এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব গৌতম বুদ্ধ। একদিকে তিনি মহাজ্ঞানী, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক,মনস্তত্ত্ববিদ, মানবতাবাদী এবং অন্যদিকে এক বড় বিপ্লবী ও সমাজসংস্কারক। তাঁর ব্যক্তিত্বের এ দুটো দিক আসলে একই সূত্রে গ্রথিত।
তার প্রচারিত ধর্ম হচ্ছে সার্থক এক জীবনদর্শন। এ জগৎ ও জীবনকে তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা বিচার করেছেন এবং ঠিক সেভাবেই নিজের অভিজ্ঞতা-লব্ধ সত্যকে প্রচার করার প্রয়াস পেয়েছেন।
তাঁর সমাজসংস্কার তাঁর জীবনদর্শনেরই বহিঃপ্রকাশ, তাঁর মানবতাবাদেরই বলিষ্ঠ প্রয়োগ। এ সমাজসংস্কারই তাঁকে করেছে এক মহান বিপ্লবী। তাঁর বিপ্লব কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লব নয়,এ হচ্ছে চারিত্রিক বিপ্লব, এর অস্ত্র হচ্ছে অহিংসা, প্রেম ও করুণা।
বুদ্ধের বিপ্লবী জীবন শুরু হয় তাঁর গৃহত্যাগের ঘটনার মধ্য দিয়ে। বুদ্ধ যে সময়ের মানুষ তখন ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর।
এ কঠোর সামাজিক অনুশাসন তুচ্ছ করে রাজপুত্রের সকল প্রকার আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষুকের বেশে বেরিয়ে পড়াও এক ধরনের বিপ্লব এক বড় চ্যালেঞ্জ। বুদ্ধের ছিল অসাধারণ আত্মবিশ্বাস।
এ আত্মবিশ্বাসের বলেই তিনি গৃহত্যাগ করেছেন, নির্বাণের অমৃত আস্বাদ পেয়েছেন এবং নানাবিধ জটিলতার মধ্যে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সমাজসংস্কারের মতো কঠিন কর্তব্য সম্পাদন করতে পেরেছেন।
বুদ্ধই বিশ্বের একমাত্র মানবতাবাদী মহাপুরুষ, যিনি সর্বপ্রথম অস্ত্র ছাড়াই অহিংস ও প্রেমের মন্ত্রে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির মাধ্যমে এক রক্তবিহীন বিপ্লবের সূচনা করেছেন, যা আজকের সমাজসেবী মানুষ অত্যন্ত যৌক্তিকতার সঙ্গে অনুসরণ করতে পারে।
বুদ্ধের এ বিপ্লব সশস্ত্র বিপ্লবের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সশস্ত্র বিপ্লব হঠাৎ আসে আর হঠাৎ চলে যায়। এর ফলাফল ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু অস্ত্রবিহীন বিপ্লব আসে ধীরে, এর ফলাফল হল চিরস্থায়ী।
বুদ্ধের বিপ্লবের উদ্দেশ্য শুধু সমাজের পরিবেশকে সুন্দর ও সুস্থ করে তোলা নয়; মানুষের মনের এবং চরিত্রেরও উৎকর্ষসাধন করা। এখানেই তার বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য।
বুদ্ধের বিপ্লব সূচিত হয়েছে তাঁর সমাজসংস্কারমূলক নানাবিধ কর্তব্য সম্পাদনের মাধ্যমে। তাঁর সমাজসংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে আর্য-অনার্য, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, উচ্চ-নীচু, এক কথায়, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও জাতিভেদ প্রথা বিলোপসাধন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণকুলকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেছেন।
ব্রাহ্মণগণ তখন জন্মের দিক থেকে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে সমাজে নিজদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করত। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদের এক উপকথা অনুসারে ব্রাহ্মণদের জন্ম সোজাসুজি ব্রহ্ম বা পরম স্রষ্টার মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়দের জন্ম বাহু থেকে, বৈশ্যদের জন্ম কটিদেশের নিম্নভাগ থেকে এবং শূদ্রদের জন্ম পদমূল থেকে।
জন্মের দিক থেকে ব্রাহ্মণদের এ শ্রেষ্ঠত্বর দাবির বিরুদ্ধে বুদ্ধ জোরগলায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং এ দাবিকে সহজেই খণ্ডন করেছেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ব্রাহ্মণত্ব জন্যের ওপর নির্ভর করে না, একমাত্র চরিত্রের ওপরই তা নির্ভর করে।
কাজেই বুদ্ধের মতে চরিত্রের উৎকর্ষসাধন করে যে কেউই ব্রাহ্মণ হতে পারে কেননা চরিত্রই মানুষকে মানুষ বা অমানুষ করে গড়ে তোলে। মানুষের আসল পরিচয় তাই জন্ম নয়,চরিত্র।
ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বুদ্ধের এরূপ সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব নিয়ে অনেক মজার কাহিনী আছে। এ কাহিনীগুলোর ভেতর দিয়ে কিন্তু বুদ্ধের মতবাদের আসল রূপটি আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
একদিন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বুদ্ধ এক ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে উপস্থিত।এতে ব্রাহ্মণ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধকে তাঁর মতোই চাষী হয়ে জমি চাষ করতে উপদেশ দিলেন।
বুদ্ধ এতে একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন ব্রাহ্মণের মতো তিনিও একজন চাষী তবে জমি চাষের পরিবর্তে তিনি নিজের মনের চাষ করেন এবং এর ফলে এমন এক ফসলের উৎপন্ন হয় যা হচ্ছে চিরশান্তি প্রদানকারী।
ব্রাহ্মণ এতে অত্যন্ত বিচলিত ও মুগ্ধ হলেন এবং অত্যন্ত যত্নসহকারে বুদ্ধকে আহার্য প্রদান করলেন। আরো একটি কাহিনী অনুসারে কোনো এক ব্রাহ্মণ তার প্রাত্যহিক যাগ-যজ্ঞের পর প্রসাদ প্রদানের জন্য ধার্মিক ব্যক্তির খোঁজ করছিলেন।
অতি নিকটেই এক গাছের নিচে বুদ্ধকে পেয়ে ব্রাহ্মণ বুদ্ধের জাতির পরিচয় জানতে চাইলেন। তার উত্তরে বুদ্ধ বললেন : জাতির প্রশ্ন কেন, চরিত্রের কথাই বলুন।
কেননা চরিত্র ইমানুষের আসল পরিচয়।চরিত্রের প্রতি বুদ্ধের এই যে গুরুত্ব আরোপ তা বৌদ্ধধর্মের এক অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।চরিত্রই মানুষের ব্যক্তিত্বের নির্ধারক—কে কোন ধরনের লোক তা নির্ধারিত হয় একমাত্র চরিত্রের মাধ্যমেই।
বৌদ্ধধর্মে তাই নৈতিক চরিত্রের প্রশ্নটি অত্যন্ত বড়।কেননা,ধর্মীয় জীবনের জন্য, দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়া প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য।
বুদ্ধের মতে মূর্খরাই মনে করে গঙ্গাস্নানে পুণ্য হয়, সমস্ত পাপ ধৌত হয়। কিন্তু যে পাপী, যার মন অসূয়া, কলুষিত ও বিদ্বেষে ভরা, শত গঙ্গার জলেও তার পাপ ধৌত হয় না।
যে সর্বজীবে দয়া করে, মিথ্যে কথা না বলে জীব হিংসা না করে প্রদত্ত দান গ্রহণ না করে, স্বার্থ ত্যাগ করে এক কথায় যার মন পবিত্র, গয়ায় গিয়ে তার কী লাভ? যে কোনো জলই তার নিকট গয়ার জল।
বুদ্ধের বিপ্লবের উদ্দেশ্য শুধু ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা নয়, আধ্যাত্মিক জীবনে সবাইকে সমানাধিকার দেওয়াও বটে।তখনকার দিনে সমাজে নিম্নশ্রেণীর বিশেষ করে শূদ্রদের ও মেয়েদের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক জীবনে কোনো অধিকার ছিল না।
বুদ্ধই সর্বপ্রথম তাদেরকে এ অধিকারটুকু প্রদান করেন।সমাজে অবহেলিত নিম্নশ্রেণীর অনেককেই বুদ্ধ বিনা দ্বিধায় নিজের সংঘে স্থান দিয়েছেন। বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর উপালি নামে একজন নাপিত, সুনীত নামে একজন ঝাড়ুদার, রুক্ষস নামে এক নিম্নশ্রেণীর লোক এদের মধ্যে অন্যতম।
কথিত আছে কুণ্ঠাগরের ক্ষত্রিয় রাজার নিমন্ত্রণ বাদ দিয়ে বুদ্ধ উন্না নামে এক অতি সাধারণ লোকের বাড়িতে আহার করতে গিয়ে পচা মাংস খেয়েছিলেন এবং এটিই বুদ্ধের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষের প্রতি বুদ্ধের করুণা ও ভালবাসার এর থেকে বড় দৃষ্টান্ত আর কী থাকতে পারে?
