ইসলামে নারীর অধিকার ও সন্মান

মানুষ সামাজিক জীব, অন্যদিকে প্রকৃতির অংশ। তাই মানুষকে জীবন ধারণ, বেচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় বিধানই মেনে চলতে হবে। প্রাকৃতিক বিধান লঙ্ঘন করলে ধ্বংশ অনিবার্য। আর সামাজিক বিধান ভঙ্গ করলে নেমে আসে বিপর্যয়। সামাজিক নিয়মগুলো প্রকৃতি থেকে মানুষের লভ্য ধারনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে উঠে। বিধানসমূহের মধ্যে ধর্মীয় বিধানই শ্রেয়। 

ইসলামের মহাগ্রন্থ আল- কুরআনে 'নিসা' অর্থাৎ 'মহিলা' শব্দটির ৫৭ বার ' ইমরাআহ' অর্থাৎ ' নারী' শব্দটি ২৬ বার উল্লেখ হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ' নিসা' তথা ' মহিলা' শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র বড় সুরাও রয়েছে। এছাড়া কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সুষ্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। দিয়েছে নারীর জানমালের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সন্মান। 

ইসলামে নারীর শিক্ষাঃ

নারীদের তালবিয়ার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আছে, তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরন করো ও উত্তম আচরন করার শিক্ষা দাও। ( সুরা; নিসা, আয়াতঃ ১৯)। মহানবী (সাঃ) ঘোষণা করেন, যার রয়েছে কণ্যাসন্তান সে যদি তাকে (শিক্ষা সহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্র সন্তানকে তার উপর প্রাধান্য না দেয়, আল্লাহ তা' আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তিনি আরো বলেন, তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও। ( উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো) । হাদিস শরিফে বলা হয়েছে ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর প্রতি ফরজ( কর্তব্য) । ( উম্মুস সহিহাইন ইবনে মাজাহ শরীফ )। তাই হাদিস গ্রন্থ সমূহের মধ্যে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২ হাজার ২শত ১০ যা সব সাহেবায়ে কেরামের মধ্যে ২য় সর্বোচ্চ। 

ইসলামে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে উতসাহিত করা হয়েছে এবং মেধা, মননশীলতা, বিবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক উতকর্ষের ক্ষেত্রে রাসুল (সা) অত্যান্ত গুরুত্ব প্রদানের সাথে সাথে নারীশিক্ষায় ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছেন। কেননা তিনি মনে করতেন, নারীকে শিক্ষাবঞ্চিত রেখে যেমন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয় তেমনি শিক্ষিত জাতি গঠনে এবং পারিবারিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করার জন্য মেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রমে আত্বনিয়োগ করা অনস্বিকার্য। যেমনভাবে উম্মুল মুমেনিন তাদের কাছে আগত মহিলাদের কে ধর্মীয়, ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ইত্যাদি বিষয়ে নীতিগত শিক্ষা দান করতেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে , বলো যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? ( সুরাঃ আল- যুমার, আয়াত ৯) তাই নবী করিম স্বয়ং নারীদের বিদ্যা শিক্ষা গ্রহনের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নারীদের উদ্যেশ্যে শিক্ষামূলক ভাষণ দিয়ে উদাত্ত কন্ঠে আহবান জানিয়ে বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন করা ফরজ। ( ইবনে মাজাহ) ইসলাম নারীকে মৌলিক মানবাধিকার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা , চিকিতসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমান মর্যাদা প্রদান করেছে। ইসলাম নারীকে বিদ্যা শিক্ষার অধিকার দিয়েছে। ধর্মীয় ও বিষয়গত জ়ীবনের শিক্ষাদীক্ষা ও যাবতীয় দায় দায়িত্বের সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ নারীদের রয়েছে। ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে আরবের মাত্র ১৭ জন লোক পড়ালেখা জানতো, এরমধ্যে ৫ জনই ছিলো নারী। তাই নারীর ব্যক্তিস্বত্বার পরিচর্যা আর্থিক উন্নয়ন ও নীতিগত গুনাবলী উতকর্ষ সাধনের জন্য রাসুল (সাঃ) পুথিগত বিদ্যার বাহিরে ও জ্ঞান অর্জনের পরামর্শ দিতেন। মুসলিম পরিবারের কন্যা শিশুর শিক্ষাদীক্ষা ভরনপোষণ সহ যাবতীয় দায়ভার পিতাকে বহন করতে হয় স্বেচ্ছায় ও সুসম্মতিতে তার বিয়ে না হয়া পর্যন্ত । এজন্য কন্যা শিশুর প্রতিপালন ও মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা দানের জন্য বেহেস্তের সুসংবাদ দিয়ে নবী করিম সা; বলেন , যার দুইটি বা তিনটি কন্যা সন্তান আছে এবং তাদের উত্তম শিক্ষায় সুশিক্ষিত প্রতিপালিত করে সৎ পাত্রস্থ করবে, সে জান্নাতে আমার সংগে সহাবস্থান করবে।(মুসলিম শরীফ)

নবী করিম সাঃ নারীকে সৃজনশীল চিন্তাচেতনা ও শিক্ষা গবেষণায় সুদক্ষ করার জন্য সম্পুর্ন স্বতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেন। সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিন শুধু নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতেন। রাসুল (সাঃ) এর কাছে নারীরা এই মর্মে অভিযোগ করলেন যে, আপনার কাছে শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে পুরুষরা এগিয়ে। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বরাদ্দ করুন। রাসুল(সাঃ) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন এবং নির্দিষ্ট দিনে তাদের সাথে সাক্ষাত করে দিক নির্দেশনা মূলক জ্ঞান , শিক্ষা ও উপদশ দিতেন। ( বুখারি) 

মহানবী (সাঃ) সহধর্মীনি হযরত আয়েশা (রাঃ) সহ অনেকেই নারীশিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাকে হাদিস বর্ণনাকারী ইমাম ও অধিক জ্ঞানসম্পন্ন সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। বহু সংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ী তার কাছ থেকে হাদিস বর্ননা করেন এবং এলম দ্বীন শিক্ষা লাভ করেন। তার বর্নিত ২২১০ হাদিসের মধ্যে ১৭৪ টি বুখারি ও মুসলিম গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। মুসলিম রমনীদের মাঝে তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষিকা, সর্বোচ্চ মুফতি, সবচেয়ে জ্ঞানবতি ও বিচক্ষণা। সে যুগের জ্ঞানের জগতে তার ছিলো অসাধারন ভূমিকা।

আরবদের ইতিহাস, চিকিতসা ও পদ্য সাহিত্যে তিনি ছিলেন অধিকতর জ্ঞানী, সঠিক সিদ্ধান্ত ও সুক্ষ্য যুক্তি উপস্থাপিকা, জাগতিক জ্ঞানের অধিক পারদর্শী আর দ্বীনের বিষয়ে অধিক বোধ সম্পন্না। তিনি ধর্ম, দর্শন বিভিন্ন মাসয়ালার উদ্ভাবক ছিলেন। তিনি লিখতে ও পরতে জানতেন। পবিত্র কুরআনের তাফসির, হাদিস, আরবী সাহিত্য ও নসবনামা সম্পর্কে পুর্ন পান্ডিত্য তার সুখ্যাতি ছিল। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে নবী করিম (সাঃ) আদরের দুহিতা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন অনন্য। তিনি পিতার কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা অর্জন করে নিজে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছিলেন। মদিনায় তার গৃহে প্রায় বিভিন্ন জ্ঞান পিপাসু মহিলার ভীর লেগে থাকতো। তখন তার ঘর ছিলো একটি  শিক্ষা কেন্দ্র। অতএব, মেধাবী নারীদের কোনঠাসা করে না রেখে , শালীন ভাবে নিরাপদে চলাফেরা ও উপযুক্ত শিক্ষা দীক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে, এজন্য আমাদের দৃষ্টিভংগী পালটাতে হবে। দেশের নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলে সন্তানেরাও সঠিক শিক্ষা পাবে, তাদের উপযোগ ও পৃথক কর্ম স্থানের মাধ্যমে দেশ ও আর্থিকভাবে লাভবান হবে। 

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles