আইসক্রিম : তাপসের ভোর হতেই ঘুম ভেঙে গেলো। ওর মনের ভিতর কেমন একপ্রকার আনন্দ দোল দিয়ে যাচ্ছে। গতরাতে কত কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ওর ঘুম এসে গেছে টের পায়নি ।
আজ বৈশাখিমেলা। বাবা বলেছে বৈশাখিমেলা দেখতে নিয়ে যাবে ওকে। আহা! কত মজা হবে। কত কিছু খাবে। দোলনায় চড়বে।
বাড়ির সকলে যাবে মেলাতে। ওরা বলেছে ওকেউ মেলাতে নিয়ে যাবে। না, ওর হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, ওদের সাথে যাবে না ও। বাবার সাথে যাবো। বাবা ওকে কত আদর করে। ওর কেন যেন মনে হলো, ওরা ভালো না, ওরা একটুও ভালোবাসে না ওকে।
মাথার চুলগুলো বেশ বড়ো হয়েছে। চুল ছাটানো দরকার। চুল ছাটাতে চল্লিশ টাকা। বাড়িতে যে কাইছি আছে, হ্যাঁ কাইছি দিয়ে চুল ছাটতে হবে। ভাবনা মতো ঘর থেকে কাইছি খুঁজে চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়িয়ে চুল ছাটার চেষ্টা করলো।
আচমকা হাতের ঠেলাতে ছোট আয়নাটা পড়ে ভেঙে গেলো। মা দৌঁড়ে এসেই রুটিবেলা বেলুন দিয়ে পিঠের উপর আচ্ছামতো বারি মারলো। ওমা বাবা গো ব’লে কেঁদে ওঠে, কাঁদতে কাঁদতে ঘরের বাইরে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
যখন দারিদ্রতা খেলা করে তখন দুঃুখ বসত করে অভাবের সংসার। কোনো কিছুই সহজে কেনা হয়ে উঠে না, তার পরও আয়নাটা ভাঙাতে মায়ের মেজাজটা তেলে বেগুনে হয়ে উঠলো।
বাবা শুয়ে আছে, বাবা মা’র কথার উপর কোনো কথা বলে না। মা বাবাকে শাসালো ‘খবরদার ওকে যদি মেলাতে নিয়ে গিয়েছো তো !’ বাবার কোনো প্রতিউত্তর নেই।
তাপস বুঝতে পারলো, বাবা আর বৈশাখি মেলাতে নিয়ে যাবে না ওকে। তাপস চোখর জল মুছে কাকার ঘরে ঢুকলো। কাকার ছেলে ও মেয়ে মেলাতে কী কী কিনবে তা বলাবলি করছে।
তাপস বললো, আমিও তোমাদের সাথে মেলা দেখতে যাবো। কাকা জামা-কাপড় লন্ড্রি করে ঘরে ঢুকলো। লন্ড্রি করা দেখে তাপসের মনে হলো ওর জামাটা লন্ড্রি করা দরকার।
ভাবনা মতো নিজেদের ঘরে এসে বাবার জামার পকেট হাতড়িয়ে এক টাকাও পেলো না। কী আর করা! হঠাৎ মনে হলো, এক সিনেমায় দেখেছে জামাপ্যান্ট থালা গরম করে লন্ড্রি করতে।
তাড়াতাড়ি আলনা থেকে জামা নিয়ে বিছানায় রেখে একটি থালা গরম করতে আগুনজ্বলা চুলার কাছে গিয়ে থালা গরম করে এনে যেমনি জামার উপর দিয়েছে তেমনি সাথে সাথে গোল মতো হয়ে জামার পেছন দিক পুড়ে গেলো।
তাপস ভয়েতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, হায় কপাল এ কী হলো! মা দেখলে তো মেরেই ফেলবে। তাপস তাড়াতাড়ি জামাটা লুকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ওর আর কোনো জামা নেই।
তাপসের খুব কান্না এলো, হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো, মা ঘরে ঢুকে দেখে তাপস কাঁদছে, মা’র মনে ছেলেরপ্রতি মায়া জাগলো, তাপসকে সান্ত¦না দিয়ে জামাটা সেলায় করে দিলো।
কিন্তু এমনভাবে পুড়ে গেছে তা সেলায় করেও পরার মতো হলো না। তাপস ঐ জামা কোনোভাবে গায়ে পরার চেষ্টা করলো।
