প্রাচীন ভারতের সামাজীক জীবন

ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন যুগপর্বে বিশেষ করে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল সুসংহত । কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরে ৭ ম শতাব্দী থেকে ।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ভারত অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে খণ্ড - বিখণ্ড হয়ে যায় ।ফলে কেন্দ্রীয় শাসনের বদলে একটি নতুন রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

প্রাচীন ভারতের সামাজিক,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় এ যুগে।

প্রাচীন ভারতের সমাজ জীবনকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোতে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়।বিভিন্ন যুগপর্বে সমাজ জীবনে নানা পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে ।

সিন্ধু সভ্যতার যে সমাজ জীবনের ছবি পাওয়া গিয়েছিল আর্য আগমনের পর নতুন ধ্যান ধারণার মিশ্রণে স্বাভাবিকভাবেই নতুন ধারার আবির্ভাব ঘটে ।

বৈদিক যুগের আর্য সমাজ যে সমাজ জীবনের কাঠামো দাঁড় করিয়েছিল বেদোত্তর যুগে তাতেও খানিকটা পরিবর্তন আসে।

সেই সঙ্গে মৌর্য,গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের বিচিত্র ধ্যান ধারণা এবং আচার অনুষ্ঠান সমাজ জীবনকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়েছিল । অঞ্চলভেদেও সমাজ জীবনে নানা বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় । 

সিন্ধু সভ্যতার সমাজ

সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনসমূহ লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাম্যবাদী সমাজ অতিক্রম করে এ সময় প্রথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা পায়।

তাই সিন্ধু সভ্যতায় বড় বড় প্রাসাদ ও বাড়ির পাশে কুঁড়েঘরের অস্তিত্ব ছিল।ধনী - বণিক শ্রেণী ও কারিগরদের পাশাপাশি ছিল দাসদের অবস্থান ।

তারা প্রত্যক্ষভাবে খাদ্য উৎপাদনে জড়িত থাকতো।সিন্ধু সভ্যতায় শ্রেণী বিভক্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল বলেই এখানে পরিকল্পিত নগর,উন্নত কারুশিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতায় অনার্যদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি ।তাই তাদের ধ্যানধারণায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রাধান্যই স্পষ্ট ছিল।এর সপক্ষে মাতৃদেবীর মূর্তিসহ নানা নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এই সভ্যতার ধ্বংসস্তূপে।

আর্য আগমনের পর সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।আর্যরা প্রধানত ছিল যাযাবর জাতি।প্রাগৈতিহাসিককালে শিকারী মানুষও ছিল যাযাবর।

মানব জীবনে পশুপালন ও পশু শিকার পর্যায়ে ছিল পুরুষ প্রাধান্য।এ কারণে যাযাবর বৈদিক আর্যদের চিন্তাধারায় পুরুষ প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।

এ যুগে নারীর উল্লেখ ছিল নগণ্য।তাই ঋগ্‌বৈদিক যুগের প্রধান দেবতারা সকলেই পুরুষ ছিলেন।নগর সভ্যতা ধ্বংস করে আর্যরা গ্রামভিত্তিক বৈদিক সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল।

এই সভ্যতায় আর্য সমাজে গণতান্ত্রিক কাঠামো ছিল উল্লেখযোগ্য। জনগণের নির্বাচনে গ্রাম পরিষদ গঠিত হতো।এ যুগের নারী উপেক্ষিত থাকায় সমাজ কাঠামোতে নারীর ভূমিকা লক্ষ করা যায় না।

বৈদিক যুগে সামাজিক অবস্থার ছবি বৈদিক সূত্রগুলোতে স্পষ্টতই পাওয়া যায়। ‘ শ্বেতযর্জুবেদ ’- এর সূত্রে বলা হয়েছে অশ্বমেধযজ্ঞে পুরোহিত আশীর্বাদ করছেন ‘

