আসুন থানকুনি পাতা সম্পর্কে জেনে নেই নানা অজানা তথ্যঃ
ঔষধীগুনের দিক থেকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাই থানকুনি পাতার জুড়ি মেলা ভাড়। যা আমাদের রাসায়নিক ঔষধের বিক্রয়াময় জীবন থেকে একটু হলেও পরিত্রান দেয়। কেননা প্রকৃতি উপাদান সবসময়ই অনেক বেশি কার্যকর হয় এবং এর ক্ষতিকারক দিকও কম থাকে।
বাংলা নাম থানকুনি। ইংরেজি নাম Indian Pennywort। এর বৈজ্ঞানিক নাম Centella Asiatica। এটি Apiales বর্গের একটি উদ্ভিদ। অঞ্চলভেদে এটি টোয়া, তুিতুরা, থানকুনি, মানকি, থুলকুড়ি, আদামনি, ঢোলামনি, মনামনি, ধূলাবেগুন, আদা গুনগুনি ইত্যাদি আজানা নামে পরিচিত।
এর স্বাদটা একটু তিতকুটে কিন্তু এর উপকারীতা অনেক বেশি। অসংখ্য রোগের উপশম মেলে এই পাতা দ্বারা। এটি মূলত এটি ভেষজ উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। এই পাতার উপকারীতা দেশবিদেশে ছড়িয়ে পরেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭ শতক থেকে বিভিন্ন দেশ যেমনঃ ফ্রান্স,আফ্রিকা, সুমাত্রা, জাভা, শ্রীলংকা, ফিলিপিন সহ নানা দেশ এই উদ্ভিদটি ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
একজিমা, সোরিয়াসিসের মত ত্বকের রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে থানকুনি পাতা ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। এই উদ্ভিদটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের দেখভালে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই উদ্ভিদ তুলসী ও কালোজিরার মত অব্যার্থ এক মহাঔষধী বলে নিজেকে প্রমান করেছে বারবার। এখন থানকুনি পাতা নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ
ক. থানকুনি পাতার বিশেষ কিছু পুষ্টি উপাদানঃ
১. আ্যমাইনো এসিড
২.ফ্যাটি এসিড
৩.ফাইটোক্যামিকেল
৪.Essential oil ইত্যাদি।
খ.থানকুনি পাতার বৈশিষ্ট্যঃ
এই উদ্ভিদটি বিভিন্ন জটিল সমস্যার প্রতিষেধক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে নিম্নে তা বর্ণনা করা হলঃ
১. থানকুনি পাতার essential oil আমাশয় ও বদহজমজনিত সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হয়।
২. ত্বক ফর্সাকারী হিসেবে এর ব্যবহার ব্যাপক এবং এটি ত্বককে মসৃণ করতে সাহায্য করে।
৩. এটি চুলের বিভিন্ন ক্ষতিকারক সমস্যার সমাধানে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। যেমনঃচুল ঝরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা,নতুন চুল গজাতে সাহায্য করা এবং চুলের খুশকিসহ নানা সমস্যার সমাধান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৪. এর Bacoside A & Bacoside B উপাদান মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সাহায্য করে এবং রক্ত সংবহন বাড়ায়।
৫. জ্বর,কাশি ও চোখের সমস্যায় জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
৬. এটি দাঁতের নানান সমস্যার সমাধান হিসেবে কাজ করে।
৭. এটি নিয়ম করে খেলে রক্তদূষন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
৮. পুরাতন ক্ষত নিরাময়েও থানকুনি পাতা ব্যবহৃত হয়।
৯. বাচ্চাদের লিভারের সমস্যার সমাধানে থানকুনি পাতার ব্যবহার ব্যাপক।
১০. ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। প্রচুর পরিমানে ক্যালরি আছে এমন খাবার এড়িয়ে চলা,হাঁটাহাঁটি করা এবং নিয়ম করে থানকুনি পাতা খেলে ওজন কমবে লক্ষ করার মত। কারন থানকুনি পাতা হজম ক্ষমতা বাড়ায় ফলে শরীরের যেখানে সেখানে চর্বি জমার সম্ভাবনা কম থাকে।
১১. ক্ষতের চিকিৎসার জন্যও থানকুনি পাতার ব্যবহার রয়েছে। কোথাও কেটে গেলে থানকুনি পাতা থেঁতো করে লাগালে ভাল উপকার পাওয়া যায়। কারন এতে রয়েছে Saponins নামের একটি উপাদান যা ক্ষতস্থানের রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয় ফলে তাড়াতারি ক্ষতস্থান শুকিয়ে যায়,ফলে সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
১২. শরীরের রক্তে প্রবাহের উন্নতি সাধনের জন্য এই ভেষজ উদ্ভিদটি ভীষণ কার্যকরী। কারণ,রক্ত কোষের যে দেওয়াল রয়েছে তার ক্ষমতা বাড়ে এবং শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ ক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে,দেহের প্রতিটি অংশে বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ হয় এবং আমাদের শরীর সুস্থ থাকে।
১৩. থানকুনি পাতা পা ফোলা ও পায়ের ব্যাথা উপশমেও বেশ উপকারী।
১৪. রক্তজমাট বাঁধার আশঙ্কা কমাতে থানকুনি পাতা মহাঔষধী হিসেবে কাজ করে। কারণ,এই পাতায় অবস্থিত নানা মিনারেলস ও উপকারী অন্যান উপাদানের কারনে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা কমে। যে জন্য Thrombosis এর মত রোগ দূরে থাকতে বাধ্য হয়। এবং হার্ট, কিডনি,মস্তিষ্ক এবং অন্যান অংশের মারাত্মক সব সমস্যার সমাধান হিসেবে থানকুনি পাতা ব্যবহৃত হয়।
১৫. অ্যাংজাইটি এবং মানসিক অবসাদের প্রকোপ কমায় কারন,এতে রয়েছে এমন কিছু উপাদান যা serotonin হরমনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় যে কারনে,Cortisol মানে স্ট্রেস হরমন প্রভাব কমতে থাকে। ফলে অ্যাংজাইটি ও মানসিক অবসাদ কমতে সময় কম লাগে।
১৬.থানকুনি পাতা মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ায়। কারন,নিয়মিত থানকুনি পাতা খেলে শরীরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং Pentacyclic Triterpenes নামক একটি উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে যার ফলে ব্রেনের কোষের ক্ষমতা বেড়ে যায় ফলে স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটার সাথে সাথে বুদ্ধিও বাড়ে।
১৭.বয়স্করা যদি এই পাতা নিয়মিত সেবন করেব্ন তবে অ্যালঝাইমার্স বা ডিমেনশিয়ার মতোরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
১৮.অনিদ্রার সমস্যা দূরীকরণেও এটি ব্যবহৃত হয়। কারন,এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডান্ট এবং অ্যান্টি-ইনক্লোমেটরি উপাদান যা স্ট্রেস কমানোর সাথে সাথে নার্ভ সিস্টেম কে শান্ত রাখে তাই খুব সহজেই ঘুম চলে আসে।
১৯.শরীরকে বিষমুক্ত রাখতে সাহায্য করে থানকুনি পাতা কারন,এই পাতার বিভিন্ন উপাদান রক্তের সাথে মিশে রক্তের দূষিত উপাদান গুলো প্রস্রাবের সাথে বেড় করে দেয়।
গ.থানকুনি পাতা ব্যবহারের নিয়মঃ
১.আমাশয় বা বদহজম হলে, থানকুনি পাতা রস করে খেলে ভাল উপকার পাওয়া যায়।
২.থানকুনি পাতা পেষ্ট করে ত্বকে লাগালে ত্বকের কালো দাগসহ চোখের নিচের কালো দাগ দূর হয়ে যায়।
৩. মেহেদি বা চুলের বিভিন্ন প্যাকের সাথে মিশিয়ে চুলে লাগালে ভালো উপকার পাওয়া যেতে পারে।
৪.আধা কেজি দুধ+একনপোয়া পানি+পনেরো থেকে বিশটি থানকুনি পাতা দিয়ে শরবত করে খেলে ভাল উপকার পাওয়া যায়।
৫. থানকুনি পাতা রস করে কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে ছোট বাচ্চাদের খাওয়ালে ওদের কথা স্পষ্ট হয়।
৬.আমগাছের ছাল+আনারসের কচি পাতা+কাঁচা হলুদের রস+ চার থেকে পাঁচটি থানকুনি পাতা একসাথে রস করে খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
৭. পুরাতন ক্ষতে থানকুনি পাতা বেঁটে প্রলেপ দিলে ক্ষতে দাগ কিছুটা কমে আসে।
ঘ. থানকুনি পাতার অপকারীতাঃ
অন্যান সব জিনিসের মত এই পাতার ভালো খারাপ দিক দুটোই আছে। ব্যবহারের পরিমানের তারত্যমের জন্য নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। তাই এটা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে শুনে এটি ব্যবহার করা প্রয়োজন। নিম্নে সমস্যার কারনগুলি তুলে ধরা হলঃ
১.থানকুনি পাতা ব্যবহারে চুলকানি ও অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে তাই যাদের চর্মরোগ বা অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে তাদের এটি ব্যবহার না করাই উওম।
২. বেশি পরিমানে থানকুনি পাতা খেলে পেটে যন্ত্রণা হতে পারে তাই পরিমান মত খেতে হবে।
৩. হঠাৎকরে রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
৪.যারা হেপাটাইটিস ও অন্যান লিভারের সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের এটি পরিহার করাই ভাল।
৫.আগামী দু’সপ্তাহে যদি কোন অপারেশন থাকে তবে থানকুনি পাতা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
You must be logged in to post a comment.