বসন্তের_রঙ_লাল

(১)" দেখুন  আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে আপনি আপনার প্রাণ হারাবেন। তাই যে কোনো উপায়ে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা ও করবেন না। "

ঝিলের কথা শুনে ভরকে গেল অভিনব। একটু আগেই মেয়েটি কে গুন্ডা দের হাত থেকে বাঁচালো। অথচ সেই মেয়েটির রিয়্যাকশন দেখে মনে হচ্ছে বাঁচিয়ে খুব ভুল হয়ে গেল।ঝিল বার বার হাতে থাকা শ্তেইলেস স্টিল পকেট নাইফ টা ঘোর পাক খাওয়াচ্ছে। চোখের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ ভয় পেয়েছে। অভিনব আগালো না। দূর থেকে বলল

" আমাকে দেখে গুন্ডা মনে হয় আপনার?"

" হতে ও পারেন। "

" আশ্চর্য! এই যে এতো গুলো বদ লোকের থেকে আপনাকে সেইভ করলাম। সেটা কি মিথ্যে? "

" হতে ও পারে। "

" আপনাকে নিয়ে তো মহা মুশকিল। প্লিজ ডোন্ট বি পেনিক। "

অভিনবর আশ্বস্ত করা বাক্যে ভরসা পেল না ঝিল। ছেলেটা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বলল

" হেয়ার আর মাই ইনট্রুডিউজ। যেখানে স্পষ্ট ইংরেজি হরফে লেখা আছে আমার নাম অভিনব সরকার ইহান। আমি একজন ট্রাভেলার। যে কি না ৩৫ টি দেশে ভ্রমণ করেছে। "

অভিনব সরকার ইহান নাম টি শুনেই বুকের ভেতর ছ্যত করে উঠলো। ঝিল আঁধার থেকে আলো তে এলো এবার। এখন ছেলে টার মুখ স্পষ্ট। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো ঝিল। বার বার মুখে হাত দিচ্ছে, বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন। 

" আর ইউ ওকে মিস? আপনি এমন করছেন কেন। লিসেন আমি আপনাকে টাচ ও করবো না। দেখুন আমি আরো দূরে সরে যাচ্ছি। "

ঝিল এখনো কেমন করছে। অভিনব বিষয় টা বুঝতে পারলো না। ওর মনে হলো মেয়েটি মানসিক ভাবে অসুস্থ। ঠোঁট দুটো উল্টিয়ে কামড়ে রইলো তাই। কয়েক মিনিট পর শান্ত হলো ঝিল। চোখ মুখ যেন আলোকিত হয়ে আছে। সামান্য ভাঙা কন্ঠে বলল

" আপনি ই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া সেই অভিনব সরকার ইহান? "

" জী। কিন্তু আপনি এমন করছেন কেন? "

পাকা রাস্তাতে বসে পরলো ঝিল। খুশি তে চোখ থেকে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সেই স্বপ্ন পুরুষ অভিনব? যাঁর ছবি বুকের মাঝে গেধে আছে সার্বক্ষণিক। ঝিলের আচারণ অদ্ভুত ঠেকলো।

বাতাবরণ মিহি শব্দ তুলেছে। বোধহয় বৃষ্টি নামবে। তবে অসময়ের বৃষ্টি বেশ ভালো লাগে ওর। তাই আপাতত চোখ বন্ধ করে মেঘের ডাক অনুভব করতে লাগলো। ঝিল এতোক্ষণ পর নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো।

ইস সে কি ভুল টাই না করে ফেলেছে। চট জলদি উঠে বসলো মেয়ে টি। লজ্জা আর আড়ষ্ঠতা কাজ করছে খুব। তবু ও বলল

" আম স্যরি। আমি আসলে খুব ই খুব নার্ভাস ছিলাম। তাই এমন টা করে ফেলেছি। "

ঝিলের কন্ঠ কর্ণপাত হলো না ছেলেটার। সে ব্যস্ত প্রকৃতির সান্নিধ্য অনুভবে। ঝিল সেটা লক্ষ্য করে তাকালো। ভিডিও তে দেখেছিলো অভিনব কে। ঠিক একই ভাবে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতি কে অনুভব করে।

কি সুন্দর তাঁর অনুভব শক্তি। ঝিল হারিয়ে গেল তাঁতে। ইতো মধ্য কয়েক টা হার্ট বিট মিস হয়েছে ওর। এভাবে থাকলে হয়তো মরেই যাবে।

বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে। চোখ মেলে তাকালো অভিনব। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি এখনো কাঁপছে। মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে খুব বেশিই চমকিত। কাছে আসলো অভিনব। হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

" হ্যালো মিস, আমি অভিনব সরকার ইহান। আপনি? "

" ঝিল, অহনা মির্জা ঝিল। "

নিজের পরিচয় দিলে ও হাত মিলালো না সে। বিষয় টা তেমন পাত্তা দিলো না অভিনব। ঠোঁটের হাসি টা আরেক প্রশস্ত করে বলল

" ভয় পাবেন না প্লিজ। না হলে আমার লজ্জা লাগবে। "

ছেলেটার মুখ থেকে কথা টা অদ্ভুত শোনালে। অভিনব যে কি না ইতো মধ্যেই ৩৫ টি দেশ ভ্রমণ করেছে। হাজারো মানুষের সাথে স্বাক্ষাৎ হয়েছে সে পাবে লজ্জা। বিষয় টা খুব বিস্ময়কর। 

" কোথায় ডুবে গেলেন মিস ঝিল? "

" না মানে, আমি আসলে একটু বিস্মিত। "

ঠোঁট উল্টিয়ে হাসলো অভিনব। এমন টা প্রথম নয়। এর আগে ও বহু সংখ্যক নারী তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে বিস্মিত, হতবাক, কিংবা চমকিত হয়েছে। তবে সামনে থাকা বাচ্চা মেয়েটি সবার থেকে একটু আলাদা। হয়তো বাঙালি বলেই।

" আমরা কি সামনে এগোতে পারি? "

" ইয়া সিওর। "

ঝিলের সহজ উত্তর। এখন কিছু টা সহজ হয়েছে মেয়েটা। অভিনব প্রশ্ন করলো

" এই ঘন রাত্রী তে গহীন জঙ্গলে কি করছেন? "

" আমি আসি নি, আমাকে নিয়ে এসেছে ওরা। "

" সেটা তো বুঝলাম। তবে এই রাস্তা তে কি করছিলেন? "

" না মানে, আমি "

তুতলে যাচ্ছে ঝিল। মনে হচ্ছে কথা গুলো বলতে চায় না। অভিনব শুধালো

" বয়ফ্রেন্ড কেইস? "

" এই না, একদম ই নয়। আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। "

" আহা থাকতেই পারে। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। "

" না সত্যিই নেই। "

কথা টা শেষ করে মুখ গোমড়া করে ফেললো মেয়েটি। যেন একরাশ ঘন কালো আঁধার এসে ওর চোখে মুখে ছুঁইয়ে গেছে। অভিনবর ধারালো দৃষ্টি লক্ষ্য করলো সেটা। হাসি পাচ্ছে ওর। সহসা এমন মেয়ে মানুষের দেখা মেলে না। যার কিনা প্রতি ক্ষনে ক্ষনে মুখের ভঙ্গিমা বদল ঘটে।

অন্য মনস্ক ঝিল হোঁচট খেয়ে পরে যাচ্ছিলো। খপ করেই মেয়েটির বাহু খামচে ধরলো অভিনব। কিছু টা রাগি কন্ঠেই বলল

" কি করছেন টা কি। মন, ধ্যান, জ্ঞান সমস্ত টা বসন্তে হারিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। বসন্ত জড়িয়ে নিজেকে ভুলে গেলে হবে?"

লজ্জা পেল ঝিল। অভিনবর কঠোর বাক্য গুলো শুনে নয়। বরং অভিনব কে এতো কাছ থেকে অনুভব করতে পারায়। ঝিলের মাথা টা অভিনবর বুক বরাবর। মিহি একটা ঘ্রান নাকে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে সত্যিই বসন্ত এসে গেছে। লজ্জায় লাল বর্ণের আভা ছড়িয়ে গেল ওর সর্ব মুখে।

অভিনব নিজে ও চমকিত হলো এবার। মেয়ে টির বাহু ছেড়ে দিয়ে কিছু টা দূরে দাঁড়ালো। শুকনো দুটো ঢোক গিলে তাকালো আড় চোখে। শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও। এমন কেন হচ্ছে? আগে কখনো এমন নার্ভাস ফিল হয় নি তো। তবে সত্যিই কি বসন্ত এসে গেছে?