এই রাজ্যের ব্রাহ্মণরা সৎকর্মে মনোনিবেশ করুক , যোদ্ধারা যুদ্ধে যশস্বী হোক , গাভীগুলো প্রচুর পরিমাণে দুধ দিক , বলদগুলো স্বচ্ছন্দে ভার বহন করুক , স্ত্রীলোকেরা গৃহ রক্ষা করুক , যোদ্ধারা বিজয়ী হোক , যুবকেরা ভদ্র ও শিষ্টাচারী হোক ইত্যাদি ।

' সমাজ জীবনের এমনিতর অনেক ছবি খুঁজে পাওয়া যায় উপনিষদ ও বেদের বিভিন্ন সূত্রে । ছন্দোগ্য উপনিষদ , শতপথ ব্রাহ্মণ , তৈত্তিরীয় উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায় সমকালে ভারতীয়দের নানা প্রকার সম্পত্তি ছিল।যেমন- স্বর্ণ ও রৌপ্য এবং মণিমুক্তা , রথ , শকট , গাভী , অশ্ব , দাস , গৃহ , অট্টালিকা , কৃষিক্ষেত্র ইত্যাদি ।

আর্যদের সমাজ

আর্যরা প্রথমদিকে যৌথ জীবন যাপন করতো।আর্য সমাজের এই যৌথ জীবনের প্রতি আর্য ঋষিদের স্তুতি রয়েছে।ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে ‘ তোমরা একত্রে মিলিত হও,এক কণ্ঠে ঘোষণা করো ,

একত্রে মন বিনিময় করো -- যেমনিভাবে অতীতে সচেতনভাবে একত্রে বসে তাদের ভাগ গ্রহণ করতেন । ঋগ্বেদের এই ভাষ্যে আদিম সাম্যবাদী সমাজের প্রভাবই লক্ষ করা যায় ।

কিন্তু অচিরেই এই চিন্তায় ভাঙ্গন আসে । সমাজের নেতৃত্ব চলে যায় ব্রাহ্মণ - ক্ষত্রিয়দের হাতে । নিন্দিত হতে থাকে কায়িক শ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা ।

অন্যদিকে কর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান বা বিশুদ্ধ জ্ঞান যার চরম পরিণাম ঘটেছিল ভাববাদী দর্শনে বা আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় , এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সমাজে গৌরবান্বিত হতে থাকে।

এ কারণেই ঋগ্বেদের প্রাচীন অংশে যেমন আছে বস্তুবাদের পরিচয় অন্যদিকে বেদান্তে বা উপনিষদে আছে ভাববাদী পরমাত্মার কথা।এই চিন্তাভাবনা থেকেই উত্তরকালে আর্য সমাজে জাতিভেদ প্রথার বিকাশ ঘটে। এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা হবে। 

আর্য-অনার্য মিশ্র সমাজ

স্থানীয় অনার্যদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেই ভারতে আর্যদের অবস্থান তৈরি হয়েছিল।তথাপি দীর্ঘদিনের সহাবস্থানে আর্য - অনার্য মিলনের মধ্য দিয়ে নতুন সামাজিক সংমিশ্রণের সৃষ্টি হয়।

ঋগ্বেদে এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।ঋগ্বেদের বক্তব্য থেকে গবেষকরা মনে করেন প্রথম থেকেই আর্যরা বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনে অনার্য উপপত্নী ও পরে স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।যাযাবরবৃত্তির কারণে আর্যদের দলে স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীলোকের অভাব ছিল।

এ কারণে শুরু থেকেই আর্যদের ঘরে অনার্য নারী স্থান পায়।ঋগ্বেদে শংতনুই ছিলেন মহাভারতের শান্তনু।এই আর্য নৃপতি বিয়ে করেন অনার্য দাসকন্যাকে।আবার এই দাসকন্যার কুমারী অবস্থায় যৌন মিলন ঘটে আর্যপরাশর গোত্রের কোন লোকের সঙ্গে।

এই মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম নেয় তিনিই হলেন মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। প্রথমদিকে আর্যরা লিঙ্গ পূজা বিরোধী হলেও ক্রমে অনার্যদের সঙ্গে সংমিশ্রণের কারণে অনার্য শৈব সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়।

মনে করা হয় অনার্য মাতৃতান্ত্রিক মতবাদীদের সঙ্গে শৈব সম্প্রদায়ের বিরোধ থাকায় তারই সুযোগ নিয়েছিল নারী বিদ্বেষী আর্যরা।

পুরুষ শিবের ভক্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে এভাবে আর্যদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে । শৈব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলনের ফলে আর্য দেবতামণ্ডলীতে শিবের স্থান হয় এবং বৈদিক দেবতা রুদ্র আদি শিবের প্রতিরূপ হিসাবে কল্পিত হয় ।

এক সময় ঋগ্বেদে যে শিব লিঙ্গ নিন্দিত ছিল রুরূে শিবেরই বন্দনা রয়েছে যজুর্বেদে এবং পরের বৈদিক সাহিত্যে । আর্যদের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজে বর্ণভেদ বা জাতিভেদ প্রথা বিস্তার লাভ করে ।

প্রাচীন ভারতের শেষ অধ্যায়ে জাতিভেদ প্রথা বেশ কঠোর হয়ে ওঠে । উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয় ।

নতুন নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় বিধান আরোপ করে নিম্নবর্ণের মানুষদের কোণঠাসা করে ফেলা হয় । ব্রাহ্মণরা সমাজের উচ্চস্থানে অবস্থান করতে গিয়ে পক্ষান্তরে নিজেদের এক স্থানে সংরক্ষিত করে ফেলে । ব্রাহ্মণদের প্রচারিত সামাজিক বিধান অনুযায়ী শূদ্রের ভাষা গায়ে লাগলেও ব্রাহ্মণকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো ।

শুধু তাই নয় উচ্চবর্গের কেউ ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা করলে তাকে সমাজচ্যুত করা এবং অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করা হতো । এসব কঠোরতা সত্ত্বেও ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা সকল সময় বর্ণপ্রথা কঠোরভাবে মানতেন না ।

ফলে কখনও কখনও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মিশ্রণ ঘটতো । এসব থেকে সমাজে কয়েকটি উপবর্গের সৃষ্টি হয় । গ্রামীণ অর্থনীতিতে পেশার বিভিন্নতা থাকায় সেখানে উপবর্ণের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় ।

চিকিৎসা , অস্ত্রোপচার , অঙ্কশাস্ত্র প্রভৃতির চর্চাকারীদের নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপবর্ণ সৃষ্টি হয় । কায়স্থরা শাসন ব্যবস্থায় যুক্ত হয় কেরানী হিসাবে ।

একাদশ শতাব্দীতে কায়স্থরা একটি পৃথক উপবর্ণে পরিচিত হয় । এভাবে চারটি মূলবর্ণ ও অনেক উপবর্ণের উপস্থিতিতে হিন্দু সমাজ গোঁড়ামির সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । এই অবস্থা হিন্দু সমাজকে ক্রমে দুর্বল করে ফেলে । 

হিন্দু ধর্ম ছিল মহুমতের ধারক

হিন্দু সমাজ ও সভ্যতা প্রথমে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু উপত্যকায় যেখানে আর্যরা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করে বসতি স্থাপন করেছিল এবং ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করেছিল সমগ্র উত্তর - পশ্চিম ভারতে । হিন্দু ধর্ম একটি বিশেষ ধর্ম নয় একটি ধর্ম সমবায় ।

এর মধ্যে রয়েছে যেমন নিরাকার একেশ্বরবাদ তেমনি রয়েছে সাকার উপাসনা । এর মধ্যে কেউ মাতৃতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী , কেউ পিতৃতান্ত্রিকতায় ।

