ছোট গল্প ( short story )

গল্প: হৃয়দের কথা

আমি অপেক্ষায় ছিলাম। সেকেন্ড মিনিটে, মিনিট ঘন্টায় উপনীত হলো। আচমকাই কালো মেঘ জড় হল হৃদয়ে। বেলা শেষ হয়ে এলো।

গোধূলির পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে গাড় নীল আকাশের বুকে। আমি মাটি খামচে শক্ত হয়ে আছি। নিজকে

মূর্তি বানিয়ে ফেলেচি ইতিমধ্যে। দিনটা রাতে পরিবর্তন হলো। আঁধার রাতে আকাশের বুকে আলোর পরীটা ভীষণ সুন্দর রুপে এসেছে।

তবে আমার কোন অনুভূতি নেই। চোখের কোনে চিকচিক করছে নোনাজল। নিজেকে তখনও মজবুত ভাবে আঁটকে রেখেছি নিজেতে। না! একফোটা জলও পড়তে দেওয়া যাবে না।

রাত পেরিয়ে সকাল হলো। আমিও তখনও অপেক্ষায় ছিলাম। পেরিয়ে গেল ২৪ ঘন্টা।  আমি আর সামলাতে পারলাম না। অঝরে কাঁদতে লাগলাম।

আমার পরিবার আমায় খুঁজতে খুঁজতে আমায় পেয়ে বাসায় নিয়ে এলো। সবাই জানতে চাইলেও আমি কিছুই বলতে পারিনি। আমি শুধুই কেঁদে গেলাম।

আরো ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেল। আমি এবার থমকে গেলাম। মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করত।

পেরিয়ে গেল ২৪ টা বছর মানসিক হাসপাতালে। আমি রিলিজ পেলাম। আমায় বাসায় আনা হলো। আমার অতীতটা কেমন ছিল? কি ছিল জানি না। জানা নেই। 

শুধু জানি, সেদিন অপেক্ষায় ছিলাম।  আজও অপেক্ষায় আছি। হয়ত আমরণ থাকব। কিন্তু কার অপেক্ষায় আছি? সে দেখতে কেমন? কে সে? কি সম্পর্ক তার সাথে? প্রতিটা প্রশ্নই উত্তর বিহীন। আমার কিছুই মনে নেই অতীতের।

কথাগুলো বলে চলে যেতে লাগল নয়না। নাবীদের চোখজোড়া ছলছল করছে। ২৫ বছর পর সেই চিরো চেনা মুখটা দেখতে পেল।

সেই মানুষটা তার অপেক্ষার গল্পটা শুনিয়ে গেল, অথচ তাকেই মনে নেই! কি হয়েছিল সেদিন, কেন আসতে পারিনি? সবটা বলতে হবে নয়নাকে।

আমি ওকে সবটা বলব। ওর জীবনটা নষ্টের জন্য আমিই দায়ী। হ্যা আমিই দায়ী। নাবীদের পাশ থেকে আরোহি বলে উঠল -

তুমি ওকে চিনো?

হুম, চিনি। তার আগে বলো তুমি কি করে চিনো?

কিছুদিন আগেই ওরা এই শহরে এসেছে। মেডিকেল রিপোর্ট করতে কিছুদিন আগে যখন ডাক্তার শেহনাজের কাছে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই পরিচয়।

তুমি বলায় ওকে ডাকলাম। আর ওর জীবনের গল্প শুনতে চাইলাম। জোর করলাম।

হ্যা আরোহি, এই সেই মেয়ে যাকে ২৫ বছর আগে আমি ঠকিয়েছিলাম। আর তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।

তার মানে..

মানেটা এখনো বুঝতে পারছো না?