(২) এক রাশ মন খারাপ নিয়ে ট্রেরেস এ বসে আসে ফারাবি। মন খারাপ হবে নাই বা কেন? এই যে কলেজ থেকে বসন্ত উৎসব নিয়ে সফর করবে। অথচ এক মানব তাকে যেতে দিচ্ছে না। কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। রিমি নিজেও ব্যথিত। তাঁর ভাই টা এমন কেন?

" মন খারাপ করিস না জানু। দেখবি পরের বছর ঠিক ই যেতে পারবি।"

" হুম যেতে পারবো সেটা হলো ম,রার পর। বিগত চার বছর যাবত এমনি হচ্ছে আমার সাথে নেক্সট ইয়ার, নেক্সট ইয়ার করা হয়। তবে নেক্সট টা আর আসে না। "

মুখ টা চুপসে গেল রিমির। গালে হাত দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ফারাবি। ইস সত্যিই তো সব শখ কি কর্পূরের মতো উঁবে যাবে নাকি? ভগ্নহৃদয় নিয়ে চলে গেল রিমি। ভাইয়ের সামনে কথা বলার শক্তি ওর নেই।

রিফাতের সাথে মনিকার দ্বন্দ্ব লেগে গেছে। মনিকার দাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বসন্ত উৎসবে নিয়ে যেতে হবে। অথচ রিফাত এতো ঝামেলা পোহাতে চাচ্ছে না। ফোনে এক চোট লেগে গেল দুজনের। কল কেঁটে ফারহানের কাছে এলো সে। হতাশার নিশ্বাস পেরিয়ে বলল

" প্রেম, এই প্রেম হলো একটা প্যারা। চাই না গার্লফ্রেন্ড। অসহ্য হয়ে গেছি আমি। "

সিগারেটে শেষ টান দিলো ফারহান। তবে নিরুত্তর রইলো। ওর ইচ্ছে করছে না উত্তর দিতে। রিফাত এবার ঝাঁঝ নিয়ে বলল

" তুই কি শুনতে পাস না আমার কথা? "

" হুম শুনলাম। "

" কি শুনলি? "

" তোর প্রেম কাহিনী। "

" প্লিজ ইয়ার কোনো সমাধান দে আমায়।"

" ব্রেকআপ কর। "

" আশ্চর্য! "

গা দুলিয়ে হাসলো ফারহান। সিগারেট খাওয়া আঁধ কালচে ঠোঁট টা সামান্য প্রসারিত হচ্ছে আবার সংকুচিত হচ্ছে। ছেলেটার মুখ মন্ডলে সহসা হাসি দেখা যায় না। এই হাসি বিরল, এই হাসির মোহ অন্তহীন।

ফরহাদের হঠাৎ বিশেষ আহ্বান এর কারন বুঝতে পারলো না ফারহান। তবে ভেতরে ভেতরে কিছু আশংঙ্কা হচ্ছে। রুমের কাছে গিয়ে নক করলো সে। ওপাশ থেকে শীতল এক কন্ঠ কানে এলো 

" ভেতরে আসো ফারহান। "

" জী আব্বু। "

" বসো। "

সামনে থাকা আসন টি তে বসলো ফারহান। ফরহাদ অ্যালকোহল যুক্ত ওয়াইন পান করেন না। তবে নন অ্যালকোহল বিয়ার পান করেন। ফারহান সে দিকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল

" আব্বু তুমি বিয়ার পান করবে না আর। "

" কেন বলো তো? "

" অস্বাস্থ্যকর। "

" মাঝে মাঝে খেতে হয় ফারহান। যাঁরা বিজনেস করে তারা সবাই বিয়ার নেয়। "

কথা বললো না ফারহান। প্রতি বার ই এমন উত্তর করেন তিনি। ফারহান কে এক গ্লাস অফার করলো তবে ফারহান সেটা নিলো না। বরং দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। তিন গ্লাস শেষ করে ফরহাদ বললেন

" আমরা সবাই জানি ফারাবি কে পছন্দ করো তুমি। তাই বলে ওর নির্দিষ্ট একটা স্পেস আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে না। "

" ওর কোনো স্পেস নেই আব্বু। "

অতি শীতল কন্ঠে কেঁপে উঠলেন ফরহাদ। ছেলের কন্ঠে অধিকার ফুটছে। কেন যেন ভালো লাগলো ওনার। এতোক্ষণ তেমন মনোযোগ না দিলে ও এবার পূর্ণ মনোযোগ ফেললেন তিনি। ফারহানের চোখ জোড়া সজল হয়ে আছে।

তিমিরে ফোঁটা আলোর মতোই ঝলকানি আসে। কম্পিত হলেন তিনি। নিজের ছেলে কে এভাবে খুঁটিয়ে কখনোই দেখেন নি তিনি। তবে আজ মনে হলো প্রচন্ড ভুল হয়ে গেছে।

" আর কিছু বলবে আব্বু? "

" না। "

ফারহান উঠে আসলো। এমন টাই আঁচ করেছিলো সে। তবে ফারাবির বিষয়ে ওর উত্তর সব সময় অন্য রকম।

" ছোট কাকি, ছোট কাকি কোথায় তুমি?"

ফারহানের কন্ঠে ছুটে এলেন ফারাবির মা। ভদ্র মহিলা বেশ ভালোবাসেন ওকে। ফারহান অভিযোগের কন্ঠে বলল

" বাসায় বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে আর আমায় জানালে ও না? "

" ভুল হয়ে গেছে বাবা। তুই ঘরে যা, আমি খাবার নিয়ে আসছি। "

" হুম ঠিক আছে। আচ্ছা ফারাবি কোথায়? "

" অভিমান করেছে খুব। দেখ হয়তো ছাঁদে গিয়ে বসে আছে। "

একটু ভাবলো ফারহান। তারপর ই কিচেনে গিয়ে বিরিয়ানি নিয়ে এলো। ওর আচারণ দেখে মৃদু হাসলেন ফারাবির মা। 

দোলনায় পা উঠিয়ে বসে আছে ফারাবি। মন টা ভীষন খারাপ। সব সময় ফারহান এমন করে। কেন এতো অধিকার ফলাতে আসেন তিনি? ভালোবাসা কি এক দিক থেকে হয়। ফারহান কে কখনো কি বলেছে আমি ও আপনাকে ভালোবাসি।

তবু ও এই মানব অধিকার দেখাতে আসেন। খুব রাগ হচ্ছে ওর। ইচ্ছে হচ্ছে ছাঁদ থেকে পরে যেতে। না থাকবে ও আর না থাকবে হবে কারো সমস্যা।

" ছাঁদ থেকে ফেলে দেই? "

বিহ্বল হয়ে গেল ফারাবি। মনের কথা মনেই রয়ে গেছে অথচ এসে পরেছেন সে। পেছন ঘুরে তাকানোর সাহস হলো না। এতোক্ষন রাগ হলে ও এখন ভয় হচ্ছে খুব। ফারহান মানেই বাঘের মতো গর্জন, শেয়ালের মতো বিচক্ষণ আর ঈগলের মতো দৃষ্টি। সব মিলিয়ে কোনো বিশেষ ধরনের প্রানী।

ফারহানের উপস্থিতি খুব কাছে অনুভব হতেই বুকের ভেতর ধিম ধিম আওয়াজ হতে লাগলো। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড বুক চিরে বেরিয়ে আসবে।

" কি হলো ফেলে দেই তোকে? "

" ভয় পাই না আমি। "

" আচ্ছা এতো সাহস? "

" কেন ভয় পাবো আপনাকে? কে আপনি যে ভয় পেতে হবে। "

মেয়েটার কন্ঠে রোষ গলে গলে পরছে। মনে হচ্ছে বহু চেষ্টার পর বাক্য গুলো উচ্চারণ করেছে সে। ফারহান খাবার টা সাইট করে রেখে একটু আগালো। অনেক চেষ্টার পর চোখ দুটো খোলা রেখেছিলো মেয়েটা।

তবে ফারহানের অনাকাঙিক্ষত কান্ডে চোখ খুলে রাখতে পারলো না। তির তির করে ঘামছে ফারাবি। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে কেবলি হাসলো ফারহান। সন্তপর্নে কপালে চুম্বন এঁকে বলল

" যেদিন অধিকার দিবি সেদিন ই স্বাদ নিবো। "

লজ্জা কি বস্তু তা জানা নেই ওর। তবে এই মুহূর্তেই ম'রে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকাতে ও পারছে না। ওর অবস্থা বেশ উপভোগ করছে ফারহান। মানুষের সর্বসুখ তো ভালোবাসাতেই। এখন অপেক্ষা শুধুই বসন্তের।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles