্বর।
এইগলা পালাইতেছে ক্যা?সবারই ধারণা,সুড়ঙ্গের ভেতরে গুপ্তধন আছে।রাতের বেলায় কখনও দিনেও বেলায় অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে সাহসী লোকেরা কয়েক বারই তা উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে।
তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ধনরত্ন মেলেনি কিন্তু যারা এইসব অভিযানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল,দুই একদিনের মধ্যে কোনা না কোনোভাবে তাদের অপমৃত্যু হয়েছে।
আমি বললাম,নানি এতো রীতিমতে আষাঢ় গল্প।নানিতাঁর হাতের লাঠি দিয়ে আমাকে পেটানোর প্রস্তুতি নিতেই আমি তাঁর ঘর থেকে ছুটে পালালাম।তনয়ঘুমাচ্ছে।
আমি তার গায়ের ওপর কম্বল একটানে সরিয়ে নিই।সে শুয়ে আছে তার বিখ্যাত লাল পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে।বলি চল তেঁতুল গাছ পরিদর্শন করে আসা যাক।
কম্বল টেনে নিয়ে বলে ও পাগলে কামড়াইছে?আসো ঘুমাও।পাশ ফিরে শোও।তনয় ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বেড় হলাম।আকাশে ফ্যাকাসে জোছনা।
আবছা আলো-ছায়া মেঠোপথে ধরে নদির পাড়ে এগিয়ে যাচ্ছি।ওই তো তেঁতুল গাছটা দেখা যাচ্ছে।কিন্তু পূর্ব পাশে নদীর ওপর ঝুলে থাকা ডালটায় কী ঝুলছে ওটা?
ঢাউস ঘুড্ডি,নাকি লুঙ্গি পরে বসে আছে কেউ? লুঙ্গি তো মনে হচ্ছে¡গা ছমছম করা বাতাস বয়ে এলো নদীর দিক থেকে।আর তখনই শুনতে পেলাম অদ্ভুত আওয়াজ।
কেমন সে আওয়াজ তা আমি বর্ণনা করতে পারবো না।
সেদিন নানাবাড়িতে ফিরেছিলাম টলতে টলতে।রাতে জ্বর উঠলো 104 ডিগ্রি।প্রলাপ বকতে শুরু করেছিলাম।
সব দোষ পড়েছিল তনয়ের ওপর। ওবায়দুল মামা তাকে নাকি একটা চড়ও নাকি মেরেছিল।আহ বেচারা¡ কলেজে ওঠার পর আবার নানাবাড়িতে গেলাম।
সেই তেঁতুল গাছটি এখন আর নেই।
নদীর ভাঙ্গনে শেকড়সুদ্ধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আজ এই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকবেন।এই ভৌতিক গল্পটা পড়ে আপনাদের কেমন লাগলে কমেন্টে জানাবেন। খোদা হাফেজ।
You must be logged in to post a comment.