বড় হবার স্বপ্ন ?

সকলের জীবনেই আছে। পাঠকের হাতে তেমন একটি স্বপ্নের কাহিনী এক প্রবাসী ভাইয়ের। যিনি বড় হতে গিয়ে ছোট হয়ে যান, চলার পথে পদে পদে হোঁচট খান, উন্নতির পর্বত-চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার কিছু পূর্বে পিছল কেটে নিচে পড়ে যান।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

যার সুদৃঢ় বিশ্বাস আছে, "যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে, বারেক হতাশ হয়ে কে কোথায় মরে? বিপদে পতিত তবু ছাড়ি না হাল..

আজিকে বিফল হলে হতে পারে কাল।” যিনি জীবনে বহু লাঞ্ছিত হয়েছেন, ব্যথা পেয়েছেন, বেদনার কাটায় কোমল হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, তবুও আশা রাখেন, "আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে,

আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে।' যিনি জীবনে বহু ভুল করেছেন এবং সে ভুল শুধরে নিয়েছেন, অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে চলার পর, আলোর পথের দিশা পেয়েছেন।

যার 'বড় হওয়ার স্বপ্ন' আছে, স্বপ্ন বাস্তব করার প্রচেষ্টা ও সাধনা আছে। যিনি ভুল করেছেন এবং চান যে, তাঁর মতো ভুল যেন কেউ না করে। যিনি দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন এবং চান যে, তাঁর মতো দুঃখ-কষ্ট যেন কেউ না পায়।

তাঁর হাতে এবং তাঁর মতো 'বড় হওয়ার স্বপ্ন'-ওয়ালাদের হাতে আমার এটি ক্ষুদ্র উপহার। আমার আশা, তাঁরা সকলেই এই উপহারের যেটি ভোগ্য, সেটি ভোগ করবেন এবং যেটি ত্যাজ্য, সেটি ত্যাগ করবেন।

বড় হবার স্বপ্ন..............?

রাজীব তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। ছাত্র হিসাবে সে বড় ভাল। আরও পাঁচটা ছাত্র-ছাত্রীর মতো তার মনে আশা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, পরিকল্পনা আছে। উঠতি যৌবনের এ বয়সে মনের আবেগ আছে, স্ফূর্তি আছে।

পরীক্ষা আসন্ন হল। রাজীব বিদ্যালয়ে পরীক্ষার এ্যাডমিট কার্ড আনতে গেল। সেখানে দেখা হল প্রায় সকল সহপাঠীদের সাথে। চারিপাশের কয়েকটি গ্রামের মধ্যস্থলে এ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীই শেষ শ্রেণী।

অতএব পরীক্ষার আগে এখানে সমবেতভাবে এই দেখা হয়তো শেষ দেখা। তাই বাংলার শিক্ষক মহাশয় সেই সুযোগ গ্রহণ করে কার্ড বিতরণের পূর্বে সকলকে উপদেশ দিলেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি বড় আন্তরিক, বড় আদর্শ।

শিক্ষার প্রসারে দেশ ও দশের উন্নতি হোক, তা তিনি মনে-প্রাণে চান। তিনি চান, শিক্ষিতরা মানুষ হোক, ছেলে-মেয়ে সকলেই নৈতিকতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত থেকে শিক্ষিত হোক এবং তারা সুন্দর পরিবার, সমাজ, পরিবেশ ও দেশ গড়ে তুলুক।

নানা কথা বলতে বলতে তিনি বললেন, 'আজকের মতো আর কোনদিন হয়তো আমরা একত্রে সমবেত হতে পারব না। আমার আশীর্বাদ থাকল তোমাদের সাথে। তোমরা বড় হও, উন্নত হও। আচ্ছা তোমাদের ভবিষ্যৎ- পরিকল্পনা কী বল তো? এক এক ক'রে বল।'

শ্রেণীর প্রথম স্থান যার দখলে, সে বলল, 'স্যার! আমি শিক্ষক হতে চাই এবং আপনার মতো আদর্শ শিক্ষক হয়ে দেশে শিক্ষার মান ও শিক্ষিতের হারবা ড়াতে চাই।' 

একজন বলল, 'আমি ডাক্তার হতে চাই।”

কেউ বলল, 'আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই।' কেউ বলল, 'আমি অফিসার হতে চাই।'

কেউ বলল, 'আমি উকীল হতে চাই।'

একজন বলল, 'স্যার! আমি কিন্তু পুলিশ হতে চাই।'

শিক্ষক মহাশয় তাকে প্রশ্ন করলেন, 'কী ব্যাপার, তুমি পুলিশ কেন হতে চাও?

উত্তরে সে বলল, 'স্যার! আসলে আমি খুব শীঘ্র ধনী হতে চাই। আর

পুলিশ হলে ঘুস খেয়ে তাড়াতাড়ি তা হওয়া যাবে!”

এ কথা শুনে সকলে হেসে উঠল। হাসির কথাই তো। সে পরিবেশ থেকে গ্রহণ করেছে ভবিতব্যের পরিকল্পনা। তাছাড়া বড় কিছু হতে হলে বড় পয়সা খরচও তো আছে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে কি সকলের সাধ্যে কুলাবে?

রাজীব তখন ভাবছিল, সে কী বলবে? কী হবে সে? সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক, নাকি অন্য কিছু? সমাজে সে অনেক বড় হওয়ার রঙিন স্বপ্ন দেখে। অনেক সফল মানুষের সফলতা তাকে হাতছানি দিয়ে আহবান করে।

কিন্তু যে আশা তার মনে বাসা বেঁধেছে, তার পথ বড় দুস্তর, বড় বন্ধুর। টাকার অশ্ব ছাড়া তা অতিক্রম করা বড় দুঃসাধ্য। তাছাড়া যে যাই বলুক, সকলের উদ্দেশ্য কিন্তু সেই টাকার সোনার হরিণ শিকার। টাকা ছাড়া কি বড় হওয়া যায়?

জগতে যারা বড় হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই এমন বন্ধুর পথে পাড়ি দিয়ে বড় হয়েছেন। তাঁরা অর্থের স্বপ্ন না দেখলেও শিক্ষার আলো জ্বালতে গিয়ে দেখেছেন, অর্থ তাদেরকে সাদর আহবান জানাচ্ছে।

তাঁরা অর্থ না চাইলেও, অর্থ তাদের পিছু ছাড়েনি। সুনাম-সুখ্যাতি লাভের সাথে সাথে অর্থও তাদের চিরসাথী হয়েছে। চেষ্টার ত্রুটি না ক'রে ভাগ্য তাদের সাথ দিয়েছে।

রাজীব মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে কী উত্তর দেবে। মনে মনে ভাবতে লাগল,

আমি সবার সেরা হব শুধু কাজের গুণে, হাসবে নাকো তোমরা কেহ আমার কথা শুনে। আমি হব বীর ক্ষুদিরাম পড়ব গলে ফাঁসি, মৃত্যু দেখে ভয় পাব না, ফুটবে মুখে হাসি।

দেশে আমার সুনাম হবে, রাখব জাতির মান, মায়ের কাছে করব প্রমাণ, আমি তার সন্তান। ভাবতে ভাবতে তার পালা এসে গেল। 'রাজীব! তুমি কী হতে চাও।” "আল্লাহ যা করবেন, তাই হব স্যার! আমিও খুব বড় হতে চাই স্যার।” মনের আশা মনের গহীন কোণে অব্যক্ত রেখে জবাব এড়িয়ে গেল রাজীব।

কিন্তু সে শুনেছিল, আশা ও বাসা করলে বড়ই করতে হয়। আশা ছোট করতে হয় না, আর বাসাওনা।

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বের হল। রাজীব প্রথম শ্রেণী লাভ করেছে। কিন্তু লেখাপড়ায় অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা আর তার নেই। আব্বা দ্বীনদার ছোট ব্যবসায়ী।

টানাটানির সংসার। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই বড় বড় পোস্টে চাকরি করে। তার খালুজান একজন আর্মি ক্যাপটেন। কোন এক সময় কথায় কথায় তিনি রাজীবকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, 'তুমি মাধ্যমিক পাশ কর। আমি তোমার চাকরি ক'রে দেব।”

রাজীবের মনে সেই আশ্বাস প্রবোধ ও বিশ্বাস হয়ে মনকে নিরুদ্বিগ্ন ক'রে রেখেছিল। ভেবেছিল, অধিক লেখাপড়া ক'রে বড় না হতে পারি, কর্মক্ষেত্রে আমি বড় হব। খালুজানের ক্ষমতাও ছিল তার চাকরিটা ক'রে দেওয়ার।

কিন্তু সম্ভবতঃ হিংসাবশতঃ তিনি আর ভ্রূক্ষেপ করলেন না। অনুরোধ ও আবেদন সত্ত্বেও তিনি এড়িয়ে গেলেন। ফলে এত পানির মাঝে থেকেও রাজীবের আফোটা পদ্ম-কলি অকালে শুকিয়ে গেল।

কিন্তু তার মনের ভিতরে ছিল অদম্য সাহস ও উৎসাহ। জীবন-যুদ্ধে সে হেরে যাবে, এমন ভয় তার মনে ছিল না। বিশেষ করে কেউ অবজ্ঞা ও অবহেলা করলে মনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাব-প্রবণতা চরমে উঠে। তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো মনোভাব তখন তীব্র হয়ে উঠে। রাজীবেরও তাই হল।

বেকারত্ব দূর করার জন্য নানা পরিকল্পনা করতে লাগল মনে মনে, সংগোপনে, রজনীর তমস অন্তরালে।

এক রাতে এশার নামায পড়ে বাড়ির সকলে ভাত খেতে বসেছে। বাড়িতে এসেছে মামাজান। তখন কারো খাওয়া শেষ হয়নি, রাজীব অর্ধেক খেয়ে হাতঝেড়ে উঠে পড়ল।

চট্ ক'রে মামা জিজ্ঞাসা করল, 'কী ব্যাপার? পুরো ভাত না খেয়ে উঠে পাড়লে যে!"

--আমার পেট ভরে গেছে মামা!

-এত কম খেলে শরীর ভেঙ্গে যাবে যে বাবা! ---না, না ঠিক আছে।

তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মা বলে উঠল, 'ওর তরকারি পছন্দ হয়নি

ভাই! আধা মাধা খেয়ে ঐভাবে ও প্রায় উঠে যায়।

মামা হাসতে হাসতে বলল, "ভাল তরকারি খেতে হলে ইনকাম করতে হবে তো। এবার বড় হয়েছ, ইনকাম করতে শেখো। আব্বার মতো ব্যবসায় নামো। আচ্ছা! তোমার খালু চাকরি ক'রে দেব বলেছিল, তা কী হল?” এবারে আব্বা বলল, 'চাকরি কি পড়ে আছে নাকি? ক'রে দেব বললেই

এত সহজ!”

