গুরু শিষ্যের গল্প?

এক দেশে ছিল একজন গুরু এবং তার একজন শিষ্য। তো শিষ্যটি আবার গুরুর মুটোমুটি ভক্ত। শিষ্য প্রায় সবসময়ই গুরুর সাথে সাথেই থাকে। গুরু যেদিকে যায় শিষ্যও সেদিকেই যায়।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

তবে একদিন হঠাৎ করে গুরুর মনে উদয় হলো বিদেশ ভ্রমণ করবে। তাই তিনি তার শিষ্যকে বললেন, 

-চল, আমরা ভ্রমণে বের হই।

-ভ্রমণে! কোথায় ভ্রমণ করবেন গুরু?

-দেশ থেকে দেশান্তর। সৃষ্টিকর্তা যতদূর নেন। শুধু এক জায়গায় তো আর আমাদেরকে বসে থাকলে হবে না। দেশ বিদেশ সম্পর্কে আমাদেরকে জানতে হবে।

-ঠিক আছে। আপনি যেটা ভালো মনে করেন গুরু। আমি যেতে প্রস্তুত।

একদিন গরু-শিষ্য তাদের আস্তানা থেকে বের হয়ে রওয়ানা হল। সঙ্গে চিড়া, মুড়ি শুকনো খাবার যতটুকু সম্ভব নিয়ে নিল। যেতে যেতে অনেক দূর যাবার পর যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন এক জায়গায় বসে বিশ্রাম করে সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে নেয়। এভাবে কয়েক মাস তারা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে থাকে। কিন্তু একটা সময় শিষ্য খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একটা জায়গায় এসে শিষ্য দুর্বল ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে বলে, 

-গুরু আমি আর হাঁটতে পারবো না। কিছুদিন এই জায়গায় আমরা বিশ্রাম করি।

-কিন্তু আমাদের ভ্রমণ তো এখনো শেষ হয় নি। আমাদের আরো অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। তারপর আমাদেরকে আমাদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে হবে। 

-কিন্তু গুরু, আমি আর পারবো না। আমি মরে যাবো। 

-কি বলছিস তুই হতভাগা? আমি তোর সঙ্গে থাকতে তুই নিজেকে এত দুর্বল ভাবছিস কেন? ঠিক আছে এখানে তাবু টানা। এখানে আমরা কিছু দিন বসবাস করবো। তারপর ক্লান্ত সেরে গেলে আমরা আবারও রওয়ানা হব।

শিষ্য গুরুর কথায় খুশি হয়ে সেখানেই তাবু গারল। সাথে থাকা তল্পিতল্পা থেকে মাদুর বের করে বিছালো। তারপর তার উপর আরাম করে দুই জনে বসে গুড়-মুড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম থেকে উঠে দেখে বেলা গড়িয়ে গেছে। পাশে একটি পুকুর থেকে দুইজনে গোসল সেরে আসল। শিষ্য বলল, 

-গুরু আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। আমি এখন আর চিড়া মুড়ি খেতে পারবো না।

-চিড়া মুড়ি খেতে পারবি না, তাহলে কি খাবি? সঙ্গে তো চিড়া মুড়ি ছাড়া খাবার কিছু নেই।

-গুরু, এক কাজ করলে কেমন হয়। চলেন দেখি আশে পাশে কোন বাজার আছে কিনা।

-ঠিক আছে চল। দেখি কোন বাজার পাওয়া যায় কিনা।

দুই জনে তাবু থেকে বাজার খোঁজার উদ্দেশ্যে বের হলো।

কিছুদূর যেতেই চমৎকার একটি বাজারের সন্ধান পাওয়া গেল। প্রায় সবকিছুই আছে এই বাজারে। তারা দুই জনে একটি খাবারের হোটেলে ঢুকলো। হোটেলে নানা ধরণের খাবারের সুন্দর প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। খাবারের দাম জিজ্ঞেস করতেই দুজনেই বিস্মিত হয়ে গেল। এ আবার কেমন হোটেল রে ভাই?

সবকিছুর দাম সমান। মাছের দামও যাই, মাংসের দামও তাই। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাক, সবজি, ডাল, ভর্তা, ভাত, খিচুড়ি, বিরিয়ানি সবকিছুর দাম একই।  

অবাক হলেও দুজনেই নিজেদের পছন্দমতো খেয়ে প্রফুল্ল মনে হোটেল থেকে বের হলো।

বের হয়ে দেখে দুই পাশ দিয়ে লোকেরা নানান কিছু নিয়ে সারিবেধে বসেছে বিক্রয় করার জন্য। মাঝখান দিয়ে ক্রেতারা হাঁটছে। যার যা পছন্দ কিনছে। তবে এখানেও তারা অবাক হলো একারণে যে, বাজারে যা কিছু কেনাবেচা হচ্ছে সবকিছুর দামই সমান!

তারা বিস্ময় চোখে দর্শন করতে লাগলো যে, এখানে লোহার দাম যত, সোনার দামও তত। লবনের দাম যত, চিনির দামও তত। পানির দাম যত মধুর দামও তত। আটার দাম যত, চালের দামও তত। এক কথায় সকল পন্যের দামই সমান। 

শিষ্য এক দোকানীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, 

-আপনাদের এই বাজারে বুঝি সবকিছুর দামই সমান?