কারও সাধনার উদ্দেশ্য মোহ্ম লাভ আবার কেউ ইন্দ্ৰীয় উপাসক । পূজা উপাসনা , কর্ম , জাত , বিয়ে , অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ভিন্নতা এবং প্রচুর স্ব - বিরোধী ধ্যানধারণা রয়েছে হিন্দু সমাজে ।

এই সমাজের কেউ নিরামিষ আবার কেউ আমিষভোজী বৈদিক এবং উপনিষদ যুগের সমাজে আমিষ ও নিরামিষ উভয় আহারের কথাই শোনা যায় । বৃহদারণ্যক উপনিষদে দশ প্রকার খাদ্যশস্যের উল্লেখ আছে । যথা— ব্রীহি , যব , তিল , মাস , অনুপ্রিয় , অঙ্গব , গোধুম , মসুর , খল্ব ও খলকূল ।

এসব খাবার ছাড়াও ' শ্বেতযজুর্বেদের মুদ্গা , মীবার ও শ্যামাকারের উল্লেখ রয়েছে । এ সকল শস্যকে পিষে এবং দই ও দুধে ভিজিয়ে খাওয়া হতো । গরুর মাংস ভোজন প্রিয় খাবার ছিল ।

‘ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ’ থেকে জানা যায় রাজা বা সম্ভ্রান্ত অতিথি এলে বন্ধ্যা গাভী হত্যা করা হতো । ' কৃষ্ণ যজুর্বেদের ’ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কোন কোন যজ্ঞে এবং কোন কোন দেবতার রুচি অনুযায়ী কি ধরনের গরু হত্যা করা হবে তাও বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ।

যেমন- বিষ্ণু দেবতার জন্য খর্বাকায় গরু , ইন্দ্রের জন্য শিং বিশিষ্ট বলদ , বায়ু দেবতার জন্য মাংসল গাভী , বিষ্ণু ও বরুণের জন্য বন্ধ্যা গাভী , পৃষার জন্য কালো রং - এর গাভী , মিত্র ও বরুণের জন্য দুই রঙা গাভী ।

অশ্বমেধযজ্ঞের মতো বড় বড় যজ্ঞে ঘোড়া , গাভী , ছাগল , হরিণ প্রভৃতি মিলে প্রায় ১৮০ প্রকার গৃহপালিত পশুর মাংসের প্রয়োজন হতো । 

বৈদীক পরবর্তী যুগে প্রাচীব ভারতীয় সমাজ

হস্তিনাপুর , কাম্পিল্য ও অযোধ্যায় প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের জীবনব্যবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যায় । এ সময় নগরসমূহ ছিল প্রাচীরবেষ্টিত , রাজপথ ছিল প্রশস্ত , রাজপথের পাশে ছিল অট্টালিকাসমূহ । নগরের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল রাজধানী ।

রাজধানীর নিকটেই সৈন্য সামন্ত , পুরোহিত ও সন্ন্যাসীদের বাসগৃহ ছিল । নগরের চারদিকে ছিল প্রজাদের বসতি । প্রজারা প্রতি সন্ধ্যায় নিজেদের ঘরে অগ্নিতে আহুতি প্রদান করতো ,

অতিথিদের সমাদর করতো , রাজবিধি মেনে চলতো , বড় বড় যজ্ঞে পুরোহিতদের নিমন্ত্রণ করতো এবং দেবজ্ঞ ব্যক্তিদের সম্মান করতো । আর্য বালকরা শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য গুরুগৃহে যেতো ।

ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য সকলেই এক আসনে বসে এক পাঠ , এক ধর্ম অধ্যয়ন ও আচরণ করতো । পাঠ শেষ হলে গুরুর অনুমতি নিয়ে তারা নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারতো , বিয়ে করতো এবং গার্হস্থ্য জীবনে নিজেদের জড়াতো ।

এ যুগের পুরোহিত ও সৈনিকরা বিশেষ নয় সাধারণ জাতি হিসাবেই বিবেচিত হতো । 

প্রাচীন ভারতের শেষ অধ্যায়ে ধর্মীয় জীবনেও পরিবর্তন আসতে থাকে । জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার রুদ্ধ ও সংকুচিত হয়ে পড়ে । জৈন ধর্ম পশ্চিম ভারতে এবং বৌদ্ধ ধর্ম পূর্ব ভারতে তার আদি অবস্থায় টিকে থাকে ।

বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান সুসংহত হয় । এই অবস্থার পরিবর্তন হয় সেন যুগে । সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী ছিলেন । 

তাঁদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি আঘাত হানে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতিতে । এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিভিন্ন আচার - অনুষ্ঠান সমাজ জীবনের গভীরে প্রবেশ করে । রাজা বল্লালসেন কৌলীন্য প্রথার প্রচলন করেন । ব্রাহ্মণ শাসকদের অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মে বিপর্যয় নেমে আসে ।

বাংলার অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ ও বৌদ্ধ পণ্ডিত দেশ ত্যাগ করে চলে যান তিব্বত এবং অন্যান্য দেশে । সপ্তম শতাব্দী থেকেই দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে ।

ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম দুটো শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে । এর একটি বৈষ্ণবধর্ম আর অন্যটি শৈব ধর্ম । এই দুই সম্প্রদায়ের প্রাধান্য লক্ষ করা যায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে ।

এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজবংশের রাজারাই শিবের উপাসক ছিলেন । তাঁদের সময় ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবের বড় বড় মন্দির নির্মিত হয় । রাষ্ট্রকুট রাজ্যেও বৈষ্ণব এবং শৈব ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় । এরই প্রভাবে মূর্তি পূজা ক্রমে বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর দেবমূর্তি তৈরি হতে থাকে ।

মন্দির পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা ছিল ব্রাহ্মণদের হাতে । অস্পৃশ্য ও শূদ্রদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না । 

বর্ণভেদ প্রথা ভারতীয় সমাজে নারী অধিকার বঞ্চিত করে । আর্য মনীষী মনুর লিখিত আইন গ্রন্থ বা মনুসংহিতায় ( মনুস্মৃতি নামেও পরিচিত ) বহুকাল আগেই সমাজ জীবনে নারীদের অবস্থান প্রসঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে । এখানে বিভিন্ন নিয়ম - নীতি বেঁধে দিয়ে নারীকে সর্ব প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় ।

পরবর্তী সময় এই নিয়মের বন্ধন আরও বৃদ্ধি পায় । নারীকে এক অর্থে পুরুষের দাসে পরিণত করা হয় । সমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন অব্যাহত থাকে ।

নির্দেশ দেয়া হলো হিন্দু বিধবারা পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না । একই সঙ্গে সমাজে সতীদাহ প্রথাও চালু করা হয় । স্বামীর মৃত্যুর পর তার চিতায় স্ত্রীর আত্মাহুতি দেয়া পুণ্য কর্ম হিসাবে বিশ্বাস করা হতো ।

প্রাচীন ভারতে রাজ্য বিস্তার ও রাজ্য রক্ষার জন্য যুদ্ধ ছিল আবশ্যিক ও জনপ্রিয় বিষয় । সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হতো বলে সমাজ জীবনে এর ব্যাপক প্রভাব ছিল ।

সামাজিক ও ধর্মীয় বিধানকর্তারা প্রচার করতেন , যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা হবে পুণ্যের কাজ । তাই মেয়েরাও সৈনিকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতো ।

এর প্রভাব পড়েছিল সতীদাহ প্রথায় । সৈনিক স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে বিধবা স্ত্রীরা নিজেদের উৎসর্গ করতে অনেক সময়ই দ্বিধা করতো না । কেউ স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় যেতে না চাইলে তাকে বল প্রয়োগ করা হতো । এমনি করে সতীদাহ প্রথা একটি স্বাভাবিক নিয়মে এসে দাঁড়ায় ।

প্রাচীন ভারতের শেষ অধ্যায়ে সমাজ জীবনে নৈতিকতার মান নেমে গিয়েছিল ।গুজরাট , উড়িষ্যা , উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য স্থানের মন্দিরেও দেবদাসী দেখা যায় ।

প্রথম দিকে দেবদাসীদের মন্দিরের পরিচারিকার দায়িত্ব দেয়া হতো । তখন সমাজে তাদের সম্মানের স্থান ছিল । পরে অসামাজিক কাজেও এদের ব্যবহার করা হতে থাকে । 

প্রাচীন ভারতে ক্রীতদাস প্রথারও প্রচলন ছিল । তবে কৃষি জমি বা কারিগরি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ক্রীতদাস নিয়োগের কথা জানা যায় না । সমাজে ক্রীতদাসের সংখ্যা বেশি ছিল বলে মনে হয় না ।

সাধারণত গৃহস্থালি কাজ ও মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ক্রীতদাসদের ব্যবহার লক্ষ করা যেতো । 

সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করতো সামন্ত প্রভু বা জমির মালিকরা । প্রাচীন যুগের শেষ পর্বে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রভাব কিছুটা কমে যায় । কারিগর শ্রেণীর লোকেরা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল ।

তাদের অবস্থান ছিল মূলত শহরগুলোতে । ক্ষুদ্র শ্রেণীর লোকেরা জমি চাষ করতো । ভূমিদাসের মতো কিছু ভূমিহীন কৃষক অন্যের জমিতে চাষ করতো । মন্দিরকে গ্রামীণ জীবনের কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হতো । 

সাধারণ মানুষের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের উপরে শাস্ত্রের বিধানকর্তাদের খবরদারি ছিল । অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলে নিজস্ব খাদ্য পদ্ধতিও পাশাপাশি বজায় ছিল ।

তাই কোন অঞ্চলের মানুষ আহার করতো নিরামিষ আবার কেউ আমিষ । মার্কোপলোর বিবরণ থেকে জানা যায় পাণ্ড্যরাজ্যের মানুষ গরু ছাড়া অন্য পশুর মাংস খেতো । 

প্রাচীন যুগের শেষ দুই শতকে অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক অবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসে । সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায় । অন্যদিকে সমাজের অর্থবানরাও স্বস্তিতে ছিল না ।

তারা রাজকর্মচারীদের লোলুপ দৃষ্টির কারণে ভীত ছিল অথবা প্রতিবেশী রাজ্যের সৈন্যরা তাদের অর্থ লুণ্ঠন করবে বলে আশংকা করতো । তাই সমাজের ধনী - দরিদ্র উভয়েই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অদৃষ্টের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ।

ভাগ্যের উপর বিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় সমাজে ভাগ্য গণনাকারী জ্যোতিষীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । এ যুগের রাজসভায়ও জ্যোতিষীদের সম্মানের আসন ছিল । 

প্রাচীন ভারতের শেষ অধ্যায়ে ভারতের বাইরে থেকে দুটো ধর্মের আগমন ঘটে এবং উপমহাদেশে এই দুই ধর্মের প্রভাবে নতুন দুই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় ।

এর একটি খ্রিস্টধর্ম ও খ্রিস্টান জাতিগোষ্ঠী আর অন্যটি ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান জাতিগোষ্ঠী । কোন কোন অঞ্চলের রাজারা ইসলাম ধর্মের প্রতি উদারতা দেখিয়েছেন ।

এঁদের মধ্যে চালুক্য , রাষ্ট্রকুট ও পাণ্ড্য রাজ্যের নাম করা যেতে পারে । এই সমস্ত অঞ্চলের রাজারা মুসলমানদের বসতি গড়ার জন্য সহযোগিতা করেন ।

খ্রিস্টধর্মের অনুসারীদের প্রতিও এই সমস্ত রাজাদের একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল । অবশ্য সর্বত্রই এমন উদার অবস্থা বিরাজ করেনি । 

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