আরোহির পায়ের তলায় জমিন যেন সরে গেল। আসমান বিদীর্ণ হয়ে মাথায় পরতে লাগল। আরহির খুব কষ্ট হচ্ছে বুকে ব্যাথা করছে। নিজেকে সামলিয়ে আরোহি বলল,  আমি পুরো গল্পটা জানতে চাই।

নাবদী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল। আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা। বয়সটা কম ছিল। কিছুটা আড্ডাবাজ ছিলাম। গল্পটা তখনের। আমি অনার্স 3rd ইয়ারে পড়ি।

আর নয়না তখন ইন্টার 1st ইয়ারে। একদিন ক্যাম্পাসে বসে আমি তরিকুল আর শুভ আড্ডা দিচ্ছিলাম। শুভ আমায় বলল, তরিকুলের ও গার্লফ্রেন্ড আছে আমারও আছে খালি নেই তোর।

তুই কি হিজরা। ওরা হাসাহাসি শুরু করল। আমার মেজাজটা প্রচুর খারাপ হলো, আমি চ্যালেঞ্জ করে বসলাম, "আমি আগামী ২৪ ঘন্টায় গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে দেখাব" আমি উঠে বাসায় গেলাম।

২/৩ টা কলেজের পরিচিত মেয়েকে ফোন করে গার্লফ্রেন্ডের অভিনয় করতে রিকুয়েষ্ট করি। টাকাও দিতে চাই, তবুও তারা রাজি হয় না। অবশেষে নিরাশ হয়ে তানিকে কল দেই।

হ্যা নাবীদ বল

তানি একটা হেল্প করবি?

কি হেল্প?

আমার গার্লফ্রেন্ড হবার অভিনয় করবি কিছুদিনের জন্য?

নাহ পারব না।

প্লিজ তানি

ওরে গাধা

কি

আমার কেন অভিনয় করতে হবে। কলেজে আসার সেই শুরুর দিন থেকে নয়না তোরে এত ভালোভাসে তুই ত মেয়েটার দিকে তাকাসও না।

জানিস ও না নয়না নামে কেউ আছে কি না? অথচ পুরা ক্যাম্পাস ওর জন্য পাগল আর ও তোর জন্য পাগল। তোকে সাহস করে বলতে পারে না। 

আমি ভ্যবাচেকা হয়ে বললাম, বলিসটা কি?

ঠিকই বলছি। আচ্ছা বাই একটু কাজ আছে।

আচ্ছা শোন, কাল নয়নার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিবি?

আচ্ছা দিব।

পরের দিন... 

ওই তানি

হুম বল

মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম নয়না..ইয়ে মানে, না মানে, যদি একটু কথা বলিয়ে দিতি।

আচ্ছা ছুটির পর বকুলতলায় চলে আসিস।

থ্যাংকস দোস্ত।

তানি মুচকি হেসে চলে গেল।

ছুটির পর চলে আসলাম বকুল তলায়। একি! এটা মেয়ে নাকি পরী? কি মায়া ঐ কাঁজল কালো আঁখি জোড়ায়! নীল গাউন, নীল চুড়িতে অপূর্ব সুন্দরী লাগছে। আমি নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে আছি। তানির কথায় ঘোর কাটল

নয়না ও নাবীদ আমার বন্ধু। আর নাবীদ ও নয়না আমাদের জুনিয়র। বাকী পরিচয় তোরা সেরে নে আমি চললাম। লেট হলে আজ বাসায় ঢুকা বন্ধ। আমি বললাম 

চলো।

একটু থতমত খেয়ে নয়না আস্তে করে বলল, কোথায়? 

বলতে চাইছিলাম, তোমার আমার বাসার রাস্তা ত একই, আজ না একসাথেই যাই?

ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

রাস্তায় টুকটাক কথা হলো। এরই মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওর বাসার খুব কাছে। ও বলল, কিছু মনে করবেন না আমি একাই যেতে চাই বাকী পথটুকু।

বাসার কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। এটুকু বলে ও হাঁটতে ধরল। আমি পেছন থেকে ডাকলাম ওকে

নয়না..

