মানব সভ্যতার আজকের এই উন্নয়ন হাজার হাজার বছর ধরে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চিন্তাশক্তি নিয়ে জন্মানো কতিপয় ব্যক্তিবর্গের নিরলস প্রচেষ্টা ও নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশার ফলাফল।
আদিম যুগে পাথর অথবা গাছের ডাল দিয়ে অস্ত্র বানিয়ে শিকার থেকে শুরু হয় প্রযুক্তির প্রসার। যা ভূমি থেকে শুরু হয়ে এখন মহাকাশ ও সমুদ্রের রহস্য ভেদে বিস্তৃত হচ্ছে।
পৃথিবী প্রতিটা সেকেন্ড এমনকি ১ সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ও প্রযুক্তি ছাড়া চলতে পারছে না। প্রতি মূহুর্তে প্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমান পৃথিবীতে অনিবার্য।
প্রযুক্তির কল্যানে একদিকে পৃথিবী যেমন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তেমনি প্রযুক্তির কিছু শক্তিশালী আবিষ্কার রয়েছে যা মানব সমাজকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে।
আজ আমরা তেমনই একটি ঘটনা সম্পর্কে জানবো।
চেরনোবিল কি?
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ের চেরনোবিল একটি পারমানবিক চুল্লী ছিল, যা বর্তমান ইউক্রেনে অবস্থিত ছিল।
ইউক্রেন ও বেলারুশ সীমান্তে অবস্থিত ৪ (চার) চুল্লী বিশিষ্ঠ এই পারমানবিক কেন্দ্রে ১৯৮৬ সালে ঘটে যায় স্মরনকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম দূর্ঘটনা। যা চেরনোবিলের বিপর্যয় নামে পরিচিত। আজ আমরা এ সম্পর্কে জেনে নিব।
চেরনোবিল দূর্ঘটনাঃ
চেরনোবিল পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে মোট ৪টি (চারটি) পারমানবিক চুল্লী ছিল।১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল স্থানীয় সময় অনুযায়ী রাত ১টা ২৩ মিনিটে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৪র্থ পারমাণবিক চুল্লী থেকে দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয় বলে জানা যায়।
দুর্ঘটনাটি মূলত ঘটেছিলো শীতলীকরণের ওপর একটি পরীক্ষা করার সময়। তদান্তীন শিফটে দায়িত্ব পালনরত কর্মীরা ভুল করে ৪র্থ পারমাণবিক চুল্লীটির টার্বাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতল জল প্রবাহিত করে। ফলে সেখানে বাষ্প কম উৎপাদিত হয়।
এতে করে পারমাণবিক চুল্লীটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এতে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রায় একই সঙ্গে ঘটে যাওয়া ২টি বিস্ফোরণে ৪র্থ পারমাণবিক চুল্লীটির উপরের প্রায় ১ হাজার টন ভরের কংক্রিটের ঢাকনা সরে যায় এবং ছাদ ভেঙে যায়।
বিস্ফোরনের প্রায় ১দিন পার হওয়ার পর চুল্লীর ভেতরের দাহ্য পদার্থ বায়ুর সংস্পর্ষে এসে বিশাল অগ্নিকান্ড সৃষ্টি করে। এই আগুন প্রায় ১০দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
এই অগ্নিকান্ডে চুল্লী হতে বিষাক্ত পদার্থের যে মেঘ এবং ধোয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা আকাশে প্রায় ১কি.মি. উঁচুতে উঠে গিয়েছিল। এমনকি এই বিষাক্ত বায়ু ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়া হয়ে পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব আমেরিকা এবং ব্রিটেন ও আশপাশের আরও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
পরমানুবিদগণের মতে এই বিস্ফোরনে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া পারমানবিক উপাদানের পরিমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত ৫০০টি পারমানবিক বোমার ক্ষতির সমান।
দূর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাঃ
চেরনোবিল পারমাণবিক দূঘটনায় নির্গত দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে একটি বিশাল কংক্রিট নির্মিত দেওয়াল (খোলস) মধ্যে দুর্ঘটনাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৪র্থ পারমাণবিক চুল্লীটিকে ৬ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে ঢেকে ফেলা হয়।
ওই অস্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থাটিই এখন পর্যন্ত পারমাণবিক কেন্দ্রটির ধ্বংসাবশেষকে ঢেকে রাখার জন্য বানানো একমাত্র স্থাপনা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষে থাকা গলিত প্রায় ২০০ টন পরমাণু কেন্দ্রের জ্বালানি থেকে যে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে তা হাজার বছরেও পুরোপুটি দূর হতে পারবে বলে আশা করা যায় না।
তাই এ পরমাণু জ্বালানি বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের আওতামুক্ত রাখতে নতুন ধরনের একটি নিরাপত্তা স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির স্থাপনাটির নির্মাণব্যয় অনুমান করা হয়েছে ১৬০ কোটি ইউরো বা ২২১ কোটি মার্কিন ডলার।
দূর্ঘটনা পরবর্তী পরিনতিঃ
1986 সালের ২৬শে এপ্রিল তারিখে ইউক্রেনের চেরনোবিলে যে পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণ ঘটে এই দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিশাল। দুর্ঘটনার পরবর্তী পরিণতি খুবই ভয়াবহ এবং যথেষ্ট হৃদয়বিদারক ও বটে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণের পর চুল্লি থেকে তেজস্ক্রিয়তা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পুরো এলাকা তেজস্ক্রিয়তার দরুন ছারখার হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় ওই এলাকায় প্রায় 40 হাজার লোকের মধ্যে প্রায় তিরিশ হাজার লোককে খুব দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। দুর্ঘটনায় স্পটেই 32 জন মারা যায়। এবং পরবর্তীতে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে আস্তে আস্তে মানুষ সহ পশুপাখিও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এমনকি অনেকে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সরকার যতটা সম্ভব দ্রুত শহরবাসীকে অন্যত্র সরিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশের ত্রিশমাইল জায়গা জুড়ে মানুষের বসবাস কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ক্রমে তা উত্তর ইউক্রেন এবং বেলারুশের দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। শোনা যায় পরবর্তিতে ঐ এলাকার অনেক মানুষ থাইরয়েড ক্যান্সারে মারা যায়।
এই বিস্ফোরণের পর মানুষ পরিবর্তন এনেছে। কারণ ইতিমধ্যেই সবাই তেজস্ক্রিয়তার মারাত্মক ক্ষতি সম্পর্কে জেনে গিয়েছে। তাই তাদের প্রচেষ্টা এই দুর্ঘটনার জন্য পুনরাবৃত্তি আর কখনো না ঘটে।
চেরনোবিলের বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে একটি জনপদ। কিন্তু এখনো জানান দিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হয় অঞ্চল থেকে এখনো পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তাই চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশের 10 মাইল এলাকা জুড়ে এখনো মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে।
চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পাশ দিয়েই বয়ে চলে প্রিপিয়াত নদী। যা ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম জলাধার দনিপে গিয়ে মেশে এবং ওই অঞ্চলের প্রায় ২৪ লক্ষাধিক বাসিন্দার জলের চাহিদার যোগান দিত। জলজ পরিবেশে তেজস্ক্রিয় দূষণ তাই দুর্ঘটনার পর একটি বড় আকারের সমস্যা এবং দুঃশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
ইউক্রেনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলিতে দুর্ঘটনার পরে সপ্তাহ এবং মাসের মধ্যে পান যোগ্য পানির তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়ে। পানীয় জলে রেডিওডোডিনের মাত্রা নির্দেশক তৎকালীন সময়ে বর্ধিতকরন করা হয়, যা বেশিরভাগ জলকে নিরাপদ হিসাবে প্রতিবেদন করে।
পরবর্তীতে সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে সমস্ত দূষকগুলি অবিচ্ছেদ্য পর্যায়ের নিচে স্থিত হয়ে গেছে এবং ৮০০-১০০০ বছরেও দ্রবীভূত হওয়ার আশা করা যায় না।
দুর্ঘটনার ১ বছর পরে ঘোষণা করা হয় যে চেরনোবিল পারমানবিক চুল্লীর শীতল পুকুরের জল গ্রহণযোগ্য নিয়মের মধ্যে রয়েছে। তারপরেও দুর্যোগের দুই মাস পরে কিয়েভের পানির সরবরাহ নিপার থেকে দেশনা নদীর দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
পরিশেষেঃ
চেরনোবিলের দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এখনো সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। বিস্ফোরণের পর সরকার কর্তৃক চেরনোবিল শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। যার ফলে ঐ এলাকা পরিণত হয়েছে অদ্ভুত এক ভুতুড়ে ও নীরবতার শহরে।
বনভূমিতে ছেয়ে গিয়েছে পুরো জায়গা। বর্তমানে চেরনোবিলকে ঘিরে রয়েছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। এই শহরকে সংরক্ষণের জন্য নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা চিন্তাভাবনা চলছে।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা টনক নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীর। যদিও এই দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ বর্ণনাতীত তবুও একটি মানুষকে কি শিক্ষা দিয়েছে। তা হল
এই দুর্ঘটনার পর এই মানুষ বুঝতে পেরেছে তেজস্ক্রিয় তার ভয়াবহতা কত। যার ফলে তারা আরো বেশি সাবধান হতে পেরেছে।
You must be logged in to post a comment.