দোকানী বলল, 

-আমাদের বাজারে না শুধু। আমাদের সারা দেশেই সবকিছুর দাম সমান। এমনকি, আমরা নারী ও পুরুষদেরকে একই দাম দিয়ে থাকি।

খুশি হয়ে শিষ্য গুরুর কাছে গিয়ে বলছে, -দেখছেন গুরু, এদেশের রীতিনীতি কত সুন্দর। এখানে সকল পন্যের দামই সমান। কোন কিছুর মধ্যেই কোন ভেদাভেদ নাই।

-হু তাইতো দেখছি। চল এবার তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম করি গিয়ে।

-হ্যা, চলুন।

যেতে যেতে শিষ্য আবারো বলল, 

-গুরু, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এদেশের রাজা খুব ভালো। তা না হলে কোনো কিছুর মধ্যেই কোন ভেদাভেদ না রেখে সবকিছুর মূল্যই সবান করে দিবেন কেন?

-এতে রাজার ভালো হবার কি দেখলি? 

-ভালোনা তো কি। দেখেন, আমাদের দেশের মতো অন্যান্য দেশেও সকল পন্যের দাম আলাদা আলাদা। আমাদের দেশের সরকার সকল জিনিসকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করে। অথচ, এদেশের সরকার সকল জিনিসকে এক চোখে দেখে। সব কিছুকেই একই রকম সম্মান করে। অতএব, এদেশের রাজার বিচার ভালো। গুরু, এক কাজ করি। আমরা এদেশেই থেকে যাই।

গুরু বললেন, 

-না, তুই যেটা ভাবছিস, সেটা ঠিক না। এদেশের রাজার বিচার ভালো না। প্রত্যেকটা জিনিসের আলাদা আলাদা দাম থাকে। যার যা মূল্য তাই দিয়ে তাকে বিচার করতে হয়।

-কিন্তু গুরু আপনিই তো বলছেন, কোন কিছুর মধ্যেই জাতভেদ নাই। সবকিছুই সমান।

-তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রত্যেকটা জিনিসের আলাদা আলাদা কাজ থাকে। সোনার কাজ লোহা দিয়ে হবে না। চিনির কাজ লবন দিয়ে চলবে না। তেমনি মধুর কাজ পানি দিয়েও হবে না। প্রত্যেকটা জিনিসের তাদের নিজ নিজ কাজের মূল্যায়ন করা উচিত। 

-আপনে যাই বলেন গুরু। এই দেশটা আমার পছন্দ হয়েছে। এখানে সস্তায় অনেক ভালো ভালো খাবার কিনে খেতে পারবো। আমি এদেশ থেকে কোনমতেই যাবো না।

-তুই বুঝতে পারছিস না। এদেশের ভালো ভালো খাবার সস্তায় খেতে পারলেও এই ভালো খাবারই একদিন তোর বিপদ ডেকে আনবে।

-কি বলেছেন গুরু? আমি এখানে আরামে থাকবো। ভালো ভালো খাবার খাবো। আমার শরীর-স্বাস্থের উন্নতি হবে।

-তুই আমার সাথে থেকে এই শিক্ষা অর্জন করেছিস? তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না।

-আমি আপনার সব কথাই বিশ্বাস করি গুরু। শুধু এই বিষয়টা মানতে পারছি না। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন গুরু। আমি এই দেশ ছেড়ে কোথায় যাবো না।

গুরু ওর সাথে আর কোন কথা বললেন না। দুজনেই তাঁবুতে ফিরে আসলেন। তাঁবুতে এসে গুরু আর দেরি না করে তল্পিতল্পা গুছিয়ে বের হলেন। পেছন থেকে শিষ্য ডেকে বলল, -গুরু, আমাকে কিছু অর্থকড়ি দিয়ে যাবেন না।

গুরু তার কাছে থাকা সব টাকা শিষ্যকে দিয়ে বলল, 

-এই নে। আর শোন, যদি কখনো কোনদিন কোন বিপদে পরিস, তাহলে তখন  আমাকে স্মরণ করিস। এই বলে গুরু চলে গেল।

এই রাজ্যে ছিল এক চোর। শহরের এক বড়লোকের বাড়ি থেকে চুরি করতে গিয়ে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালানোর সময় বাহিরের দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে দেয়াল ভেঙে দশ তলার উপর থেকে ধরাম করে পাকা রাস্তার উপর মাটিতে পড়ে যায়। আর সাথে সাথে মাটিতে পিষ্ট হয়ে লাশ হয়ে যায়। 

আশেপাশের লোকজন দৌড়ে এসে দেখে, কি হয়েছে কি হয়েছে? বিল্ডিংএর উপর থেকে মানুষ পড়ে মারা গেছে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক মানুষের ভিড় জমে গেল। পুলিশে খবর দেয়া হল। পুলিশ এসে লাশ ময়না তদন্তের জন্য থানায় নিয়ে গেল।

সারা শহরের মাঝে সোরগোল পড়ে গেল। পুলিশ এসে যে বাড়ি থেকে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেই বাড়ির মালিককে পাকড়াও করল। তাকে রাজদরবারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। রাজার সেনারা তাকে কারাগারে বন্দী করে রাখল। কিছুদিন পর বিচারের জন্য তাকে রাজ দরবারে হাজির করা হলো।

বিচার কার্য শুরু হলো। বাড়ির মালিককে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। মন্ত্রী তার বক্তব্য পেশ করতে লাগল,

-মৃত লোকটা না হয় চোর। তবুও তো সে এ রাজ্যেরই একটা মানুষ। আর আমরা আমাদের রাজ্যের প্রত্যেকটা মানুষকেই সমান চোখে দেখি। হোক সে চোর কিংবা সাধু। ভালো হোক আর মন্দ হোক। ধনী হোক অথবা গরীব হোক। প্রত্যেক মানুষই রাজ্যের সম্পদ।

আমরা আজকে একজন চোর নামক সম্পদটিকে হারিয়েছি। কিন্তু তার অকাল মৃত্যু, এর জন্য দায়ী কে। এর জন্য দায়ী এই বাড়িওয়ালা। সে কৃপণতা করে অল্প টাকা খরচ করে বাড়ি বানানোর কারণে আজকে এ বাড়ির দেয়াল ভেঙে একটা চোর মাটিতে পড়ে মারা গিয়েছে। আমি বিজ্ঞ মহারাজের কাছে এই বর্বর কৃপণ বাড়িওয়ালাকে যে পর্যন্ত মৃত্যু না হয় সে পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আবেদন করছি, মহারাজ। 

মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বাড়িওয়ালার আত্নীয় স্বজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। অনেকে বলাবলি করতে লাগল, এতে বাড়িওয়ালার কি দোষ। সে তো জানেই না, কখন চোর এসেছে আর কখন সে মারা গেছে? আবার কেউ কেউ বলছে, চোর মারা গেছে এটাতো সত্যি। এখন, কাউকে না কাউকে এর দায়ভার 

নিতে হবে। এর জন্য তো রাজা মশাই অন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারতেছেন না। এদিকে চোর হত্যার বিচার না হলে যে, চোরের আত্নায় কষ্ট পাবে।

রাজা মশাই বললেন, 

-চোর হলেও সে একজন মানুষ। আমার রাজ্যের সম্পদ। বাড়িওয়ালা, সে কৃপণ হলেও আমার রাজ্যেরই সম্পদ। আপনারা সবাই জানেন যে, আমার রাজ্যে আমি সবাইকে সমান চোখে দেখি। এখন, বাড়িওয়ালার ভুলের কারণে তার বাড়ির দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙে চোর নিচে পড়ে মারা গিয়েছে। তাই, এই অপরাধের জন্য বাড়ির মালিক নিজেই দায়ী। অতএব, এর শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। 

বাড়িওয়ালা হু হু করে কেঁদে উঠলো।

-আমাকে মাফ করুন হুজুর, আমাকে ক্ষমা করুন। 

রাজার মন নরম হলো। তিনি বললেন

-বাড়িওয়ালা অপরাধী হলেও যেহেতু আমার রাজ্যেরই একটা সম্পদ। তাই তাকে একদিন সময় দেয়া হলো। সে যদি প্রমাণ করতে পারে যে, সে দোষী নয়। এবং প্রকৃত দোষী কে তাকে ধরিয়ে দিতে পারে তবে তাকে বেকুসুর খালাস দেয়া হবে।  

সাথে সাথে প্রজারা শ্লোগান দিয়ে উঠলো -জয় মহারাজের জয়, জয় মহারাজের জয়। দরবার মুলতবি ঘোষণা করা হলো।

পরদিন সকাল বেলা রাজ দরবারে আবার বিচার কার্য শুরু হলো। রাজা বাড়িওয়ালাকে ডেকে বললেন,

-তোমাকে একদিন সময় দেয়া হয়েছিল। সে সময় চলে গেছে। তুমি তো নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারলে না। এখন তো তোমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতেই হবে। তার আগে তোমার কি কোন কিছু বলার আছে?

বাড়িওয়ালা বলল, 

-হুজুর, আমাকে ফাঁসি দেওয়ার আগে একবার আমার কথা শুনুন। আমার বাড়ি বানানোর ব্যাপারে আমি কোন কৃপণতা করিনি। আমি তো ঠিকাদারকে চুক্তি দিয়েছিলাম। যেখানে, যত টাকা লেগেছে আমি খরচ করেছি। আপনি একবার ঠিকাদারকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, সে কোথাও ভুল করেছে কিনা।

রাজা নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, 

-কথা তুমি মন্দ বলো নি। তুমি যদি কৃপণতা না করে থাক, তাহলে তো ঐ বেটারই দোষ। কোথায় সেনাপতি? যান, এক্ষনি ঐ ঠিকাদার বেটাকে ধরে নিয়ে আসুন। 

সেনাপতি রাজার আদেশ পালন করতে সিপাহীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

পরদিন আবারো বিচার কার্য শুরু হলো। কিন্তু আজকের বিচার ঠিকাদারকে নিয়ে। মন্ত্রী বলতে লাগলেন, 

-আমাদের রাজ্যের একটা চোর বিল্ডিংএর দেয়াল ভেঙে যাবার কারণে মারা গিয়েছে। আর ঐ বিল্ডিং তৈরি করার চুক্তি নিয়েছিল কে? এই ঠিকাদার। এই ঠিকাদারের ভুলের কারণে চোর মারা যায়। আমি মহারাজের কাছে এই ঠিকাদারকেই ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ প্রত্যাশা করছি। 

ঠিকাদার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

রাজা মশাই বললেন, 

-এই ঠিকাদার। তোমার কারণেই আমার দেশের চোরটি মারা গিয়েছে। এজন্য তোমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়াতে হবে। তোমার কি কিছু বলার আছে?

ঠিকাদার বলল, 

-হুজুর, আমি ইন্জিনিয়ার এর পার্মিশন নিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক মতোই করেছি। কিন্তু, কাজটা তো আমি নিজের হাতে করিনি। মিস্ত্রী দিয়ে করিয়েছি। আর ঐ মিস্ত্রী যদি কোন ভুল করে থাকে তার জন্য কি আমাকে সাজা ভোগ করতে হবে?

রাজা বললেন, 

-সেটাও তো ভাববার বিষয়। ঠিকাদার আমার রাজ্যের একটা সম্পদ। মিস্ত্রী বেটার ভুলের কারণে তো আমরা ঠিকাদারকে সাজা দিতে পারি না। সেনাপতি সাহেব। আপনি এক্ষুনি যান। কোথায় আছে সেই মিস্ত্রী বেটা, তাকে ধরে নিয়ে আসুন।

-যাচ্ছি মহারাজ। 

বলে সেনাপতি তার লোক লস্কর নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পরদিন রাজমিস্ত্রীকে নিয়ে বিচার কার্য শুরু হলো। মন্ত্রী তার বক্তব্যে নানান ভাবে রাজমিস্ত্রীকে দোষারোপ করতে লাগল। মহারাজের কাছে মিস্ত্রীর ফাঁসির হুকুম চাইল। রাজা মশাই মিস্ত্রীকে ফাঁসির হুকুম দেবার আগে পূর্বের মতো তাকেও জিজ্ঞাসা করলেন, -তোমার কিছু বলার আছে কিনা?

মিস্ত্রী বলল, 

-হুজুর, আমি কাজ করেছি ঠিকই। কিন্তু, ঢালাই আমি নিজের হাতে তৈরি করিনি। সেটা করেছে আমার হেল্পার। আমার হেল্পার যদি মাল মশলা তৈরি করতে গিয়ে পানি বেশি ঢেলে থাকে তার জন্য তো আমি দায়ী নই। 

রাজা ভাবলেন, তাওতো ঠিক আছে। হেল্পারে যদি মাল মশলা খারাপ করে বানিয়ে থাকে, সেটাতো হেল্পারের দোষ। হেল্পারের দোষের কারণে কেন ভালো একটা মিস্ত্রী যে নাকি আমার রাজ্যেরই সম্পদ তাকে হত্যা করতে যাচ্ছিলাম। 

রাজা মশাই এবার চেচিয়ে বললেন,

-কোথায় সেনাপতি। তাড়াতাড়ি যান। ঐ হেল্পার বেটাকে ধরে নিয়ে আসুন।

সেনাপতি তন্নতন্ন করে খুঁজে হেল্পারকে ধরে নিয়ে আসলেন রাজ দরবারে। পরদিন বিচার। মন্ত্রী মশাই পূর্বের ন্যায় হেল্পারকে দোষারোপ করে যাচ্ছিল। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আর্জি পেশ করল। হেল্পার কান্না শুরু করলো। রাজা পূর্বের ন্যায় হেল্পারকে বললেন,

-তোমার কিছু বলার আছে কিনা?

হেল্পার ভয়ে ভয়ে বলল,

-হুজুর, দেয়াল তৈরির মাল মশলা আমি নিজে বানিয়েছি ঠিকই। কিন্তু যখন কাজ করতে ছিলাম তখন যে কলসিতে করে পানি আনতাম তার নিচে ছেদা ছিল। এজন্য মশলার মাঝে পানি বেশি হয়ে গিয়েছিল। এটা তো আমার দোষ না মহারাজ। যে কুজে বুড়ি আমাদেরকে কলসি সাপ্লাই দিত, সে ভালো কলসি না দিয়ে খারাপ কলসি দিয়েছিল। 

রাজা বুঝতে পারলেন, হেল্পার বেচারারও কোন দোষ নেই। আমি বীনা দোষে একটা হেল্পারকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলাম। হেল্পার হলেও তো সে আমার রাজ্যেরই সম্পদ।

রাজা এবার খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন,

-ঐ কুঁজো বুড়ি কোথায় থাকে? তাকে ধরে নিয়ে আসা হোক।

সেনাপতি অগত্যা সিপাহীদের নিয়ে রওনা হলেন কুঁজো বুড়িকে ধরার জন্য।

কুঁজো বুড়িকে রাজ দরবারে হাজির করা হলো। সিপাহীর হাতে বন্দী বৃদ্ধা কুঁজো বুড়ি থরথর করে কাঁপছে। মন্ত্রী মশাই বলছেন, -এই তোমার কারণে, কতগুলো লোককে রাজ দরবারে হাজির করে অপমান করা হয়েছে। তাঁদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের কথা পর্যন্ত বলা হয়েছে।

তুমি যদি খারাপ কলসি না দিয়ে ভালো কলসি দিতে, তাহলে সেই কলসি ছিদ্র হয়ে বেশি পানি পড়তো না। আর ঐ দেয়াল তৈরির মাল মেডিসিনও খারাপ হতো না। তাতে করে দেয়াল মজবুত হতো। আর এতে আমাদের দেশের একটা চোরের অকাল মৃত্যু হতো না। অতএব, ঐ চোরের মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী। তোমাকে আজ ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হবে।

রাজা মশাই বললেন, -হ্যা বুড়ি। তুমি ভালো কলসি না দিয়ে ভুল করেছো। দুই নাম্বার কলসি সাপ্লাই দেওয়ার কারণে তোমাকে আজ ফাঁসির আদেশ দেয়া হচ্ছে। তবে হ্যা, ফাঁসিতে ঝুলার আগে তোমার কি কিছু বলার আছে?

বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে বললেন,

-মহারাজ। আমি আসলে কোন খারাপ কলসি তাদের দিতে চাইনি। আমি কাঁচা মাটি দিয়ে কলসি বানিয়ে তা পোড়ানোর জন্য যে কাঠ ব্যবহার করি, সেই কাঠ সাপ্লাই দিত বনের এক কাঠুরে। কিন্তু ঐদিন কাঠুরে আমাকে ভেজা কাঠ দিয়েছিল। ভেজা কাঠ দিয়ে মাটির তৈরি কলসি পোড়াতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল। খরচও বেশি পড়েছিল। তবু কলসি পোড়ানো ভালো হয় নি। এবার বলুন মহারাজ, সেইটা কি আমার দোষ ছিল নাকি কাঠুরের?

এবার রাজা মশাই আসল অপরাধীকে খুঁজে পেল। তিনি তাৎক্ষণিক সিংহাসন থেকে দাঁড়িয়ে বললেন,

-আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ কাঠুরে বেটাকে দরবারে এনে হাজির করা হোক। ঐ কাঠুরের অপরাধের জন্য আমি এই বৃদ্ধা বুড়ি মাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারি না। যাই হোক, এই বুড়ি আমার রাজ্যেরই সম্পদ।

সেনাপতি তার সৈন্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কোথায় সেই বন? যেখানে কাঠুরে কাঠ কাটে। খুঁজতে খুঁজতে সেনাপতির সৈন্যরা সেই বনের সন্ধান পেল। বনের ভেতর তল্লাশি করে তারা কাঠুরেকেও ধরে ফেলল।

নিয়ে আসা হলো রাজ দরবারে। এবার বুঝি কাঠুরের রক্ষা নেই। শত শত প্রজারা এসে রাজ দরবারে ভীর জমাতে লাগল। আজ প্রজাদের সামনেই কাঠুরের প্রাণদণ্ড দেয়া হবে।

আজ আর মন্ত্রী মশাই কাঠুরির প্রসঙ্গে কিছু বলছেন না। রাজা মশাই কাঠুরেকে দোষারোপ করলেন। কি কারণে কাঠুরে ভিজা কাঠ দিয়েছিল বুড়িকে। যার কারণে বুড়ির কলসি পোড়ানো ভালো হয়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটা চোর কিভাবে মারা গেল। রাজা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করলেন। অবশেষে কাঠুরেকে বললেন, 

-এবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। তবে তার আগে তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।

কাঠুরে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। রুগ্ন শুকনো দেহ। হাড্ডি মাংস যেন এক হয়ে মিশে গেছে। কঙ্কালের মতো শরীর নিয়ে বৃদ্ধ কাঠুরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইল। তার গলা শুকিয়ে আসছে, চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে সে অন্ধকার দেখছে। 

দীর্ঘক্ষণ কাঠুরের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে এবার মন্ত্রী মশাই বললেন,

-মহারাজ। এ কাকে ধরে এনেছেন?

-কেন, কি হয়েছে?

-মহারাজ, ওর শরীরে তো গোস্ত মাংস কিছুই নেই। ও তো এমনিই আধা-মরা হয়ে গেছে। ফাঁসির দড়ি বাঁধবেন ওর কোন জায়গায়?

রাজা বললেন, 

-হ্যা তাইতো? ও তো একদমই হালকা পাতলা এবং রোগাক্রান্ত। এক কাজ করা যাক। ওকে কিছুদিন রাজ দরবারে রেখে ভালো ভালো খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা যাক। তারপর না হয় ফাঁসির কাষ্ঠে চড়ানো হবে। কি বলেন মন্ত্রী মশাই?

মন্ত্রী বললেন, 

-আমার মনে হয়, সেটাও খুব একটা সুফল বয়ে আনবে না।

-কেন কেন?

-কারণ, ওর যা বয়স আর শরীরের যে অবস্থা। ওকে যতই ভালো খাবার খাওয়ানো হোক। ও আর মোটাতাজা হবে না।

-তাহলে কি করা যায় মন্ত্রী মশাই, বলুন তো।

-মহারাজ যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি বলছিলাম কি, যেহেতু রাজা মশাইয়ের মুখ থেকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন কোন না কোন ভাবে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। তাই বলছিলাম, এই রুগ্নো বৃদ্ধ কাঠুরেকে ফাঁসির কাষ্ঠে না ঝুলিয়ে আমরা কি খুঁজে দেখতে পারি না আমাদের রাজ্যো সবচেয়ে মোটাতাজা ব্যক্তি কে। যে কোন কাজ করে না। সারাদিন অলসতা করে। আর খেয়ে খেয়ে শরীরটাকে নাদুসনুদুস বানিয়েছে।

রাজা বললেন, 

-এমন লোক তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। 

মন্ত্রী বললেন, 

-আমাকে আপনি এক মাস সময় দিন জাহাপনা। আমার বিশ্বাস, কোথাও না কোথাও এমন লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে।

রাজা মশাই বললেন, 

-ঠিক আছে। আপনাকে এক মাস সময় দেয়া হলো। তবে এক মাসের মধ্যে যদি আপনি এরকম কোন লোক খুঁজে না পান তাহলে কিন্তু ঐ কাঠুরেকেই জীবন দিতে হবে। 

মন্ত্রী মশাই হ্যা সূচক মাথা নেড়ে রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছু পাইক পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে রাজ দরবার থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেন রাজ্যোর বিভিন্ন জায়গায়।

এদিকে গুরুর সাথে যে শিষ্য ভ্রমণে এসেছিল সে তো আর নিজের দেশে ফিরে যায়নি। এ রাজ্যে সকল খাবারের দাম সমান যেহেতু তাই সে, মুখরোচক সু্স্বাদু এবং ফ্যাট জাতীয় খাবার খেয়ে খেয়ে পেট ভর্তি করেছে। খেয়ে খেয়ে সে এত মোটা হয়েছে যে, কোন রাস্তা দিয়ে হেটে গেলে অন্য মানুষ যাওয়ার জায়গা থাকে না।

তাই সে একটি মফস্বল এলাকায় ছোট্র একটি বাজারের পাশে একটি ঘরে সে একাই থাকে। আর ঐ বাজার থেকেই ভালো ভালো খাবার কিনে খায়।

এদিকে মন্ত্রী মশাই তার লোক জন নিয়ে সারা দেশ তন্নতন্ন করে এমন একটা মোটা আর অলস লোক খুঁজে হয়রান। মোটামুটি স্বাস্থবান লোক যাও পায় তবে তারা অলস নয় কর্মজীবী।

এক মাসের আর একদিন বাকি। মোটা লোক খুঁজতে খুঁজতে মন্ত্রী মশাই এই মফস্বল এলাকায় চলে আসে। ক্ষুধা নিবারণ করতে মন্ত্রী তার লোকবল নিয়ে একটি হোটেলে গিয়ে বসেন। এমন সময় দেখে লম্বায় যতটুকু তার পাশেও প্রায় ততটুকু ভয়ানক মোটা এক ব্যাক্তি পুরো রাস্তা দখল করে এদিকেই আসছে।

লোকটা আস্তে আস্তে এসে মন্ত্রী যে হোটেলে বসে আছেন সোজা সেই হোটেলের ভেতর ঢুকলো। হোটেলের কর্মচারীরা এসে একপাশ থেকে চেয়ার টেবিল সরিয়ে মেঝের উপর একটি মাদুর বিছিয়ে দিল। মোটা লোকটি সেই মাদুরের উপর গিয়ে বসে পড়ল।

হোটেল বয় বিশাল আকারের এক গামলায় করে লোকটির জন্য খাবার নিয়ে এলো। খাবারের মধ্যে ছিল ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, শাক আরো অনেক কিছু। লোকটা খাওয়া শুরু করার আগে এক হোটেল বয় এসে লোকটার হাত ধুয়ে দিল। তারপর মাছের কাঁটা বেছে দিল, মাংসের হাড্ডি বেছে দিল। তারপর দুধ রেখে সমস্ত তরকারি দিয়ে ভাত মাখিয়ে দিল।

মন্ত্রী মশাই হোটেল বয়কে ডেকে শুধালেন তার ব্যাপারে বিস্তারিত।

-তুমি এরকম করলে কেন?

ছেলেটি বলল, 

-ঐ লোক সারাদিন ফলমূল খায়। আমাদের হোটেলে দিনে যখন একবার খেতে আসে তখন তাকে সকল প্রকার আমিষ দিতে হয়। খাবার শেষে তাকে মিষ্টিজাতীয় যত প্রকার আইটেম আছে, সব দিতে হয়। আর তাকে ভাত মাখিয়ে দেওয়া, মাছের কাঁটা বেছে দেওয়া ও মাংসের হাড্ডি বেছে দিতে হয় এই কারনে যে, সে তার নিজের হাতে এসব করলে তার অনেক পরিশ্রম হবে।

মন্ত্রীর সাথে থাকা এক পেয়াদা বলে উঠলো,

- তাহলে তো খাইয়ে দিতেও পারো। নিজের হাতে খাওয়াও তো তার জন্য পরিশ্রম। 

ছেলেটি বলল, 

-তা অবশ্য ঠিকই বলছেন সাহেব। তাকে খাইয়ে দিলেও খেত। কিন্তু সে বড় মানুষ বিদায় আমি এ কাজ করিনা। 

মন্ত্রী মশাই মনে মনে ভাবছেন, -এই রকম স্বাস্থবান অলস লোককেই তো আমি খুঁজছি। 

বাছাধন, খাও। ভালো করে খাও। এই খাওয়াই তোমার শেষ খাওয়া।

শিষ্য খাওয়া শেষ করে যখন হোটেল থেকে বের হতে যাবে তখন মন্ত্রীর লোকেরা তাকে সামনে দাঁড়িয়ে বাধা প্রদান করল।। শিষ্য আবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল - কি হয়েছে, কি করতেছো আমার সাথে?

মন্ত্রী বললেন, 

-সারা জীবন তো খেয়ে খেয়ে শরীরটাকে মোটাতাজা বানিয়েছো। এখন চলো রাজা মশাইয়ের কাছে। তোমাকে প্রাণদন্ড দেওয়া হবে।

-কিন্তু কি করেছি আমি। কি আমার অপরাধ?

-সেটা রাজ দরবারে গেলেই টের পাবে।

ঐ জামানায় যেহেতু ইন্জিন চালিত কোন গাড়ি ছিল না, তাই শিষ্যকে তুলে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।‌ তবুও ত্রিশ জন পেয়াদা মিলে খুব কষ্ট করে এতো ভারী একজন ব্যক্তিকে মাথায় করে নিয়ে চলল রাজ দরবারের দিকে।

পরদিন দরবার শুরু হলো। রাজা আদেশ করলেন এই অজানা অচেনা মোটাতাজা স্বাস্থবান লোকটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য। কিন্তু কেন, কি কারণে, শিষ্যের এ ধরনের প্রশ্নে কারো কোন কর্ণগোচর হলো না। শিষ্য কাঁদত লাগল। অবশেষে রাজা মশাই জানতে চাইলেন, তাহার কিছু বলার আছে কিনা?

শিষ্য কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি শুধু মহারাজের কাছে জানতে চাই, কোন অপরাধে আজকে আমাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে?

রাজা মশাই শিষ্যের ফাঁসিতে নিযুক্ত পন্ডিতকে স্ববিস্তারে বর্ণনা করতে বললেন।

কিভাবে এ রাজ্যের একটা চোর মারা গেল। সেই অপরাধে কেন একজন বাড়িওয়ালাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কি কারণে বাড়িওয়ালা খালাস পেল। তারপর একের পর এক ঠিকাদার, রাজমিস্ত্রী, হেল্পার, কুঁজো বুড়ি ও কাঠুরেকে কেন ধরে আনা হলো আর কেনইবা ছেড়ে দেওয়া হলো। আর কেনইবা সেই অপরাধের জের ধরে আজকের এই শিষ্যকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হচ্ছে, পন্ডিত তা বিস্তারিত বর্ণনা করলেন।

শিষ্য আবাক হয়ে ভাবতে লাগলো,

-এ আবার কেমন বিচার! একটা চোর চুরি করতে গিয়ে মারা গিয়েছে। তার জন্য রাজা মশাই আরেকজন মানুষকে হত্যা করবেন? আমি তো মনে করেছিলাম এ দেশে যেহেতু সবকিছুর দামই সমান এ দেশের রাজা মশাই খুব ভালো, ন্যায় বিচারক। যিনি ধনি-গরীব, চোর-স্বাধু, সোনা আর কঙ্করের মধ্যে কোন পার্থক্যই রাখেন না। 

তাহলে কি আমার গুরুর কথাই সত্য। আমার গুরু বলেছিলেন, যে সব জিনিসকেই সমান মূল্যায়ন করে সে সঠিক বিচারক নয়।‌ প্রত্যেকটা জিনিসের আলাদা আলাদা মূল্য থাকে। এজন্য প্রত্যেকটা জিনিসকে তার উপযুক্ত মূল্যই দিতে হয়। 

আমি আমার গুরুর কথা অমান্য করেছি। যে রাজা সঠিক জিনিসের সঠিক মূল্যায়ন বুঝে না, চিনি আর লবনকে সমান অর্থে মূল্যায়ন করে আমি তাকে ন্যায় বিচারক রাজা বলেছি। একারণেই তো আমার আজকের এই করুণ পরিণতি। মূর্খ বর্বর রাজা একটা চোরের জন্য আমার মতো একজন নিরাপোরাধী ভীনদেশী একটা ভালো মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে। 

হে গুরু। তুমি কোথায়? তুমি না বলেছিলে, যদি কখনো বিপদে পড়ি, তোমার নাম স্মরণ করতে। আমার আজ মহা বিপদ গুরু। তুমি কোথায় আছো? আমাকে রক্ষা করো।

শিষ্য মনে মনে এই কথা বলতে না বলতেই দেখা গেল একটি পাগল এদিকে দৌড়িয়ে আসছে। দরবারে উপস্থিত সকলেরই পাগলটার প্রতি দৃষ্টি পড়ে গেল।

পাগলটি সরাসরি ফাঁসির মঞ্চের কাছে গিয়ে শিষ্যকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

-এই নালায়েক পাপিষ্ঠ বান্দাকে এই ফাঁসির কাষ্ঠে কে দ্বার করিয়েছে?

দরবারের সবাই অবাক। পাগল বলে যাচ্ছে,

-কে সেই মূর্খ বিচারক, যে এই নরাধম, অপরাধীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে? সে কি জানে না, আজকের এই দিনে এই ফাঁসির কাষ্ঠে যাকে লটকানো হবে সে অপারে স্বর্গ লাভ করবে। সকলেরই বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল। 

রাজা মশাই বললেন,

-আমাদের তো আপনার মতো জ্ঞান নেই। এই মাত্র আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম আজ এই মঞ্চে যার ফাঁসি হবে সে স্বর্গ লাভ করবে। এখন কি করি বলুন তো?

পাগল বলল, 

-তোদের রাজ্যে কি ভালো মানুষ নেই যে স্বর্গের উত্তরাধিকারী?

এবার মন্ত্রী মশাই বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, 

-হ্যা হ্যা, আছে তো। সারা জীবন মহারাজের আদেশ মতো দেশ পরিচালনা করেছি। জীবনে কোনদিন কোন অন্যায় কাজ করিনি। আমার মনে হয় আমিই এই ফাঁসির কাষ্ঠে উঠার উপযুক্ত লোক। 

রাজা মশাই রাগান্বিত স্বরে মন্ত্রীকে বললেন,

-আপনি এই ফাঁসির কাষ্ঠে উঠার উপযুক্ত লোক হলে আমি কি করেছি। আমি কি কখনো কোন অন্যায় কাজ করেছি নাকি? তাছাড়া, আমি হলাম এ রাজ্যের রাজা। স্বর্গে যেতে হলে আমিই আগে যাবো।

মন্ত্রী বললেন, -আপনি গেলে রাজ্য পরিচালনা করবে কে, মহারাজ?

-কেন আপনি করবেন। আপনি মন্ত্রী থেকে রাজা হবেন। সেনাপতি হবে প্রধানমন্ত্রী। অসুবিধা কি।

-অসুবিধা আছে মহারাজ। আপনি হলেন এ রাজ্যের রাজা। প্রজারা কোনভাবেই মানবে না আপনার প্রাণদণ্ড। আর আমারও রাজা হবার ইচ্ছে নেই। তাই বলছিলাম এই ফাঁসির কাষ্ঠে আমারই প্রাণদণ্ড হোক।

রাজা চেঁচিয়ে বললেন,

-না তা কক্ষনো হবে না। এই ফাঁসির কাষ্ঠে আমিই উঠবো।

-না মহারাজ। এই ফাঁসির কাষ্ঠে আমিই উঠবো। 

-আপনি মন্ত্রী হয়ে রাজার মুখের উপর কথা বলেন? এই ফাঁসির কাষ্ঠে আমিই উঠবো।

 

রাজা আর মন্ত্রী দুইজনের মধ্যে এইরকম জেদাজেদি দেখে দরবারে উপস্থিত পন্ডিত, কবি, সেনাপতি সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল রাজা মশাই আর মন্ত্রী মশাই কাউকেই এই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হবে না। পন্ডিত মশাই বললেন,

-যেহেতু, রাজা মশাই এর একটা বৃদ্ধ মা আছে অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে উনি অসুস্থতায় ভুগছেন। আমার মনে হয় তাকেই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হলে সে ওপারে গিয়ে স্বর্গের ভিতর সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে।

পন্ডীতের কথা শুনে কবিও সাঁই দিল, কথাটা মন্দ নয়।

সেনাপতিও বললেন, তাই করা হোক। 

এবার রাজা মশাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন,

-তাহলে আমার মাকে এই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হোক।

মন্ত্রী মশাইও আর কোন কথা বললেন না। 

অবশেষে রাজার মাকেই ফাঁসিতে ঝোলানোর চুরান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

পাগল শিষ্যের হাত ধরে ফাঁসির কাষ্ঠে থেকে নামিয়ে দরবারের বাহিরে চলে গেল। দরবারের বাহিরে গিয়ে শিষ্য পাগলের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে এ যে তার সেই গুরু। যে তাকে বারবার এই দেশে থাকতে নিষেধ করেছিল। শিষ্য তখন গুরুর পায়ে পড়ে বলল,

-গুরুজী, আমাকে মাফ করে দিন। আপনার কথা অমান্য করার কারণে আজকে আমি মৃত্যুর মুখে পড়েছিলাম। আপনি সময়মতো না এলে এতক্ষনে আমার প্রাণ চলে যেতো।

গুরু বললেন,

-তোকে তো আগেই সতর্ক করেছিলাম যে, এদেশের রাজার বিচার ভালো না। তুই তো আমার কথা শুনিস নাই। এবার তো বুঝলি। 

এবার আমার সাথে চল। আমরা আমাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করি।

-ঠিক আছে, তাই চলুন গুরু।

অবশেষে তারা নিজ দেশে চলে এলো। এরপর থেকে শিষ্য আর কখনো গুরুর আদেশ অমান্য করেনি।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments
Md Samiul Islam - Oct 29, 2022, 3:18 PM - Add Reply

Content

You must be logged in to post a comment.

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