মা বলল, "ইচ্ছা করলে জামাই পারবে। কিন্তু এখন কোন গুরুত্ব দেয় না কেন জানি না।”

হাসতে হাসতে মামা বলল, "বিয়ে দেওয়ার মতো মেয়ে নেই যে!” রাজীব লজ্জা পেল। হাত ধুয়ে নিজের রুমে বেড়ে গিয়ে বসল। মামাও হাত ধুয়ে পুনরায় রাজীবকে সম্বোধন ক'রে বলল, 'চাকরির আশায় না থেকে, কিছু একটা ক'রে ইনকাম কর।'

"কোন কাজ ছোট নহে, নহে তা নগণ্য, যদি পার কিছু কর, জীবনের জন্য।

শুনেছ দেশের নেতাদের কথা, 'নো ওয়ার্ক, নো ব্রেড।' এতক্ষণে রাজীব মামাকে পেয়ে বসল। প্রথম আব্দার ক'রে অকপটে সে তাকে বলে ফেলল, 'তুমি আমাকে একশ' টাকা দাও, আমি ইনকাম শুরু করব।'

-একশ' টাকা দিয়ে কী ব্যবসা করবে?

--দাও তো, তারপর দেখবে।

---ঠিক আছে, কাল আমার বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসবে।

পরদিন সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে বড় উদ্দীপনার সাথে আল্লাহর নাম নিয়ে মামার নিকট থেকে একশ' টাকা নিয়ে বাজারে গেল। তা দিয়ে কয়েক রকম কাঁচা তরি-তরকারি কিনে বাড়ি ফিরল। মা দেখে বলল, 'এত সব সবজি কী হবে বাবা?”

রাজীব সহাস্য বদনে মায়োর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ব্যবসা করব মা!

রাস্তার ধারে বারান্দায় বসে বিক্রি করব।” ---ব্যবসা? এই সামান্য সবজি নিয়ে ব্যবসা? এতে কী হবে? জাতও যাবে, আর পেটও ভরবে না।

আরো অনেক কিছু বকাবকি ক'রে মা মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল। রাজীব মা-কে বুঝাতে লাগল। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'আব্বা বলেন, বসে থাকার চেয়ে বেগার যাওয়া ভাল। বসেই তো থাকব। যা হয়, তাই লাভ। কিছু না থাকার চাইতে কিছু থাকা কি ভাল নয় মা?”

মায়ের মন, বুঝাতে হয় তাকেই। কিন্তু ছেলের নিকট হতে বুঝের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। পরবর্তীতে আব্বা ও মামা সাহস দিলে রাজীবের মনোবল আরো সুদৃঢ় হল। ব্যবসার 'বিসমিল্লাহ'তে তার ভালই লাভ হল।

তারপর সে আরো বেশি কাচামাল খরিদ করে ব্যবসাকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুলল। একদিন সে মুদিখানায় বসে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সহ ফলমূল ইত্যাদির ব্যবসাও করতে লাগল।

এর ফলে সংসারে সচ্ছলতার বর্কত পরিদৃষ্ট হল। ছোট থেকে এক ধাপ এক ধাপ ক'রে যে বড় হতে চায়,

সে একদিন বড় হয়---তা তার অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হতে লাগল।

রাজীবকে ব্যবসা করতে দেখে তার কোন কোন আত্মীয়-বন্ধু আজীব হয়ে উপহাস করতে লাগল। সহপাঠীদের তুলনায় সহপাঠিনীদের টিপ্পনী সহ্য করা তার পক্ষে দায় হয়ে উঠল। কেউ কেউ পরামর্শ দিল, এখন থেকে ব্যবসা কেন? এখন তো লেখাপড়ার বয়স। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে যা।

লেখাপড়ার প্রবণতাকে হেলায় নষ্ট ক'রে দিস না। কিন্তু রাজীব বলে, 'সংসার চলবে কীভাবে? লেখাপড়ার খরচ আসবে কোত্থেকে?

তাছাড়া আবার বাদ সাধলেন খালুজী। তিনি বললেন, 'আমি এ বছরে কর্নেল হয়ে যাব এবং স্থানান্তরিত হয়ে দিল্লি যাব। এক বছরের ভিতরে তোমার চাকরি ক'রে দেব। আর এক বছরের মধ্যে কোন ডিগ্রিও হবে না। সুতরাং লাভ কী?”

রাজীব আবারও ভুলে গেল খালুজীর কথায়। আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে দেখাই যাক। অমুসলিম দেশে মুসলিম ছেলের চাকরিতে একটু বেগ তো পেতেই হয়, বহু খড়-কাঠ পুড়াতে হয়, বহু পাপড় বেলতে হয়। ডুবেছি যখন, তখন দেখা যাক, তল কত দূর?

সুতরাং শত মন্ত্রণার মাঝে আবার ব্যবসায় ভালভাবে মনোযোগ দিল।

তাতে যেন তার মন এক প্রকার তৃপ্তি অনুভব করতে লাগল। ব্যবসার সকল প্রকার কৌশল অজানা থাকলেও মিষ্টি ব্যবহারের কারণে ভাগ্য তার সঙ্গ দিল।

ব্যবসা ঊর্ধ্ব গতিতে উন্নতির পর্বত-শিখর জয় করতে উদ্যত হল। ক্রমে ক্রমে রাজীব টাকার পিছনে দৌড় দিতে শুরু করল। যে পথে টাকা

আসে, সে পথ যত ছোটই হোক, তা অবলম্বন করতে সে দ্বিধা করল না, কারো পরোয়া করল না। অবশ্য বৈধভাবে, সাধু পথে। অবৈধ ব্যবসায় সে পা বাড়ায় না।

তার মনে-প্রাণে সে জানত, 'জীবিকার নাই উচ্চ বা নীচ, কোন কাজ নয় হীন,

আলস্য পাপ, তাই সঞ্চিত পুণ্যেও করে ক্ষীণ।'

বড় হবার স্বপ্ন

যদি সে বলে, 'নিচু কাজ করব না', তাহলে সচ্ছলতা কোত্থেকে আসবে? যদি বলে, 'কাদা পথে হাঁটব না', তাহলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে কীভাবে?

“জাল কহে, 'পঙ্ক আমি উঠাব না আর', জেলে কহে, 'মাছ তবে পাওয়া হবে ভার।”

সুতরাং হাফ শহর গ্রামের ফুটবল ময়দানে খেলায় লোকজন জমলে সে সেখানে গিয়ে লজেন্স ও চানাচুর বিক্রি করে। কোনদিন বিক্রি করে আখ। তাতে তার আত্মসম্মানে বাধে না। কিন্তু আত্মীয়রা ধনী বলে তাদের সম্মানে বাধে।

ফলে তাদের অনেকেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অনেকে পরিচয় দিতে ইতস্ততঃ বোধ করে। অনেকে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ করে। কিন্তু রাজীব পিছপা হতে নারাজ।

আত্মীয়দের মধ্যেও তার প্রতি অনেকে হিংসা রাখে। আর সেই হিংসুকদের অবস্থা বাক্সে আবদ্ধ অনেক কাঁকড়ার মত। যাদের একজন ওপর দিয়ে উঠে পালাতে চাইলে নিচে থেকে একজন তার পা ধরে উঠতে চায়।

কিন্তু সে আসলে তাকে টেনে নিচে নামিয়ে দেয়। ফলে কেউই উঠে পালাতে পারে না। হিংসুকরা নিজেরাও অগ্রসর হতে পারে না, আর অপরকেও অগ্রসর হতে দেয় না।

অবশ্য আত্মীয়-বন্ধুদের মাঝে এমন কিছু হিতাকাঙ্ক্ষী লোক ছিল, যারা তাকে এ কাজে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ প্রদান করত। এক দিক থেকে আঘাত এলে অপর দিকে তার প্রলেপের ব্যবস্থা না থাকলে যে মানুষ এ সংসারে টিকতেই পারত না। এ সংসারের রীতিই এই যে, অনেক বিরোধী হলেও..!

সবাই হয় না। বিশেষ করে সৎপথের সাথীরূপে অনেককে পাওয়া যায়। নদীর এক কূল ভাঙ্গলে অন্য কূল গড়ে।

ব্যবসার সাথে ব্যবসায়ী মন-প্রাণ না দিলে ফললাভ হয় না। দেহকে মাটি না করলে, মাটি থেকে খাঁটি সোনা ফলানো যায় না। খাঁটি সোনা লাভের আশায় রাজীবও নিজেকে মাটি করছিল, বড় মেহনত করছিল।

কারো ভরসা না ক'রে শহর থেকে নিজে মাল তুলে নিয়ে আসত। তাতে তার আনন্দও ছিল। যে কাজে লাভ থাকে, সে কাজে আনন্দ থাকারই কথা।

কোন এক অজানা আনন্দে একদিন বাসের ছাদে মাল তুলছিল। হঠাৎ পা ফসকে পড়ে গিয়ে সে আঘাতপ্রাপ্ত হল। এতে বড় কিছু দুর্ঘটনা না ঘটলেও তাকে চিকিৎসা করাতে হয়েছিল।

এক্ষণে আব্বা-আম্মার মনে অধিক দয়া মায়ার সঞ্চার হল। তারা তাকে এমন ব্যবসায় নিজেকে ধ্বংস করে দিতে নিষেধ করতে লাগল।

আব্বা ছিল ভ্রাম্যমান বস্ত্র-ব্যবসায়ী। সে তাকে সেই ব্যবসা করতে উপদেশ দিল। তাতে মেহনত কম, লাভ বেশি, নোকসানের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে কাঁচামাল ও সবজির ব্যবসায় নোকসানের আশঙ্কা আছে, মেহনত আছে।

রাজীব বলল, 'আমি কাপড়ের ব্যবসা করব। কিন্তু আপনার সাথে যৌথ ব্যবসা নয়। আমি পৃথকভাবে ব্যবসা করতে চাই।' আব্বা তাতে সম্মতি দিল। কিন্তু কাপড়ের দোকান করতে গেলে তো

অনেক টাকার প্রয়োজন। তা কোত্থেকে যোগাড় হবে? আব্বার পরিচিত দোকান ছিল। সেখান থেকে নিজের জমানো টাকা দিয়ে কিছু এবং কিছু ধারে মাল নিয়ে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা রেখে দোকান খুলে বসল রাজীব।

আল্লাহ যার সহায় হন, মা-বাপের দুআ যার সাথী হয়, ভাগ্য যার সাথ দেয়, সে কোনদিন অসফল হয় না। কাপড়ের ব্যবসাতেও সে অসাধারণ সফলতা অর্জন করতে লাগল।

মানুষ যখন সফলতার সিংহাসনে বসে, তখন তার অনেক বন্ধু জোটে। ভ্রামরী মিত্রতা শুরু হয়। ফুলে মধু থাকলে ভ্রমরের মতো ফুলের সাথে বন্ধুত্ব করে। দুঃখ পেলে একাকী বসে সইতে হয়, বইতে হয়। আর সুখ পেলে......

অনেকে সুখের ভাগী হতে চায়। সংসারের এই রীতি থেকেও রাজীব তার জীবনকে স্বতন্ত্র রাখতে পারল না।

রাজীবের এখন অনেক বন্ধু। বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারিত করতে চায় অনেক যুবতীও। কিন্তু রাজীব বড় আজিব ধরনের চালাক ছেলে। কোন মেয়েকে সে পাত্তাই দেয় না।

এমনকি যে বন্ধুর বান্ধবী আছে, সে তাকে উপদেশ দেয় নারী-সঙ্গ বর্জন করতে। নারীর নেশা মনে ধরে বসলে পেশা ও চরিত্র যে উচ্ছন্নে যাবে, সে কথা রাজীব ভালমতো বুঝে।

পূর্ব কোন অভিজ্ঞতালব্ধ এ জ্ঞান তার নয়। অনেকের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার গোলাপ-নির্যাস সে তার হৃদয়-পাত্রে সংরক্ষিত রেখেছে। আর সেটাকেই সে প্রয়োজনে আতর

স্বরূপ ব্যবহার করে। পরের দেখে যে শিক্ষা নেয়, নিশ্চয় সে জ্ঞানী। রাজীব সত্যই একটি জ্ঞানী যুবক। কিন্তু পরিবেশ ও সংসর্গের একটা বিশাল প্রভাব আছে। যেমন তার সুগন্ধ আছে, তেমনি তার বিকট দুর্গন্ধও আছে। আর সেই দুর্গন্ধই রাজীবের

আতরের সুগন্ধকে ঢেকে ফেলতে চাইল।

কাপড়ের দোকানে নিত্য-নতুন কত কিশোরী-যুবতী আসে। কত সুস্মিতা তন্বী ও নিতম্বিনী তাকে মুগ্ধ করে। কারো প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়ে কাপড়ের দাম কম নেয়। কাউকে বিনামূল্যে উপহার স্বরূপ দান করে এবং দানের বিনিময়ে প্রতিদান পাওয়ার আশা করে।

দুধের মাছি বন্ধুরা তার দোকানে আড্ডা জমায়। দোকানের টাকা ভেঙ্গে বন্ধুদের মন প্রীত করে। স্তাবক তোষামুদে মানুষের পাল্লায় পড়েও অনেক টাকা নষ্ট করে সে। বন্ধু-বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে বাস-স্ট্যাণ্ডস্থ হলের কোন নতুন বই বাদ পড়ত না।

যার ফলে দোকানের লভ্যাংশ হ্রাস পেতে থাকে। কত টাকা ক্রেতাদের কাছে ঋণ পড়ে থাকে। দোকানের মাল কম হতে লাগে।

যে জ্ঞানী অপরের দেখে শিক্ষা নিতো, সে জ্ঞানীর জ্ঞান হারিয়ে গেল। এক সময় তার দোকান বসে গেল।

আবার কোমর সোজা করে দাঁড়াবার চেষ্টা করল রাজীব। তার ছোট খালুজান বাজারের ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। সে স্থির করল, তাকে বলে ব্যাঙ্ক থেকে এক লক্ষ টাকা লোন নিয়ে নতুনভাবে বড় ক'রে দোকানটাকে চাঙ্গা ক'রে তুলবে।

কিন্তু আবেদন-পত্র লেখার সময়ে কোন কোন বন্ধু তাকে তাতে বাধা দিল। তারা বলল, 'যদি তার পরেও তোর দোকান সচল না হয়„তাহলে তুই আর জীবনে কোমর সোজা করে উঠে দাড়াতে পারবি না।”

সত্যিই তাই। সুতরাং এ পরিকল্পনা পরিহার ক'রে আবারও বড় খালুজান কর্নেল সাহেবের দরজায় কড়া নাড়ল। দিল্লি গিয়ে তার চাকরি ক'রে দেওয়ার কথা ছিল।

তিনি তাঁর সেই কথা রক্ষা করুন। কিন্তু তিনি টালবাহানা করে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। অবশ্য তিনি একটা নতুন প্রস্তাব দিলেন।

তার খালুরা জানতেন, রাজীব বড় সফল ব্যবসায়ী। সুতরাং তাকে দিয়ে তারা ব্যবসা করবেন। কিন্তু সে হবে দোকানের বেতন-ভোগী কর্মচারী। পুরো লাভ ভোগ করবেন তারা। চাকরি করে দিলে তাদের স্বার্থ রক্ষা হবে না।

জেনে এই প্রস্তাব মেনে নিতে তারা তার উপর চাপ প্রয়োগ করতে লাগলেন। কিন্তু রাজীব সে স্বার্থপরতাপূর্ণ দুরভিসন্ধির কথা বুঝতে পেরে অপমানে, রাগে, দুঃখে ও ঘৃণায় একবাক্যে তা প্রত্যাখ্যান ক'রে দিল।

কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হবে কীভাবে? আব্বা এখনও ছোট গুমটি নিয়ে ব্যবসা করে। তার প্রস্তাব হল, সে ফেরিওয়ালা হয়ে কাপড়-ব্যবসা করুক। কিন্তু তাতে হয়তো তার পেট চলবে, কিন্তু রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন যে বাস্তব হবে না।

অর্থ অপচয় ক'রে কত বড় ভুল সে করেছে, তার মাসুল দিতে হবে আগামী জীবনে। অথচ মূল জীবনের প্রারম্ভও তো এখনও দেখেনি সে।

রাজীবের আরো একটা ভাল দিক, সে নিরাশাবাদী নয়। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেও সে নিজের উদ্যম হারায় না। যে বিফলতা তাকে শিক্ষা দিয়েছে, তাই হয়তো আবার তার জীবনে সফলতার দ্বার উন্মুক্ত ক'রে দেবে। আর তারই অনুসন্ধানে থাকল সে।

বহুদিন পর গ্রামের এক ইমাম সাহেব এসেছেন বড় সুন্দর। পাশ করা আলেম। তবে ফাযেল-টাইটেল দিলে তার বড় চাকরি হবে, হাই স্কুল অথবা হাই মাদ্রাসায় চাকরি পাবেন তিনি, অনেক বেতন হবে তার।

তাছাড়া গলার সুর-সার খুবই ভাল। মীলাদও পড়েন বড় সুন্দর। লোকটির ভাষায় আকর্ষণ আছে, ব্যবহারে মাধুর্য আছে, চরিত্রে সৌন্দর্য আছে। কয়েক মাসের ভিতরে গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে মুগ্ধ ক'রে তুললেন। মসজিদের মকতবে কুরআন শিক্ষার ধুম পড়ে গেল। ছেলে-মেয়ে-সহ বুড়োরাও তাঁর..

কাছে কায়দা-আমপারা পড়তে, কুরআন শিখতে লাগল।

গ্রামে পর্দা নেই। ইমাম সাহেব পাড়ায়-পাড়ায় ঘরে ঘরে ঘুরতে পারেন, ঢুকতে পারেন। এই সুবাদে কিছু মহিলা তাঁর ভাবী, কিছু তাঁর নানী, কিছু তার খালা ইত্যাদি সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে লাগল।

বাড়িতে বাড়িতে পালা ক'রে খানা খান ইমাম সাহেব। কেউ পৌঁছে দিয়ে যায় মসজিদে, যার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ নেই, তার বাড়িতে নিজে গিয়ে যেয়ে আসেন তিনি। দ্বীন-দরদী মুসলিম সমাজ আলেম পছন্দ করে। তাঁকে 'সৎলোক' বলে

অনেকে আদর-যত্ন ক'রে খাওয়ায়, কেউ খাওয়ায় আল্লাহর ওয়াস্তে, কেউ

খাওয়ায় অন্য কোন আশায়। যার বাড়িতে বিবাহযোগ্য কন্যা আছে, তার বাড়িতে পালা পড়লে মৌলবী

সাহেব খেতে পান জামাই আদরে।

অবশ্য মৌলবী সাহেবের আরো একটা আকর্ষণীয় দিক আছে, তিনি ছবি আঁকতে পারেন। ফুল-ফল, গাছ-পালা, লতা-পাতা ইত্যাদি এঁকে দিয়ে মহিলা মহলে তিনি বেশ বড় পরিমাণ জায়গা দখল ক'রে নিয়েছেন।

মসজিদে মেয়েরা যখন পড়তে আসে, তখন অনেকে সঙ্গে সাদা কাপড় নিয়ে আসে। কেউ রুমাল করার জন্য, কেউ বালিস-কভার করার জন্য ফুল আঁকিয়ে নিয়ে যায় উস্তাদজীর নিকট থেকে। অবশ্য তার জন্য তিনি পৃথক পারিশ্রমিকও পান। অবশ্য যে দেয় না বা দিতে পারে না, তিনি তার কাছে চেয়ে নেন না।

তিনি এক প্রকার ডাক্তারও। তিনি তাবীয ও ঝাড়ফুকের মাধ্যমে বহু রোগের চিকিৎসাও ক'রে থাকেন। আর তাতেও তিনি অর্জন করেছিলেন ভাল খ্যাতি।

সুমধুর ব্যবহারের কারণে যুবকরাও তার কাছে ভিড় জমায়। এক সাথে খাওয়া-দাওয়াও করে অনেকে। অনেক সময় চাঁদা তুলে মসজিদের মক্তবে চড়াইভাতিও ক'রে আনন্দ উপভোগ করে সকলে।

কিন্তু এমন রান্না-বান্না মসজিদ চত্বরে বেশি হতে লাগলে কিছু মুরুব্বীর চোখে খারাপ ঠেকতে লাগল। একজন তো বলেই ফেলল, “ওহ! তোমরা দেখছি মসজিদটাকে হোটেল বানিয়ে ফেলবে।' অবশ্য ইমাম সাহেবকে কিছু বলতে হয়নি। যুবকরাই তার জবাব দিয়ে..নিল।

একদিন যোহরের নামাযের পর এক শিক্ষিত যুবক ইমাম সাহেবের রুমেই বসে ছিল। এমন সময় পালি-বাড়ির ভাত এল। যুবক বলে উঠল, "আপনাদের কী মজা! যথাসময়ে খানা এসে হাজির। মৌলবী সাহেব বললেন, "আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি তাঁর দ্বীনের খাদেমদেরকে এইভাবে রুযী দান করেন। '

---আপনাদের সম্মানও জামাইয়ের মতো।

অতঃপর দু'জনেই হেসে উঠল। খাবারের খাঞ্চা ঢাকা ছিল একটা তোয়ালে দিয়ে। সেটা তুলতেই ইমাম সাহেব দেখলেন তার এক পাশে মুরগীর বিষ্ঠা লেগে আছে!

ইমাম সাহেব বললেন, 'এই দেখুন ভাইজান, ইমাম সাহেবের সম্মান!

নোংরা তোয়ালে ঢেকে ভাত পাঠিয়েছে।'

---ইস! ছিঃ ছিঃ! বাড়ির মহিলা সম্ভবতঃ কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় তাড়াহুড়া ক'রে দিয়ে পাঠিয়েছে। অথবা মোটা হুঁশের মেয়ে আছে। ---অনেক মেয়ে নোংরাও হয়। অনেক বাড়ি থেকে খানা আসে, তাদের প্লেটগুলোও ঠিকমতো ধোয়া থাকে না।

--সব বাড়ি তো সমান নয় সাহেব!

---তাহলে বুঝতে পারছেন তো, সবারই কাছে আমরা 'জামাই আদর' পাই না। এমনও মানুষ আছে, যে ইমাম সাহেবকে ভাত দিতে চায় না। সমাজের চাপে বদনামের ভয়ে ভাত দিতে বাধ্য হয়ে দেয়। অনেকে নিজের গাছের প্রথম ফলটি ইমাম সাহেবকে খাওয়ায়, কিন্তু অনেকে যেটা খেতে পারে। না, সেটা দিয়ে পাঠায়। একটা গল্প শুনবেন?

---শোনান, শোনান।

---এক গ্রামে এক ইমাম সাহেব ছিলেন। একদিন সকালে এক ছয়-সাত বছর বয়সের ছাত্রী তার জন্য দুধ নিয়ে এল মাটির হাঁড়িতে। ইমাম সাহেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী এনেছ তুমি হাঁড়িতে?'

মেয়েটি আমতা আমতা ক'রে বলল, 'ডী দুধ, দাদী বলল, মৌলবী সাহেবকে দিয়ে আগা।' ইমাম সাহেব বললেন, "কার মেয়ে তুমি?' বলল, 'কারীমুলের।' ইমাম সাহেব বললেন, "তো তোমাদের বাড়ির লোক তো আমার পালিও নেয় না। কোনদিন কিছু হাদিয়াও পাঠায় না, তো আজ আবার তোমার দাদী দুধ দিয়ে

পাঠাল কী ব্যাপার?' মেয়েটি কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সে বলতে গিয়ে থেমে গেল। ইমাম সাহেবের মনে সন্দেহ হল। তিনি ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে মেয়েটিকে বারবার জিজ্ঞাসা করলে সে ভয়ে ভয়ে বলেই দিল, 'জী! দাদী বলতে বারণ করেছে।' ইমাম সাহেব তাকে অভয় দিয়ে বললেন, 'তোমার কোন ভয় নেই। সুইটি বোনটি আমার! বল তো কী ব্যাপার?' তখন মেয়েটি বলল, 'জী! দুধটা চুলোশালে রাখা ছিল।

নিয়ে কুকুরে মুখ দিয়ে দিয়েছে। তাই মাটির হাড়িতে ঢেলে দিয়ে দাদী বলল, এতগুলো দুধ ফেলে দিবি, মৈলিবীকে দিয়ে আসগা।' মৌলবী সাহেব কী এত বড় অপমান হজম করতে পারেন? রাগে হাঁড়িটি উপর দিকে তুলে 'দুম' ক'রে মেঝেয় মারলেন। আর অমনি তা ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গেল এবং দুধ গড়িয়ে নর্দমায় পড়ল।

তা দেখে মেয়েটি সশব্দে এ্যা-এ্যা' ক'রে কাঁদতে লাগল। ইমাম সাহেব বললেন, 'তুমি কাঁদছ কেন?' বলল, 'আমাকে দাদী মারবে। আপনি হাড়িটা ভেঙ্গে দিলেন কেন?' ইমাম সাহেব বললেন, 'কেন? হাড়িটা কী এমন কাজে লাগত, মাটির পুরনো হাঁড়িই তো।' মেয়েটি কাদতে কাদতেই আধা-আধা শব্দে বলল, 'রাতের বেলায় ওই হাড়িতে আমার দাদী মুতত!'

গল্প শুনে যুবক হেসে গড়াগড়ি দিল। ইমাম সাহেব বললেন, 'আমি

আপনাকে দুঃখের ঘটনা শুনালাম। আর আপনি এইভাবে হাসছেন?” ---না, না। এ বানানো গল্প।

---হতে পারে, কিন্তু ঘটনার উপমা বাস্তব।

---কিন্তু এও তো বাস্তব যে, অনেক ইমাম সাহেব নিজের সম্মান বজায় রাখতে জানেন না। অনেকে মহিলা-ঘটিত চক্রান্তের খপ্পরে পড়ে নিজের মান-মর্যাদা হারিয়ে বসেন।

---তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

কিছুদিন গত হতেই ইমাম সাহেব সেই শ্রেণীর ফাদে পড়তে ও বাঁচতে লাগলেন। একদিন সকালের চায়ের সাথে দেওয়া মুড়ির ভিতরে দেখেন একটি পত্র আছে। সেটি ছিল পালি-বাড়ির এক যুবতীর পাঠানো প্রেমপত্র!

অনেক কিশোরী ইমাম সাহেবের খিদমতে মন-প্রাণ দিয়ে হাজির থাকে। *আপনার রুমটা পরিষ্কার ক'রে দেব জী? কলসীতে ঠাণ্ডা পানি এনে দেব

জী? আপনার জামাটা কেচে দেব জী?' ইত্যাদি। পড়াবার সময়ও তিনি কিছু যুবতীর ভাবে-ভঙ্গিতে ঐ শ্রেণীর আকর্ষণ....

লক্ষ্য করেন। মোবাইলেও ম্যাসেজ আসে একই আবেদন নিয়ে। কেউ আবার তার নাম লিখে রুমাল ক'রে উপহার দিয়ে পাঠান। অনেক অভিভাবক নিজ কন্যার সাথে প্রণয়-সূত্রে আবদ্ধ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে 'প্রাইভেট- টিউটর' হিসাবে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন, যাতে বিনা পণে বিয়েটা লেগে যেতে পারে।

বাস্তব এটাই যে, অবিবাহিত কোন যোগ্য যুবক হলে বিবাহের আগে পর্যন্ত তার মান বেশ উচ্চ থাকে এ যুগে মেয়ের বাবাদের কাছে। বিশেষ ক'রে সেই যুবকের, যে বিনা পণে যৌতুক না নিয়ে বিয়ে করবে বলে ধারণা করা হয়।

রাজীবের বোন ইমাম সাহেবের কাছে পড়ার সুযোগ পায়নি। যেহেতু সে প্রথমতঃ কুরআন পড়তে জানত, আর দ্বিতীয়তঃ যে বয়সের যুবতীরা মসজিদে গিয়ে কুরআন পড়ে, তাদের তুলনায় তার বয়স কিছু বেশি হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু আরো পাঁচজন মেয়ের বাবার মতো রাজীবের আব্বারও বড় ইচ্ছা ছিল, ইমাম সাহেব তাদের জামাই হন। ইমাম সাহেবের সাথে রাজীবের খাতিরও ছিল ভাল। তিনি বাড়িতে আসা-যাওয়াও করেন। অনেক সময় তিনি রাজীবের দোকানে গিয়ে বসেও থাকেন।

মনের অব্যক্ত কথাটি একদিন আব্বা রাজীবকে বলেও ফেলল। কিন্তু সে কীভাবে ইমাম সাহেবকে প্রস্তাবটা দেবে, তা ঠিক ক'রে উঠতে পারছিল না। একদিন কথা প্রসঙ্গে ইমাম সাহেবই একটি বিয়ের প্রস্তাব সম্পর্কে তার পরামর্শ নিতে কথা তুললেন। সেদিনই রাজীব তাদের মনের কথাটি ইমাম সাহেবকে জানিয়ে দিল।

ইমাম সাহেব মহা দ্বন্দ্বে পড়লেন। কয়েকটি বাড়ি থেকে একই প্রস্তাব। এখন তিনি কোনটি ছেড়ে কোনটি গ্রহণ করবেন। বিচারের মনে তিনি গরীবদের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

অতঃপর ধনীদের মধ্যে রাজীবের প্রস্তাবকে প্রাধান্য দিলেন। কারণ প্রথমতঃ তার বোন সুন্দরী এবং আখলাক-চরিত্রে ভাল। দ্বিতীয়তঃ প্রায় দুই বিঘা জায়গার উপর তাদের পাকা বাড়ি, কল-বাথরুম ও বাগান আছে। জমিও আছে অনেকখানি। তার সাথে উঠতি মুখে তাদের ব্যবসা। ভেবে-চিন্তে তিনি রাজীবের সাথেই....আলেম জামাই পেয়ে খুশী হল তার আব্বা-আম্মা, খুশী হল সে নিজেও।

বড় হওয়ার স্বপ্ন আত্মীয়তায় জড়িয়ে পড়লেন। টাইটেল পরীক্ষার পরেই বিয়েটা সেরে নিলেন।

কিন্তু বছর ঘুরতেই তার বোন নাখোশ হয়ে গেল। এক রাত্রে স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটি হতে হতে সে বলেই ফেলল, 'শুনেছিলাম, মৌলবীরা মেয়েলোভী হয়। আমি জানি সে কথা সর্বাংশে সত্য নয়, তবে আপনার ব্যাপারে তা সত্য বলে মনে হয়।'

স্বামী বলল, 'ওরা আমার কাছে এলে আমি কী করতে পারি? ---আপনি প্রশ্রয় দেবেন না, আপনি ইমাম সাহেব হিসাবে তাদেরকে

নসীহত করবেন। এভাবে পর মেয়েদের সাথে ঢলাঢলি করা কি হারাম নয়? ---মেয়েরা অপর মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলেই স্বামীকে সন্দেহ করে।

--মন্দে পৌঁছনোর আগেই সন্দেহ করাটাই ভাল।

নিছক সন্দেহই নয়, বাস্তব স্বামীর বাহ্যিক চরিত্রের বিপরীত ছিল বলে ভালবাসার বুকে আঘাত হানল। আদর্শ স্বামী হিসাবে তার প্রতি যত শ্রদ্ধা ও প্রেম ছিল, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এবার তো কলহ স্বাভাবিক।

তাছাড়া ইমাম সাহেব আরো একদিন জানতে পারলেন যে, যে ঘর-বাড়ি ও জমি-জায়গা তিনি দেখেছেন, তার মালিক রাজীবরা নয়। আর সেদিন থেকেই তারও মন থেকে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ দূরীভূত হতে লাগল।

রানীর সাথে অর্ধেক রাজত্ব পাওয়ার যে আশা বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলেন, যেহেতু তা পূরণ হওয়ার নয়, সেহেতু এমন মায়া-মরীচিকায় লাভ কী? যে ভালবাসার পশ্চাতে অর্থ নেই, সে ভালবাসা সার্থক নয়। যে বন্ধনের রশি টাকা নয়, সে বন্ধন টিকে না বেশি দিন। যে সম্পর্কের পিছনে সম্পদ নেই,

তার সম্পাদন অতি সহজেই হয়। সুতরাং দুই বৎসর পর ইমাম সাহেব গ্রাম ছেড়ে পলায়ন করলেন। আর নানা বিপদের মাঝে বোনও এক বিপদ হয়ে রাজীবের গলগ্রহরূপে বাড়িতে চলে এল।

রাজীবের বাড়ির লোক পস্তাতে লাগল। আলেমদের প্রতি বিগড়ে গেল তাদের মতো ভাল মানুষদের সুন্দর মন। বদনাম হতে লাগল পুরো আলেম সমাজ। গ্রামের দুই-এক জন লোক চোর হয়, 'চোর-গ্রাম' বলে বদনাম হয় পুরো গ্রামেলা। এটাই মনুষ্য-রীতি।

এখন শুধু স্বপ্নই নয়, এখন তাকে বাস্তবের জন্যও লড়াই করতে হবে। বাঁচার লড়াই লড়তে হবে। তার মনে হল, পুরো জীবনটাই যেন পাথরে ভর্তি। আর সেই পাথর ভেঙ্গে মহল নির্মাণ করতে হবে।

স্বার্থপর বন্ধুরা তার ফুলের মধু চুষে খেয়েছে, বন্ধু বেশে আপন করা আদর্শবান লোকেও তাকে ধোঁকা দিয়েছে, এখন তাকে আরো শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু কী অবলম্বন ক'রে দাঁড়াবে সে?

সব বন্ধু যেমন বন্ধু নয়, তেমনি সব বন্ধু স্বার্থপরও নয়। নাজিব নামের এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দিল, সে বাংলার বাইরে চলে যাক। বাইরে অনেক কাজ আছে, পয়সাও আছে।

অথচ অনেক মানুষ মা বা বউয়ের আঁচল ধরে ঘরে বসে থেকে দুঃখে জীবন-যাপন করছে। -কিন্তু মা-বাপ বা বউ-সন্তানকে দেখা কি কর্তব্য নয়?

--টাকা ছাড়া সে কর্তব্য পালন হয় না রাজীব। তাছাড়া তোর আব্বা তো এখন বৃদ্ধ হয়ে যায়নি। সে একটা ছোট ব্যবসাও করে। সে কোন রকম সংসার চালিয়ে নিতে পারবে। তারপর সেখান থেকে টাকা পাঠাবি, মাঝে-মধ্যে বাড়ি আসবি, তাতে তারা আরো খুশী হবে রে!

---কিন্তু যাব কোথায়? ---আমার দু'-দু'টো ভাই দিল্লিতে কাজ করে। তুই সেখানে তাদের কাছে

গিয়ে ওঠ। কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ভারতের রাজধানী দিল্লি। সেখানে আরো কত বাঙালী কাজ করে। কেউ করে সোনার কাজ, কেউ করে পাথরের। যার যেমন যোগ্যতা, যার যেমন ভাগ্য, সে তেমন কাজ নিয়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

ব্যবসার ঘুম চোখে নিয়ে সে স্বপ্ন তো ভেঙ্গে গেছে। এখন মেহনতের ধুম ও ঘুম নিয়ে সে স্বপ্ন বাস্তব হয় কি না দেখা যাক।

একদিন আল্লাহর নাম নিয়ে মা-বাপ ও বোনের নিকট বিদায় নিয়ে রাজীব বেরিয়ে পড়ল অচেনা পথে অজানা কর্ম-জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সফলতার.....সন্ধানে। বর্ধমান থেকে দিল্লি প্রায় চব্বিশ ঘন্টার পথ।

ধর্মঘট, রাজনৈতিক রেল অবরোধ, পকেটমারি, জ্ঞানশূন্য ক'রে সর্বস্ব লুঠ ইত্যাদির আশঙ্কা বুকে রেখে কালকা মেল ট্রেন ধরল সে। রিজার্ভিশন ছাড়া চালু ডিব্বাতে চড়ে যাত্রীদের সাথে লড়তে লড়তে সফর শেষ করল। রাত্রি ৯টার দিকে দিল্লি পৌঁছলে স্টেশন থেকে অটো-রিক্সা ধরে ঠিকানায় পৌঁছল।

এখন এল নতুন পরীক্ষার পালা। শহরের ঠাসা ভিড়ে ভ্যাপসা গরমে তার দম বন্ধ হতে যাচ্ছিল। তার চাইতে বড় মুশকিল হল, যে রুমে তার ঠাই হল, সে রুমে কোন রকম পাঁচজন থাকা যায়।

কিন্তু তাকে নিয়ে ছয়জন লোক সেখানে রাত্রিবাস করবে কীভাবে? খাওয়ার কাজ সেরে নিয়ে শোবার সময় সবাই চাপাচাপি ক'রে শুয়ে পড়ে ঘুমিয়ে গেল। তার আর ঘুম হল না।

এখানে বহু লোকের নিত্য-জীবন-ধারা এমনই। সব জায়গায় চাপাচাপি, ঠাসাঠাসি, রেষারেষি। বাথরুমেও লাইন দিতে হয়। অনেকে ভিড় থেকে বাচতে কাঠ-টিন দিয়ে ছাদের উপর ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করে। অবশ্য তাতেও টিভি থাকে।

বড় কষ্টের মধ্যে রাজীবের দিনরাত হয়। কাজের খোঁজ করে, কাজ পায় না। সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। ফোন ক'রে জানা গেল বোন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু টাকা-পয়সা খরচ হয়েছে এবং তার জন্য ঋণ করতে হয়েছে। সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজতে লাগল।

নাজিবের ভাই দু'টিও তারই মতো। তারাও আন্তরিকভাবে অনেক খোঁজাখুঁজি ক'রে দেখল। তাদের অনেক বন্ধু- বান্ধবকেও সন্ধান দিতে বলল। কিন্তু কোথায়?

পনের দিন পার হয়ে গেল, কাজ হাতে এল না। আশাবাদী রাজীব তবুও নিরাশ হল না। পরের দিন সন্ধ্যায় এক গেঞ্জি তৈরীর কারখানায় একটা কাজের খবর পাওয়া গেল আল-হামদু লিল্লাহ।

সেখানে উপস্থিত হয়ে যোগাযোগ করতেই নিয়োগ-প্রাপ্তির আশা পাওয়া

গেল। হতাশার অন্ধকার দূরীভূত হল রাজীবের অটল-পাহাড়ের মতো মন

থেকে। কাজ তো আরামের, কিন্তু বেতন মাত্র হাজার টাকা। ম্যানেজার বিহারী। সে মস্ত বড় এক গপে। 'আমার চাচা অমুক অফিসার।

আমার মামা অনুক,,,,এম.এল.এ। আমার খালা অধ্যাপিকা ইত্যাদি। কথায় কথায় রাজীবও পালা দিতে আরম্ভ করল। অবশ্য তার কথায় ম্যানেজার তাকে ঢপবাজই মনে করল।

কাজের তালে তালে নানা গল্প করলে কাজেও বিরক্তি আসে না। তাই

ম্যানেজার ঢপ-মার্কা গপ মেরে সকলকে এক প্রকার মাতিয়ে রাখার চেষ্টা

করত। একদিন বিকালে সেসব কথাই চলছিল তাদের মাঝে। এমন সময় দু'জন আর্মি অফিসে প্রবেশ করল। ম্যানেজার-সহ সকলে অপ্রস্তুত অবস্থায় হতভম্ভ হয়ে পড়ল। কী ব্যাপার?

একজন আর্মি জিজ্ঞাসা করল, "এখানে রাজীব নামে কেউ আছেন নাকি? রাজীব তো আজিব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ম্যানেজারই

উত্তর দিয়ে বলল, 'হ্যাঁ স্যার! কী ব্যাপার? ঐ যে ঐ ছেলেটা।” রাজীব উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এল। অবশ্য অপরাধীর মতো তার মনে ভয়

ছিল না। বলল, "আমিই রাজীব স্যার।'

আর্মি বলল, 'কর্নেল সাহেব আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে

চলুন।' রাজীব বুঝে গেল, তার খালুজানই হবেন। জিজ্ঞাসা করল, 'তিনি কোথায়?'

আর্মি বলল, 'পুরনো দিল্লিতে।'

ম্যানেজার যাওয়ার অনুমতি দিলে আর্মির গাড়িতে চড়ে খালুজানের কাছে

গিয়ে উপস্থিত হল। -কী ব্যাপার! আমাকে কিছু না জানিয়েই দিল্লি চলে এলে?

---কী করব? ভাগ্য টেনে নিয়ে এল। আর আপনি এখানে? আমার ঠিকানা পেলেন কীভাবে? --হ্যাঁ, বাড়িতে তোমার খবর ও ঠিকানা পেলাম। এখানে বদলি হয়ে

এসেছি। ভাবলাম, তোমার সাথে একবার দেখা করি।

রাজীব ফ্লাটে গিয়ে খালার সঙ্গে দেখা করল। তারা সকলেই খুব ভালভাবেই তার আপ্যায়ন করল। চাকরির ঘুমিয়ে পড়া আশা আবার তার মনে পুনর্জাগরিত হল।

বেতন যেহেতু অল্প, সেহেতু তলে তলে খোঁজ ছিল অন্য কাজের।

এক দৈন্য যদি আসে আসুক লজ্জা কিবা তাহে?

সময় রাজীব মারুতির পার্টস তৈরীর ফ্যাক্টরিতে কাজ নিল। বেতন বেশি ছিল, কিন্তু কাজ ছিল বড় কষ্টের। কষ্ট না করলে তো ইষ্ট মেলে না।

সে টাকার জন্য তাই করতে লাগল। কাজ করতে করতে তার হাতে ফোস্কা পড়ে যেতে লাগল। একদিন হাতের সেই ফোস্কা খালা- আম্মাকে দেখিয়েও এল।

কিন্তু চাকরির ক'রে দেওয়ার ব্যাপারে মুখ খুলতে পারল না। মুখ-চোরামি হয়তো তাকে বাধা দিত নিজস্ব স্বার্থের কিছু বলতে। স্কুলে ভাব-সম্প্রসারণের একটি কবিতা সে বারবার আবৃত্তি করত,

মাথা উঁচু রাখিস, সুখের সাথী মুখের পানে যদি নাহি চাহে ধৈর্য ধরে থাকিস।"

তাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে হয়তো কারো নিকট ছোট হতে চাইত না। যদিও খালা মায়ের মতোই, তবুও সব খালা তো মায়ের মতো হতে পারে না। খালারা বিয়ের আগে তাকে খুব আদর-স্নেহ করত, আব্বাকেও যথার্থ শ্রদ্ধা করত; বরং ভালও বাসত।

কিন্তু তারা যখন বিয়ের পরে ধনী স্বামী পেয়ে বেড়া পার হয়ে গেল, তখন কি আর পিছন দিকে তাকানোর অবসর ছিল? অস্থিতিকালে যে আদরের 'দোলাভাই' ছিল, স্থিতিকালে সে "ভোলাভাই' হয়ে গেল। দুনিয়ার রীতি এটাই, নদী পার হয়ে মাঝি 'শালা' হয়।

যদিও রাজীব জানে না, তার চাকরি না ক'রে দেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোন অসুবিধা আছে কি না। কিন্তু সে ধারণা করে যে, খালুর ক্ষমতা আছে, অথচ তিনি ইচ্ছা করেই ক'রে দেন না। আর তার জন্যই সে তার কাছে ছোট হতেও চায় না।

ফ্যাক্টরিতে তার কষ্ট হচ্ছিল। টাকার খাতিরে তা সহ্য ক'রে নিচ্ছিল। বাড়িতে জানতে পারলে আব্বা-আম্মা-বোন সকলেই রাজীবকে ঐ কাজ করতে নিষেধ করল। যেহেতু তার কষ্টে তারাও কষ্ট পায়, আর সে কষ্ট তাদেরই জন্য।

সুতরাং কিছুদিন পর সে এক বন্ধুর সাথে একটা পুতুল ফ্যাক্টরিতে কাজের খোঁজে গেল। দিল্লিতে বাঙালী মালিকানায় বড় বড় পুতুল ফ্যাক্টরি আছে।

সেই সব মালিকরা বড় বড় বিল্ডিং বাড়ি ও গাড়ির মালিক। তবে তারা যে ফ্যাক্টরিতে গেল, তার মালিক মাড়ওয়ারী। সেখানে গিয়ে এক বাঙালী কর্মীর...সঙ্গে পরিচয় হল, তার নামও রাজীব। মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বললে

মালিক জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি কি হিন্দি লিখতে-পড়তে জানো??

--জানি স্যার। -কত বয়স তোমার?

---উনিশ বছর। মালিক অবাক হয়ে তার কোম্পানির রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"দেখছ, ওর এখনও মোছও বের হয়নি, আর বয়স উনিশ বছর হয়ে গেছে।'

এ কথার উত্তরে রাজীবের বন্ধু বলল, 'স্যার! ও শৈশব থেকেই ঐ রকমই আছে।'

মালিক হাসতে হাসতে বলল, 'তোমাদের গ্রামের ছেলেদের শৈশব থেকেই মোছ গজায় বুঝি?” তার কথা শুনে সকলে হাসতে লাগল। আর সেই সাথে রাজীব কাজটাও

পেয়ে গেল। সেখানে তার বেতন হল চৌদ্দ শত টাকা। মূর্তি ও পুতুল তৈরির কাজ ইসলামে বৈধ নয়। তা না জেনেই রাজীব

সেখানে কাজ নিল। সে কাজে সে সুনামও নিতে লাগল। কাজে পারদর্শী হয়ে উঠলে মালিক তার বেতন আঠার শত টাকা ক'রে দিল।

পুতুল ফ্যাক্টরিতে কাজ নেওয়া এক মাস অতিবাহিত হল। এ যাবৎ সে বাড়িতে খোঁজ নিতে পারেনি। মন তো অবশ্যই কাদে। আম্মার জন্য প্রাণ কাদে, আব্বার জন্যও কষ্ট হয়, বেশি কষ্ট হয় স্বামীহারা স্নেহময়ী বোনটার জন্য।

নিজের প্রিয়তমা যেহেতু কেউ নেই, সেহেতু সমস্ত ভালবাসা পাওয়ার একচ্ছত্র অধিকারী তারাই। অবশ্য তার মনটা বড় আবেগময়। তাই তাদের কথা মনে পড়লেই নিজের অজান্তে তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে!

সাইকেল চড়ে ফ্যাক্টরি থেকে বাসায় ফিরার পথে বাড়ির কথা মনে মনে ভাবছিল। ভাবছিল আজ সন্ধ্যায় সে ফোন করবে। কিন্তু সিঁড়িতে উঠেই দেখে, বারান্দায় চেয়ারে একটা লোক বসে আছে, ঠিক যেন তার আব্বার মতো।

নাকি সেই তার আব্বা। ভাবল, আব্বা এখানে কীভাবে ও কেন

আসবেন? ভালভাবে তাকিয়ে দেখতেই আওয়াজ এল, 'বেটা কেমন আছ?" সন্দেহের বেড়া ভেঙ্গে গেল। মনের পুলকে সে উত্তর দিল, 'ভাল আছি। আপনি? আপনি এখানে কীভাবে এলেন? ভাল আছেন তো? মা-বোন সবাই ভাল আছে তো?'

---হ্যাঁ, সবাই ভাল আছে।

---আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ কেন এলেন আব্বা? ---তোমার সাথে শেষ দেখা করতে এলাম বাবা!

--'শেষ দেখা' মানে?

---আমি সংসার ত্যাগ ক'রে এসেছি, বাকী জীবনটা আজমীর শরীফে কাটিয়ে দেব

---আর মা, বোন?

---তুমি ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব তোমার ছোট মামা নিয়েছে। রাজীব যেন আকাশ থেকে পড়ল। আব্বা ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু ধার্মিক হওয়ার মানে তো সংসার ত্যাগ নয়। তাহলে মায়ের সাথে কিছু হল নাকি? তার বয়স তত বেশিও হয়নি। তাহলে এখন থেকে সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত

নিলেন কেন? রাজীব আবার জিজ্ঞাসা করল, 'সংসারে কি অভাব চলছে আব্বা? আব্বা! আমি খেতে পেলে আমার আম্মা-আব্বা সবাই খেতে পাবে। সংসারে কি খাবারের অভাব আছে?'

---না, না। আমি খাজা গরীব নেওয়াযের সান্নিধ্যে থেকে মরতে চাই। ---তাতে লাভ কী?

---সে তুমি বুঝবে না। তুমি আমাকে তোমার খালার বাসায় নিয়ে চল। খালার বাসায় গিয়ে কী সব পরামর্শ ক'রে খালুজান রাজীবকে বললেন, "রাজীব! তুমি তোমার আব্বার সাথে আজমীর চলে যাও। ভাই তো হিন্দী জানেন না। কোথাও হারিয়ে যেতে পারেন।

রাজীব ফোন ক'রে মালিকের কাছ থেকে ছুটি চেয়ে নিল। খালার বাড়িতে গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া ক'রে বাসায় এসে জামা-কাপড় নিয়ে আব্বার সঙ্গে বের হয়ে গেল নিযামুদ্দীন আওলিয়ার দর্শায়। কারণ সেখানে আগে না গেলে আজমীর যাওয়ার ফল নাকি পাক্কা হয় না। সুতরাং সেখান থেকে

স্টেশন বের হয়ে গেল।

টেনে তার মনে পুলক ছিল, গায়ে ধরে না এমন আনন্দ ছিল। এক সময় পৌছে গেল আজমীরে, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর মাযারে। আব্বার মনে যেমন এই জায়গার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি ছিল, তেমনি

রাজীবের মনেও ছিল, তবে ততটা নয়। দ্বীনদারীতে রাজীব তখনও কাঁচা।

অবশ্য যে যা বলে, তাতে তার বিশ্বাস করতে বাধে না।

মাযার চত্বরে লোকারণ্যে পৌঁছে রাজীব নিজেকে কত বড় সৌভাগ্যবান কল্পনা করতে লাগল। এই সেই জায়গা, যেখানে এলে নাকি হজ্জ হয়ে যায়। গরীব আর কি মক্কা যেতে পারে? গরীবের হজ্জটা হয়ে যাবে এখানেই। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে?

রাজীব ও তার আব্বা মিলে যা দেখল, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।

মুসলিম-অমুসলিম সকলের সমাগম।

মাযারের পাশে বাজনা-সহ ভক্তি-গীতি ও কাওয়ালী গাওয়া হচ্ছে। নারী-পুরুষ মিলে কবরকে সিজদা করা হচ্ছে।

খাজা বাবার কাছে মনের আশা পূরণ কামনা করা হচ্ছে। কত রকমের নযর-নিয়ায় ও উপঢৌকন পেশ করা হচ্ছে। খাজা বাবার নামে মীলাদ পাঠ করা হচ্ছে।

ফুল ও চাদর চড়ানো হচ্ছে, আগরবাতি জ্বালানো হচ্ছে। মাযারের তবরুক ও দুআ গ্রহণ করা হচ্ছে।

সে জায়গা অতি পবিত্র মনে ক'রে অতিশয় সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে। ফিরে বের হওয়ার সময় পিছু পায়ে বের হচ্ছে।

বিনামূল্যে অন্ন বিতরণ করা হচ্ছে।

যে ডেগে রান্না হয়, সেটা খালি থাকার সময় তাতে যে যা পারছে দান করছে।

দানবাক্সেও দানের টাকা রাখা হচ্ছে।

মাযারের আশে-পাশে ফুল, চাদর ও সিন্নীর দোকানের জমজমাট।

চত্বরের এক পাশের ছাউনিতে গাঁজার ধোঁয়া উড়ছে এবং সেখানে 'যিগির'

হচ্ছে। মাযার থেকে অনাসাগর এবং সেখান থেকে পাহাড়ের উপর অন্য এক মাযার যিয়ারত ও দর্শন করল। প্রত্যেক স্থানে নানা প্রকার কল্যাণ কামনা করল।

রাজীব যা দেখল, তার সবটাতে বিশ্বাস করতে পারল না। বিশেষ ক'রে সে নিশ্চিত হল যে, এই সব স্থানে কিছু অসাধু লোক রয়েছে, যারা অসদুপায়ে মানুষের অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছে।   সকালের দিকে পৌছনোর পর সন্ধ্যাবেলায় আব্বা বললেন, 'রাজীব! চল

বাবা বাড়ি ফিরে যাই। এখানে আর থাকব না।' রাজীব তো অবাক! যে মানুষ বাকী জীবন কাটানোর জন্য এ জায়গায় এল,

সে মানুষ একটা দিন না কাটাতেই বাড়ি ফিরতে চায় কেন? কোন কারণ জিজ্ঞাসা না করেই মনে মনে আনন্দিত হয়ে সে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করল। সে তো আব্বাকে ফিরে নিয়ে যেতেই চেয়েছিল।

স্টেশনে এসে প্লাটফর্মের এক সিমেন্টের চেয়ারে আব্বাকে বসিয়ে দিল্লির

টিকিট কাটতে গেল রাজীব। কিছুক্ষণের মধ্যে একটি চেকার এসে তার

আব্বাকে টিকিট দেখাতে বলল। দূর থেকে সে লক্ষ্য ক'রে ফিরে এসে বলল,

'কী ব্যাপার?'

---আপনাদের টিকিট দেখান।

---আমরা এখানে নতুন। কাউন্টার খুঁজে বেড়াচ্ছি। ইনি আমার আব্বা। আমরা এখানে সকালে দিল্লি থেকে এসেছি। এই দেখুন টিকিট। এখন ফিরে

যাওয়ার টিকিট কাটার জন্য কাউন্টার খুঁজছি। কিছু সুযোগ-সন্ধানী চেকার আছে, যারা জেনে-শুনে যাত্রীকে খামোখা

নাজেহাল করে, অসদুপায়ে অনেক মানুষের অর্থ লুটে খায়। আসার টিকিটটা সাথে সাথে হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর চোখ রাঙিয়ে বলল, 'আপনারা ৫২০ টাকা জরিমানা দিন, না হয় জেলে চলুন।”

রাজীর জরিমানা দিতে রাজি নয়, জেল যেতে তো নয়ই। বচসা করেও কোন ফল হল না। পরিশেষে তার আব্বা বলল, জরিমানা দিয়ে দে বাবা!

এর মতো পশুর সাথে ঝগড়া ক'রে লাভ নেই।' জরিমানা দিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে বসে রাজীব আব্বাকে বলল, 'আচ্ছা আব্বা! গ্রামে শুনেছিলাম, আজমীর শরীফ যারা যায়, তাদেরকে চেকারে ধরে না। আজ তার বিপরীত প্রমাণ হল।”

আব্বা বলল, "ভক্তির আতিশয্যে অনেকে অনেক কথাই বলে, তার সবটাই কি সত্য হয় বাবা? শুনেছ তো, কা'বা ঘরের উপর দিয়ে পাখী উড়ে যায় না। কা'বা চত্বরের পাথর গরম হয় না। দাতা মাহবূবের উরসের মেলায় মাছি, মশা ও কুকুর থাকে না। কিন্তু সেসব কথা সত্য কি?'

---আমি তো ভাবতাম, ওয়াহাবীরাই এ সব কিছু বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজ তো আমাকেও বিশ্বাস করতে হল।

...ওয়াহাবীরা তো আওলিয়াই মানে না। কোন কোন কথার ব্যতিক্রম ঘটে বৈকি।

--ফারাযী পাড়ার আমার এক বন্ধু আছে। সে সউদী আরবে কাজ করে। সে একদিন বলছিল, 'কা'বা ঘরের উপর দিয়ে পাখী উড়ে যায়, সে নিজে দেখেছে। আর কা'বা চতুরের পাথর গরম হয় না।

কারণ ঐ শ্রেণীর শ্বেত পাথর প্রকৃতিগতভাবে গরম হয় না।' আর দাতা মাহবুবের উরসের মেলায় মাছি, মশা ও কুকুর লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে দেখা না যাওয়ারই কথা। আসলে আমার মনে হয়, ঝড়ে কাক মরে, আর ফকীর সাহেবের কেরামতি বাড়ে।'

---ও সব বলতে নেই বাবা! পবিত্র স্থানের মহিমা থাকে বৈকি? --তা বলে অমূলক মহিমায় বিশ্বাস করা কি ঠিক? --তা হয়তো নয়। তবে কেরামত তো বিশ্বাস করতেই হবে।

অতঃপর এক সময় ট্রেন দিল্লি এসে গেল। আব্বা দিল্লিতে আরো একদিন থেকে পর দিন দেশে ফিরে গেল এবং পুনরায় পূর্বের মতো কাপড়ের ব্যবসা শুরু করল। সে কথা শুনে রাজীব বড় খুশী হল। কিন্তু আব্বার এই সংসার ছাড়ার ব্যাপারটা তার কাছে রহস্যরূপেই রয়ে গেল।

(৯) বছর খানেক অতিবাহিত হয়ে গেল। আবেগময় রাজীব তখনও নিজের কথা ভাবেনি। কেবল মা-বাপ ও বোনের কথা চিন্তা ক'রে নিজেকে মশগুল ক'রে রেখেছে। ইতিমধ্যে তার আব্বা তাদের বসত-বাড়ি বিক্রি করে ব্যবসায় টাকা নিয়োগ করেছে। বর্তমানে তারা তার মামার বাড়িতে থাকে। সে যা বেতন পায়, তাতে কোন রকম সংসার চলে। এই যার হাল হয়, তার কি নিজের কথা ভাবা চলে?

কিন্তু মানুষের এমন সময় এসে পড়ে, যখন সে নিজের কথা ভাবতে বাধ্য হয়। অন্যের চাহিদা মিটাতে গিয়ে নিজের জীবনের চাহিদাকে কুরবানী দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এ যাবৎ সে নিজের জীবন-সঙ্গিনীর কথা ভাবেনি, ভারতে অবসর পায়নি। মায়ের অসুখ ও বোনের পুনর্বিবাহ দেওয়ার চিন্তায় সে ব্যাকুল থাকে। কিন্তু যে দেশে কুমারী মেয়ের বিবাহ দিতে হিমশিম খেতে হয়, সে দেশে তালাকপ্রাপ্ত....

মেয়ের বিবাহ কি এত সহজ হয়?

দেশে থাকতে অনেক সহপাঠিনী ও বান্ধবী তার জীবনে এসেছে।  আজ পর্যন্ত সে কাউকে নিজের হৃদয়-সিংহাসনে আসন দান করেনি। হওয়ার স্বপ্ন ও সংসার চালানোর দায়িত্ব তাকে এমন বিভোর রেখেছে যে, কোন বন্ধুকেও কোন মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে দেখলে খাপ্পা হয় এবং দূরে থাকতে উপদেশ দেয়।

কিন্তু বয়স চাপতে তার মনের আকাশের পরিবর্তন ঘটল। পরিবেশ তাকে ভালবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দিল।

ছুটিতে দেশে গেল। বিয়ে লেগেছিল নাজিবের ভাইঝির। নাজিবের সাথে সেও আমন্ত্রিত ছিল। বিয়ের প্রায় সকল সাজ-সজ্জার দায়িত্ব তাদের দুজনের ঘাড়ে অর্পিত ছিল। বিয়ের দিনে ভাবী নাজিবকে বলল, 'তুমি আর রাজীব মিলে বুশরার বান্ধবীদেরকে ঐ ঘরে খাইয়ে দেবে। খেয়াল করবে, যেন তাদের কোন অযত্ন না হয়। এটা বুশরার অনুরোধ।'

ভাবী চিলকে বিল দেখিয়ে দিল। উভয় তরুণ খুশীর সাথে সে দায়িত্ব পালনের ভার মাথা পেতে নিল। নাজিব রাজীবকে বলল, "ভাবী দেখছি বিড়ালকে মাছ বাছতে দিল!

বিয়ে মানেই মেয়েদের মিনা বাজার। আমকালে ডোম রাজা, বিয়েকালে মেয়ে রাজা।' চারিদিকে মেয়েদের রাজ-রাজত্ব। আর সেখানে যুবতীদের থাকে চরম আনন্দ, পরম উল্লাস। হাসি-খুশি ও সাজ-গোজে থাকে অপূর্ব প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

সেখানে নবাগত তরুণ-তরুণীর মাঝে পরিচিতি ঘটে। একে অন্যের প্রতি টীকা-টিপ্পনী কাটাকাটি চলে। আগুনের মুখে বারুদ গিয়ে পড়ে। বাড়ির মুরুব্বীরা সাত কাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করে।

বেটা-ছেলে হয়ে মেয়েদেরকে খাওয়াতে হবে! তাতে নাজিবের কৌতূহল থাকলেও রাজীবের কোন আগ্রহ ছিল না। তাকে যেন শুরু থেকেই বিষয়টা লজ্জাকর মনে হল। নাজিব সাহস দিল, উৎসাহ দিল।

নাশতার সময় নাশতা খাওয়ানো হল। প্রায় আট-দশজন তরুণীর মাঝে মাত্র দুইজন তরুণ। ইশারায়, ইঙ্গিতে, ভাবে-ভঙ্গিতে এবং উকি ও উক্তিতে তাদের প্রতি উপহাস ও মস্করা চলতে লাগল। সম্পর্কে 'চাচা' হওয়া সত্ত্বেও নাজিব কারো কারো কথার উত্তর দিল, কিন্তু রাজীব মুখ খুলতে পারল না। তবে সে একজনের হাব-ভাব ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ল। তার সাথে২৭

তার কথা হল চোখে চোখে। বাতাসে দোলা খোলা চুলের আকর্ষণ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছিল। প্রেমের তুলি দিয়ে রাজীব নিজ হৃদয়ের অঙ্কন-খাতায় তার মোহনীয় ছবি আঁকছিল।

নাশতা খাওয়ার পর তরুণীরা সকলে বিয়ের কনে বুশরার কাছে গিয়ে বসল। রাজীব আজিব হয়ে ভাবতে লাগল। ভাবল, 'আচমকা-সুন্দরী' হয়তো। পুনঃ দেখার কামনা তাকে ব্যাকুল ক'রে তুলল। ভাবল, দুপুরে খাওয়ানোর আগে হয়তো আর দেখা হবে না। কিন্তু না। তন্বী তরুণীর মাঝে

সংসারী কাজের দক্ষতা ছিল। সে ঘুরে-ফিরে ভাবীর সাথে নানা কাজে

সহযোগিতা করতে লাগল। সে লক্ষ্য করল, রাজীব তার দিকে বারবার

তাকাচ্ছে। আর তার দৃষ্টিতে একটি সকরুণ আকর্ষণ রয়েছে।

দুপুরে খাওয়ানোর সময় রাজীব সেই তন্বীর প্রতি বিশেষ যত্ন গ্রহণ করল। "মাছ নেবে? গোশ্ত নেবে? ভাত নেবে?' বলে তার সাথে বাক্যালাপ করার চেষ্টা করল। কিন্তু সে লজ্জাবতী লতা 'না' ছাড়া কোন কথা বলল না।

তবে চোখে চোখে অনেক কথাই বলল। চক্ষু যে প্রেমের ভাষা। সুস্মিত ওষ্ঠাধরে মধুর চমক দিল। হাসি যে প্রেমের ফাঁসি।

বাকী সময়ে রাজীব তার সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করল। বরকনে 'এক-ঠাই' করার সময়ও সে তার চক্ষু-সীমানায় অবস্থান করল। বিয়ে বিদায় হলে, সেও চোখে বিদায় দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল।

রাজীবের মনে এবার 'নেশা' ধরে গেল। সেই ছবি বারবার তার মনের পর্দা সরিয়ে উকি দিতে লাগল। শয়নে স্বপনে-নিশি জাগরণে তার কল্পনা তাকে উদাস ক'রে তুলল।

বিয়ের তিনদিন পর রাজীবকে আনমনা দেখে নাজিব জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার বল তো। তোকে যেন উদাস-উদাস লাগে?'

একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে জবাব দিল, 'কৈ না তো! আচ্ছা ঐ মেয়েটার নাম কী রে?'

---কোন্ মেয়েটা?

-ঐ যে, যে মেয়েটা আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

---আরে বাবা কোন মেয়েটা?

---ঐ যে পাতলা, সুশ্রী, চুল খোলা। যার দিকে বারবার তাকাতে তুই আমাকে মানা করছিলি।

ওহো! ওর নাম শিউলি।

---বাড়ি কোথায়? --আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ায়।

--চল ওই পাড়া দিয়ে বেড়াতে যাই। --

-তুই কি ওর প্রেমে পড়লি নাকি? ---এই ব্যাকুলতার নাম যদি 'প্রেম' হয়, তাহলে আমি প্রেমেই পড়েছি।

- --এই মরেছে!

--কী করি বল তো?

-আরে প্রেম কিয়া তো ডরনা কিয়া? বলে ফেল।

---কোথায় বলব? কীভাবে বলব? এ তো শহর নয়। পাড়াগ্রামে কি ফিল্মী অনুকরণ চলে?

---আরে পাড়াগ্রামেও কত ঘটছে। একদম ফিল্মী অভিনেতা-অভিনেত্রীর

মতো এ্যাকশন! ঘরে ঘরে টিভি, যখন তখন ফিল্ম ও নাটক। কী দোস্ত! দিল্লিতে কাউকে পাওনি বুঝি?

---না, ওখানে বাঙালী মেয়ে তত কোথায়? একবার শিউলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দে না!

---ঠিক আছে, কাল চারটার সময় আমাদের ঘরে আসিস।

দেখা হল, কিন্তু কিছু বলার সাহস হল না। রাজীব নাজিবকে বলল, 'তুই বলে দে।'

---ধুৎ! তাই আবার হয়? তুই সরাসরি মুখে বলতে না পারিস, চিঠি লিখে জানিয়ে দে প্রেমের আবেদন। সুতরাং রাত্রে সে বহু ভাবনা-চিন্তা ক'রে চিঠি লিখল। তবে একটি কবিতা

ছাড়া অন্য কিছু লিখতে পারল না। প্রথম যেদিন আমি দেখেছি তোমারে....

  • বেঁধেছি প্রণয়-ডোরে, হৃদয় আধারে---
  •  
  • তুমি যেন আসিয়াছ, করেছ পাগল..
  •  
  • রুদ্ধ করেছ দ্বার, দিয়াছ আগল...
  •  
  • তোমার কোমল হৃদে করিয়া যতন, রাখিবে আমার প্রেম ফুলের মতন। প্রেমের পরশ চাহি' করি নিবেদন..
  •  
  • পাইলে তোমায় আমি চাহিব না ধন..

প্রেম নিবেদনের ব্যাপারে ছেলেদের জন্য যা করা অতি সহজ, মেয়েদের জন্য তা মোটেই সহজ নয়। কবিতা পড়ে দেহের লোম খাড়া হল শিউলির।

মনে মনে সেও রাজীবকে পছন্দ ক'রে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু কবিতার জবাব দেবার মতো সাহস তার হল না। তবে তার হৃদয়ের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেল। সেও রাজীবকে দেখার জন্য উৎকণ্ঠিতা হল।

ছল-বাহানা ক'রে আসতে লাগল বুশরাদের বাড়ি। কিন্তু হাসি বিনিময় ছাড়া কাছাকাছি হয়ে কথা বলার দুঃসাহস কারো হল না।

চুপে চাপে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল, চাপা বেদনা ছাড়া বাইরে প্রকাশ কিছু হল না। রাজীব সাহস করে আবারও চিঠি লিখে সেই অব্যক্ত বেদনার কথা জানিয়ে দিল।

'শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এল টগর ফুটিল মেলা, মালতি লতায় খোঁজ নিয়ে যায়..

মৌমাছি দুই বেলা।” কিন্তু তোমার খোজ আমি কোথায় পাব? কখন তোমার সাথে আমার দেখা হবে? আমার ডাক নাম রাজীব, তার মানে পদ্মফুল। আর তুমি শিউলি। তুমি থাক ডালে, আমি থাকি খালে,

দেখা কি হবে সেই মরণের কালে?

বল না বন্ধু, 'আমি তোমাকে ভালবাসি!” তোমার ওষ্ঠাধরে হাসির ঝিলিক এলে তোমাকে ফোটা শেফালিই লাগে। তোমার দর্শন আমার হৃদয়-বাগিচায় প্রেমবারি বর্ষণ করেছে।

আমি সাক্ষাতে তোমার সাথে কথা বলতে চাই প্রিয়া! তোমার হৃদয়-বাগানে আমি ফুল ফোটাতে চাই শিউলি! তুমি কি তা চাও না? উত্তর দিয়ো। অপেক্ষায় থাকলাম।

‘ইতি'র সাথে প্রীতি দিয়ে শেষ করলাম লেখা, জানি না গো তোমার সাথে কবে হবে দেখা।..

অবশেষে রাজীব শিউলির নিকট থেকে সবুজ-সংকেত পেল। তার বাড়ির এক বালক ভূত্যের মাধ্যমে চিঠি আসতে লাগল। সাক্ষাৎ হতে লাগল নাজিবের বাড়িতে, স্কুল যাওয়ার পথে। উভয়ের এই অবৈধ প্রেম দ্রুত গতিতে বর্ধিত হতে লাগল। মনে মনে জোয়ার এল, প্লাবিত করতে চাইল নৈতিকতার কূলকে। প্রেম যতক্ষণ অন্তরে থাকে, ততক্ষণ তা পবিত্র থাকে। অন্তর ছাপিয়ে বাইরে বের হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে গড়িয়ে গেলেই তা অপবিত্র হয়ে যায়। অবশ্য তারা পবিত্র প্রেমের আনন্দই লাভ করতে চায়।

কিন্তু রাজীবের মনে আনন্দ থাকলেও সে চিন্তামুক্ত নয়। ভাবনা তার ভবিষ্যতের। যে প্রেমে সে পড়েছে, তার ভবিষ্যৎ কী? যার প্রেমে সে পড়েছে, তার অঙ্গীকারের নিশ্চয়তা কী? অর্ধেক পথে তার প্রেম হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে না তো? সে তো ধনী বাপের ধনিকন্যা, তাহলে এ প্রেমের সাফল্যে সে স্বাধীনতা পাবে তো?

প্রেমের সর্বশেষ পরিণাম বিবাহ। বিবাহ ক'রে তার সঙ্গে সুখের সংসার

গড়তে পারবে তো? ভালবাসার রঙিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুম ভেঙ্গে যাবে না তো?

বন্ধুদের কাছে পরামর্শ নিয়ে যা স্থির সিদ্ধান্ত হল তা এই যে, হাতি কিনলে, তার খাবার যোগাতে হবে, বিয়ে করলে তার জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে হবে।

কিন্তু অর্থ সঞ্চয়ের পথ কী? অর্থ সঞ্চয় করতে পারলে তার প্রেমও পরিপক্ক হবে, শিউলিও অধিক ভালবাসবে। কিন্তু তার উপায় কী?

দিল্লি যেতে আব্বা বাধা দিয়েছে। তাছাড়া শিউলির প্রেমের টানও তাকে দিল্লি যেতে দিতে চায় না। তাহলে গ্রামে সে করবে কী?

নিজেদের বাড়ি-সম্পত্তি বলতে কিছু নেই.... 

যেটুকু ছিল চাচারা রেজিস্টি ক'রে নিয়েছে মাত্র ষোল হাজার টাকার বিনিময়ে। ব্যবসাতে তারা সফল হতে পারল না। আব্বাও না। যেহেতু আব্বা একজন সংসার-বিরাগী মানুষ।

সংসারের আয়-উন্নতি তিনি মাথা ঘামান না। তিনি ধার্মিক, ধর্মের খাতিরেও তিনি বাইরে তবলীগে যান।

রাজীব একা কী কী করতে পারে? তার অবস্থা এখন এমন যে, সে যে ডাল ধরে, সেই ডালই ভাঙ্গে। এখন জীবনকে নতুন ক'রে গড়ার জন্য, শিউলির সাথে সুখী সংসার গড়ার জন্য কোন ডালের সাহারা সে নেবে? তাকে জীবন- সঙ্গিনী বানিয়ে চিরসাথী ক'রে রাখার মতো সক্ষমতা সে কোথা থেকে পাবে?...সুতরাং আসল বড়লোক সেই ব্যক্তি, যে পরকালের জমিতে একটি বিল্ডিং নির্মাণ করতে পেরেছে। '

রাজীব সুসংবাদ নিয়ে বাসায় ফিরে গিয়ে শিউলিকে ফোনে জানিয়ে দিল, "এবার আমার বড় হওয়ার স্বপ্ন সফল হবে ইনশাআল্লাহ।”  গল্পটি এখনো শেষ হয়নি.. আপনারা যারা গল্পটি আরও পড়তে চান তারা কমেন্ট করুন....

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ

⚡পাপ যতই ক্ষুদ্র হোক তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করিও আর পূর্ণ যতই ক্ষুদ্র হোক তা আমল করার চেষ্টা করিও..!!