ঐদিকে কাকার ছেলে মেয়ে লন্ড্রি করা জামা পরে বৈশখি মেলাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এখন বাড়ি থেকে রওনা হবার সময় যতক্ষণ। তাপসকে ডাকলো, তাপস জামাটা গায়ে দিয়ে ওদের সামনে যেতেই ওরা হেসে গড়াগড়ি দেবার অবস্থা।
তাপস খুব লজ্জা পেলো। এমন লজ্জা ও কোনোদিন পায়নি। ও বুঝতে পারলো ওরা অনেক গরিব। ভালো কিছু ওদের জন্য না। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সমান ক্ষমতা দেয়নি, দেয় না।
ওরা বৈশাখি মেলাতে চলে গেলো। তাপসের আর ইচ্ছা হচ্ছে না মেলাতে যাবার। ওর কেন জানি মনে হলো, বৈশাখি মেলা ওদের মতো মানুষের জন্যে না। তাপস ঘরে ঢুকলো। বিছানার উপর শুয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণ না যেতেই হঠাৎ ছোট বোন এসে বায়না ধরলো, ‘দাদাভাই চলো মেলাতে যাই। দাদাভাই চলো।’
মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বোনের আবদার রাখতে চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে তাপস ওর বোনকে নিয়ে বৈশাখি মেলাতে গেল। কত রকমের খাদ সামগ্রী। নাগরদোলা, পাপড়ভাজা, বিচিত্র কত প্রকারের মিষ্টি, মুড়িভাজা ইত্যাদি।
কী করবে পকেটে তো টাকা পয়সা নেই। বোন পাপড়ভাজা খেতে চাইলো। তাপস বললো, ‘পাপড়ভাজা খেতে হয় না, এই সব খেলে পেটে অসুখ হবে!’
বোন আবার বায়না ধরে, ‘তাহলে মিষ্টি খাবো।’
তাপস বলে, ‘হায়রে কপাল ঐ মিষ্টি খেলে তো পেটে ক্রিমি হবে!’
বোন বলে, ‘কত মানুষ খাচ্ছে!’
‘ওরা জানে না তো !’
‘হ্যাঁ, তুমিই সব জানো!’ ব’লে বোন মুখ ভাড় করে নিচু করলো।
‘শোন ঐ সব খাবারগুলো আমাদের জন্যে না, যাদের টাকা আছে তাদের জন্যে !’
‘আমার কাছে এক টাকা আছে!’
‘কই দেখি!’
বোন হাতের মুঠ খুলে, ‘এই দেখো।’ বলে বোন অট্টহাসি দিলো। তাপসও হাসলো। পৃথিবীটা যেন ওদের হাতের মুঠোয় চলে এলো। ওরা প্রতিটি দোকানে গিয়ে এক টাকার জিনিস চাইলো। কিন্তু এক টাকার কোনো জিনিসই হলো না।
মন ভাড় করে ভাইবোন হাত ধরাধরি করে মেলা থেকে বাড়ির পানে রওনা দিলো। কিছুক্ষণ পথ চলতেই দেখে আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে, বিক্রেতা উচ্চস্বরে বলছে, ‘এক টাকায় একপিচ।’ কথাটা শোনা মাত্র ভাইবোনের চোখে মুখে আনন্দ বয়ে গেলো।
আনন্দ যেন ভাইবোনের মনের কোণে উপচে পড়লো। খুশিতে এক টাকার কয়েন দিয়ে আইসক্রিম কিনলো। তাপস বললো, ‘বোন তুই খা।’
বোন বললো, ‘তুমিও নাও।’
তাপস লক্ষ্য করলো, আইসক্রিমের জল পড়ে যাচ্ছে।
তাপস বলে, ‘এক কাজ করি, তুই আইসক্রিমের উপর থেকে খা, আর আমি আইস ক্রিমের ঝড়ে পড়া জলটুকু খাই।
বোন আইসক্রিমর উপরের অংশ থেকে চুষতে লাগলো আর তাপস খেয়াল করলো আইসক্রিমের এক ফোটা জলও যেন মাটিতে না পড়ে।
ও মুখ নিচু করে ঝড়ে পড়া জল পান করতে লাগলো। আশপাশে কিছু মানুষ বেশ অবাক হলো, আইসক্রিম বিক্রেতার চোখে জল এলো, একটি আইসক্রিম বিনা টাকায় দিতে গেলো কিন্তু ওরা না নিবার না বোধক মাথা ঝাকাল।
You must be logged in to post a comment.