সাধারণ মানুষের প্রতি বুদ্ধের এ ভালবাসার ইতিহাস কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তখনকার সামাজিক প্রথাকে অবজ্ঞা করে নিম্নশ্রেণীজাত ও সমাজে ঘৃণিত একাধিক মেয়েকে নিজের সংঘে প্রবেশাধিকার দিয়ে বুদ্ধ এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
নিম্নশ্রেণীর লোকদের মতো মেয়েদেরও তখন কোনো ধর্মীয় অধিকার ছিল না।
বুদ্ধই তাদেরকে এ অধিকার নিয়েছেন।বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীদের মধ্যে কুণ্ডলকেশী, ভদ্ৰ কৃপালিনী, ধর্মদত্তা প্রমুখের নাম বিশেষভাবে সমাবেশে ধর্মদেশনা করতেন এবং কবিতা আকারে লিপিবদ্ধ এদের ধর্মোপদেশ ও বাণীই উল্লেখযোগ্য।বৌদ্ধধর্মে এরা সবাই থোঁর নামে পরিচিত।
দুষ্টাচরণ ও ব্যভিচারের জন্য সমাজে ঘৃণিত ও অবহেলিত অনেক মেয়েকেই বুদ্ধ নিজের সংঘে স্থান দিয়েছেন। এদের মধ্যে পরমাসুন্দরী আম্রপালী, শ্রীমা ও অর্ধকেশীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।বুদ্ধের সমাজসংস্কারের এ গেল একদিক।
অন্যদিকে প্রাচীন ভারতে প্রাণী হত্যা ও পশুবলি প্রথার বিলোপসাধনে বুদ্ধের অবদান অসামান্য।
একদিন রাজগৃহের পথ দিয়ে যাবার সময় বুদ্ধ দেখতে পেলেন একটি রক্তাক্ত ছোট মেষশাবকসহ একদল মেষ তাড়িয়ে কয়েকজন লোক সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
উদ্দেশ্য, স্বয়ং রাজা বিম্বিসারের উপস্থিতিতে কোনো এক ধর্মীয় উৎসবে এদেরকে বলি দেওয়া। বুদ্ধ এতে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন এবং রক্তাক্ত মেষশাবকটিকে কোলে নিয়ে উৎসব-স্থানে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
পশুবলির অযৌক্তিকতা দেখিয়ে উপস্থিত পুরোহিতদের তিনি বলেন, ছোট এক মেষশাবককে হত্যা করে যদি আধ্যাত্মিক কিছু লাভ হয়ে থাকে তবে মানুষকে হত্যা করে তার চেয়েও বেশি আধ্যাত্মিক উন্নতি হতে পারে। যেমন কথা তেমন কাজ।
বুদ্ধ তখনই বলি দান স্থানে নিজের গলা বাড়িয়ে দিলেন। বুদ্ধকে অবশ্য জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এতে রাজা বিম্বিসারের হৃদয় বিগলিত হয়ে যায় এবং সেদিনই তিনি ধর্মীয় উৎসবে পশুবলি নিষেধ করে আদেশ জারি করলেন। এই তো বুদ্ধের বৈপ্লবিক সমাজসংস্কার।
সাধারণ মানুষের প্রতি বুদ্ধের যে অসীম দয়া ও ভালবাসা তার আরো সুস্পষ্ট পরিচয় মেলে পালি ভাষার মাধ্যমে তাঁর ধর্ম প্রচার থেকে। তখন সংস্কৃত ছিল আভিজাত্যের ভাষা,ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতদের ভাষা।
এ ভাষাতেই ধর্মীয় কাজকর্ম সম্পাদন করা হত। সমাজের সাধারণ মানুষের তা ছিল বোধগম্যের বাইরে।
বুদ্ধই সাধারণ মানুষের বোধগম্য পালি ভাষায় তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। বুদ্ধই তা হলে সর্বপ্রথম মাতৃভাষার মর্যাদা দিয়েছেন।এ তো কম কৃতিত্বের কথা নয়।
সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার্থে বুদ্ধের আর একটি বড় অবদান হচ্ছে গণতন্ত্র প্রচলন। প্রাচীন ভারতে তখন ছিল রাজতন্ত্রের যুগ। গণতন্ত্র ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও অপরিচিত।
বুদ্ধই তাঁর সংঘের ও বৌদ্ধ বিহারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভোটের মাধ্যমে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার রীতি প্রচলন করেন।
বুদ্ধ যে গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ পূজারী তার আরো একটি বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃত্যুর আগে তিনি তার পরিবর্তে কাউকে সংঘ-পরিচালনার ভার দিয়ে যান নি যদিও তিনি ইচ্ছে করলে আনন্দ বা যে কোনো একজনকে উত্তরাধিকারসূত্রে মনোনীত করতে পারতেন।
তাঁর মৃত্যুর পর ভাই তো বৌদ্ধধর্ম নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে গেল।
রাজপুত্র হয়েও সাধারণ মানুষের প্রতি বুদ্ধের ছিল অসাধারণ দয়া ও ভালবাসা। এবং এই সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের জন্যই তিনি সংগ্রাম করেছেন এবং রক্তবিহীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক নতুন ইতহাস রচনা করেছেন।
বুদ্ধের বাণী হচ্ছে সর্বজনীন প্রেম ও করুণার বাণী, অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী। তিনি সর্বর্জীব ও মানুষের জন্য স্থাপনে বুদ্ধের এ অমর বাণা অনুপ্রেরণা যোগাক, আজ এটাই সবচেয়ে বড় কাম্য
সূত্র-
বুদ্ধ(ক্যারেন আর্মস্ট্রং),
বুদ্ধ;ধর্ম ও দর্শন(নীরুকুমার চাকমা)
Nics
You must be logged in to post a comment.