জ্বী.. কিছু বলবেন

নাহ

ও আবার হাঁটতে শুরু করল

আমি আবারও ডাকলাম, নয়না...

জ্বী... 

তোমার ফেসবুক আইডিটা সার্চ দিয়ে দিবে? ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম

ও আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ওর আইডি বের করে দিয়ে চলে গেল

বাসায় যেতে যেতে ম্যাসেজ করলাম, ফ্রেশ হয়ে একবার বেলকুনিতে আসবে? প্লিজ

আমি ফ্রেশ হয়ে আমার বেলকনিতে দাঁড়ালাম। ভাবতে লাগলাম, কিরে নাবীদ এতটা বেখেয়ালী কবে থেকে হলি? সামনের বেলকনিতে এত সুন্দর পরী থাকতে এত বছরেও নজর পড়ল না।

তানিটাও আগে যে কেন বলল না? ভাবনার মাঝেই এসে পড়ল হলদে পরী। আমার মায়াবতী।

আমি অপলক চেয়ে রইলাম রাস্তার ওপারে। এক অজানা মায়ায় বাঁধা পরলাম।

ও ইশারায় কিছু একটা বুঝালে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালাম, মৃদু হেসে রিপ্লে দিলাম তোমাকে যতই দেখি তৃষ্ণা মেটে না তাই আবারও দেখতে ডাকলাম বেলকনিতে। 

এরপর দিনে দিনে আসক্ত হলাম একে অন্যতে। ও আসক্ত হলো ভালোবাসায়, আমি হলাম ছলনায়। ওর ভালোবাসায় খুঁত ছিল না, আমার ছলনাও ছিল নিখুঁত। আমার মস্তিষ্কে ছলনার জাল বিছানো ছিল। মনের খবর ত আজও অজানা।

কয়েক মাসেই ওর পাগলামিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। ও কোন প্রশ্ন করত না। কি করি না করি? কয়টা মেয়ে ফ্রেন্ড আছে? ফ্রেন্ড নাকি গার্লফ্রেন্ড? ঘুরে নিতে হবে। এটা কোন করোনি?

ওটা কেন করলে?   কোনরকম কোন প্যারা দিত না। আমার আঘাত লাগলে জল আসত ওর চোখে৷ আমার চেয়ে ও বেশি কষ্ট পেত।

ওর কাছে পেতাম মানসিক শান্তি, অফুরন্ত ভালোবাসা। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এমন একটা মেয়েকে পেলে যে কেউ হবে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ । 

সেদিন আমাদের সম্পর্কের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো ক্যান্টিনে। ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে।

আমার শার্ট ভিজে গেল ও আঁখিজলে। আমি দু'হাতে ওর মুখটা উঁচু করে তুলে বললাম, কি হল পাগলী? কাঁদছ কেন? ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

কোনরকম কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, আমার বাসায় বিয়ের জন্য প্রস্তাব এসেছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে।  যদি হারিয়ে ফেলতে হয় আপনাকে? ও আবার আমার বুকে লুকালো। শক্ত করে জড়িয়ে রাখল আমায়।

ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম, বিয়ে করবে আমায়?

ও কান্নাজড়িত কন্ঠে অস্ফুটস্বরে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। 

আমি বললাম কাল দশটায় বকুল তলায় অপেক্ষায় থেকো।

ও আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার ভয় হচ্ছে খুব। হারিয়ে ফেলব নাতো আপনায়?

আমি ওকে অভয় দিয়ে বাড়ি পাঠালাম।

ও ছিল অপেক্ষায়। আমি পাড়ি দিলাম অজানায়। বাসায় এসেই জানতে পারলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে৷ তারা নাকি ছোটবেলায় আমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল ৷

আজই আমাদের যেতে হবে লন্ডনে। এবং সেখানেই কাল আমার আর আরোহি নামের মেয়েরটার বিয়ের পর বাবার বন্ধু সাইন করবে সেই ডিলটায় যার স্বপ্ন অনেকগুলো বছর ধরে দেখছে আমার বাবা।

সেদিন স্বর্থপরের মত দেশ ছেড়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও হয়ত খুঁজে নিবে অন্য কাউকে । সুখী হবে আমার মতনই অন্য কাউকে নিয়ে। 

কিন্তু আমি ভুল গিয়েছিলাম, ওর অনুভূতি ছিল ভালোবাসা, আর আমার অনুভূতি ছিল ছলনা।

ছলনায় দিব্যি ভাঁসা যায় সুখের নদীতে

এ কূল ভেঙ্গে প্রশান্তি শুধায় ওকূলে,

ভালোবাসায় জর্জরিত হৃদয় জানে বিচ্ছেদের অহসনীয় যন্ত্রণা

মৃত্যুর স্বাদ জাগে, স্মৃতিভ্রম হয় কি রাত? কি দিবা?"

আরোহি সত্যি বলছি আমি আজও জানি না আমার হৃদয়ে কি ছিল? ভালোবাসা? নাকি শুধুই ছলনা? 

৫ বছর পর..

সেদিনের পর আজও আরোহি আর ফেরেনি নাবীদের কাছে। বৃদ্ধ বয়সেও ভীষণ একলা কাটে প্রহরগুলো। একবার অবশ্য এর মাঝে বার্ধক্যের পীড়া ভরি হওয়ায় হসপিটালে কিছুদিন ভর্তি হতে হয়েছিল৷ তখন আরোহি এসে পাশে বসেছিল। বলেছিল -

এটাই তোমার নিয়তি নাবীদ। সে ত ২৪ টা বছর হাসপাতালে কাটিয়েছে। আর আজও একাকীত্বের বিষম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

এটাই তোমার শাস্তি। এটাই নিয়তি। আমি চাইলেও এখন আর তোমার কাছে আসতে পারি না, হয়ত পারবও না। এর পরই সে চলে গিয়েছিল। 

অসুস্থ শরীরে গুটিগুটি পায়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আজও জোৎস্মা! কোন একদিন বকুল তলায় কাঁধে মাথা রেখে  নয়না বলেছিল, জোৎস্না তার খুব পছন্দের রজনী।

কোন এক রাতে সে আমার সাথে জোৎস্না দেখতে চেয়েছিল। সে ত কখনই জোৎস্না দেখতে ভুলত না৷ আজও কি ভুলেনি? নাকি সময়ের স্রোত বদলে দিয়েছি অনিভূতিগুলো। পুরাতন অভ্যাস?

অপর প্রান্তে..

না ভুলিনি আজও জোৎস্না দেখতে।

শুধু তোমায় ভুলেছি। না তোমায়ও ভুলিনি। সেদিন ত আরোহির পাশে অন্য কেউ ছিল তোমার মত গড়ন তার৷ আমি জানি ওটা তুমি নও ৷

আমার নাবীদ আমায় ঠকাতে পারে না৷ তাই তো আমি চজও অপেক্ষায় আছি। সে আসবে বলে..

বরাবরের ন্যায় আজও গিয়েছিলাম জোৎস্মায় ভাঁসা রজনীতে খোলা আকাশের নীচে জোৎস্মা বিলাসে

তখনই জোৎস্মা ছড়ানো চন্দ্রিমা প্রশ্ন ছুঁড়লো, কতবার দেখেছি তোমায়, অশ্রুসিক্ত আঁখিতে। তুমি ক্লান্ত হও না? তুমি ক্লান্ত হও না?

একটা প্রশ্ন, নিজের সমীপে নিজেই শুধাই, তুমি ক্লান্ত হও না?

অপেক্ষা অধিকতর সহজ ভুলে যাবার চেয়ে, তাই হয়ত।

আচ্ছা আপনাদের সকাশে একটা প্রশ্ন, ভালোবাসা মানে কি?

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles