রহস্যজনক (গল্প গাছে দাঁড়াবেন না।)

“গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না!” পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি চিৎকার করে উঠলো। আমি চমকে উঠে তাকালাম।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

ভেবেছিলাম কথাটা আমাকে বলেছে। কিন্তু দেখলাম যে মেয়েটি আমার পেছনে দাঁড়ানো বন্ধু জহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। 

জহির পাল্টা জবাব দিলো, “কই দাঁড়াবো তাহলে? এতো সমস্যা হলে পাবলিক বাসে চড়েন কেন? বাপরে বলেন আপনারে একটা প্রাইভেট কার কিনে দিতে”। 

আমি তাকিয়ে দেখলাম জহিরের ডান দিকে খানিকটা সরার মতো স্পেস আছে। তারপরও জহির অনেকটা ইচ্ছে করেই মেয়েটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি চোখের ইশারায় জহিরকে সরতে বললাম। জহির শুনলো না, ঠোঁট নাড়িয়ে যা বললো, তার অর্থ দাঁড়ালো- “মজা দেখতে থাক!” 

চলতে চলতে বাস একটু ঝাঁকি খেলো। আর জহির ইচ্ছে করে মেয়েটির গায়ের উপর হেলে পড়লো।

মেয়েটির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। সে বুঝতে পারছে জহির ইচ্ছে করে এমন করছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।

যতটা সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু যাবে কই? ঐপাশের পুরুষ লোকটাও তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 

একটু পরে মেয়েটি বাস থেকে নেমে গেলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম জহির দাঁত বের করে হাসছে।

আমিও সেই হাসিতে যোগ দিলাম। যদিও মন থেকে জহিরের এই আচরণকে সমর্থন করতে পারছি না। কিন্তু প্রতিবাদও করলাম না।

কারণ একে তো জহির আমার খুব ক্লোজ বন্ধু। তার উপর বিভিন্ন প্রয়োজনে জহিরের কাছ থেকে অনেক হেল্প পাই। তার বিরুদ্ধে কথা বললে নিজেরই ক্ষতি। 

কিন্তু সেদিন আমি উপলব্ধি করতে পারিনি- এই ঘটনার প্রতিবাদ না করার কারণেই ক্ষতিটা বেশি হবে! এমন এক ক্ষতি যা কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়! 

১২ বছর আগের সেই ঘটনাটা এই মুহূর্তে কেন মনে পড়ছে জানি না। আসলে বিশেষ কোনো কারণের প্রয়োজন হয় না।

আমি মনে মনে প্রায়ই সেই ঘটনায় ফিরে যাই। ইস! যদি সেদিন আমি জহিরের আচরণের প্রতিবাদ করতাম, মেয়েটিকে হেল্প করতাম... তাহলে হয়তো... 

কলিং বেলের আওয়াজে সংবিৎ ফিরলো। ফিরে এলাম বর্তমানে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাড়ির দারোয়ান এসেছে, দাঁত কেলিয়ে হাসছে লোকটা। 

“স্লামালাইকুম স্যার। ডাকছিলেন আমারে?” 

আমি বললাম, “হ্যাঁ! নতুন ফ্ল্যাটের এই অবস্থা কেন বলেন তো?” দারোয়ানের মুখ থেকে হাসি মুছে গেলো। “কি হইছে স্যার?” 

“আরে... ইলেক্ট্রিক লাইন সব নষ্ট!” আমার কণ্ঠে বিরক্তি। “ফ্যান ঘুরছে না, লাইট জ্বলছে না, ফোনে চার্জ হচ্ছে না!” 

“কি বলেন স্যার?” দারোয়ান মনে হলো আকাশ থেকে পড়েছে। 

“আগের ভাড়াটিয়া ফ্ল্যাট খালি করার পর সব চেক করেন নি?” 

“মনে হয় ভালো কইরা চেক করা হয় নাই... সরি স্যার...” 

“সরি সরি না করে সমাধান করেন। সব মালপত্র নিয়ে ট্রাক অলরেডি রওনা হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। এই গরমে এখানে এসে থাকবে কী করে?” 

“স্যার একজন মেকানিক ডাইকা নিয়া আসবো?” 

“ভালো মেকানিক আছে এদিকে?” 

“আছে স্যার। বদি মেকানিক”। হাসিতে দারোয়ানের সব দাঁত বেরিয়ে পরেছে। “খুব ভালো মেকানিক স্যার! এক ঘন্টার মইধ্যে কারেন্টের লাইন সব ঠিক কইরা দিবো...” 

“ওকে! কুইক নিয়ে আসেন তাকে!” 

দারোয়ান চলে গেলো। আমি দরজা লাগিয়ে দিলাম। 

ফাঁকা ফ্ল্যাটে মোজা পায়ে হাঁটছি। নতুন ভাড়া নিয়েছি। এলাকাটা বসবাসের জন্য ভালো। হই-হুল্লোড় নাই।

গাড়ির আওয়াজ কম। এক রুম থেকে আরেকরুমে ঘুরছি। মাস্টারবেড রুমে এসে আমি কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম! 

এই রুমটা আমার চেনা! ১০ বছর আগে এই রকম একটা রুমেই ঘটেছিলো ঘটনাটা। এখনও স্পস্ট মনে আছে! মেঝেতে রক্তের বন্যা... এক কর্নারে পড়েছিলো লাশটা... 

নাহ! এখান থেকে বললে গল্পটা আপনারা বুঝবেন না। আমি বরং ফিরে যাই ঐ ১২ বছর আগে বাসের ঘটনাটাতে। আসলে ওখান থেকেই তো সবকিছুর শুরু... 

বাসে মেয়েটির সাথে ঐরকম আচরণের পর জহির আরও সাহসী হয়ে উঠলো। প্রায়ই সে বাসে উঠে মেয়েদের সাথে বাজে আচরণ করতো।

তারপর আমার সাথে দেখা হলে রসিয়ে রসিয়ে সেসব নিয়ে গল্প করতো। এক সময় বাসের বাইরেও শুরু হলো তার অপকর্ম।

রাস্তা ঘাঁটে, শপিং মলে, মেলায়, টিকেটের লাইন, বিয়েবাড়ি- যেকোনো স্থানে ভিড়ের মধ্যে সুযোগ পেলেই সে মেয়েদের সাথে নোংরা আচরণ করতো। সমবয়সি মেয়ে, বড়, ছোটো- কেউ বাদ যেতো না! 

দিনের পর দিন জহির আরও সাহসী হতে শুরু করলো। আর খুব গর্বের সাথে বন্ধু মহলে সে সব নিয়ে গল্প করতো।

একটা সময় পর তার এইসব গল্প শুনতে আর ইচ্ছে হতো না আমার। আমি তাকে এভয়েড করতে শুরু করলাম।

তবে যা করা উচিত ছিলো, তা করিনি- প্রতিবাদ করিনি! এবং যার মাশুল আমাকে দিতে হয়েছে! বাসের ঘটনার ঠিক ২ বছর পর... 

আবার কলিং বেলের আওয়াজ। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ব্যাগ কাধে কালি ঝুলি মাখা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে একজন। 

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।

“স্যার, দারোয়ান কইলো ফ্ল্যাটের কারেন্টের লাইনে নাকি ডিস্টার্ব...”

“ওহ! আপনি বদি মেকানিক?”

“জি স্যার!”

“আসুন ভেতরে”। 

আমি একপাশে সরে যায়গা করে দিলাম। বদি মেকানিক ভেতরে ঢুকলো। 

“দেখেন তো কি অবস্থা! লাইট ফ্যানের লাইন কিছুই ঠিক নাই। মোবাইলটা পর্যন্ত চার্জ হচ্ছে না!” “স্যার, মনে হয় সার্কিট বোর্ডে প্রবলেম। আমি দেখতাছি স্যার”। 

বদি মেকানিক একটা টুল টেনে নিয়ে গিয়ে সার্কিট বোর্ড খুলে কাজ করতে থাকলো। সে তার মতো কাজ করুক। চলুন আমরা আবার ১০ বছর আগের ঘটনাটাতে ফিরে যাই... 

এক সন্ধ্যায় ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরেছি। মায়ের উদ্বিগ্ন চেহারা দেখলাম। 

“কি হয়েছে মা?” “মুন্নিকে পাচ্ছি না”। মা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, “অনেকক্ষণ হয়ে গেলো”।

আমি অভয় দিয়ে বললাম, “খেলতেছে মনে হয় কোথাও”।

“কার সাথে খেলবে? ওর বন্ধুরা তো সবাই যে যার বাসায়...”।

“দাঁড়াও আমি দেখছি”।

মুন্নি আমার ছোটো বোন। ৮ বছর বয়স। বাড়ির ছাদে, প্রতিবেশিদের ফ্ল্যাটে, বাড়ির আশে পাশে, রাস্তায়- সব খানে খুজলাম মুন্নিকে।

কোথাও নেই। এবার আমিই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বাবাকে ফোন করে জানালাম। বাবা অফিসে জরুরি মিটিং ফেলে পাগল পাগল হয়ে চলে এলেন। মেয়েকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তিনি। 

থানা-পুলিশে খবর দেওয়া হলো। হাসপাতাল গুলোতে লোক পাঠানো হলো। এলাকায় মাইকিং শুরু হলো। কিন্তু মুন্নির খোঁজ কেউ দিতে পারলো না।

মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। বাবার দিকেও তাকানো যাচ্ছে না! আমার বুকের ভেরতটা ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছি না।

রাত ১১টার দিকে পাশের বাসার দারোয়ান সুন্নাহ ভাই দৌড়ে এলো আমাদের বাসায়। হাপাচ্ছে খুব। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে সুন্নাহ ভাই? মুন্নির কোন খোঁজ পেলেন?” “ভাই, তাড়াতাড়ি আসেন আমার সাথে”। বলে আমার হাত ধরে টান দিলো সুন্নাহ ভাই। 

তার সাথে আমি পাশের বিল্ডিং এ গেলাম। বুকের ভেতরটা মুন্নির অমঙ্গল আশংকায় দুরুদুরু কাঁপছে। সুন্নাহ ভাই আমাকে তিন তলায় নিয়ে এলেন। এই বিল্ডিং এর তিন তলায় একটা ফ্ল্যাট খালি আছে আমি জানি।

ভাড়াটিয়া চলে গেছে, এখনও ভাড়া হয়নি। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, ভেতরে ঢুকলো সুন্নাহ। তার সাথে আমি। মাস্টার বেডরুমে ঢুকলাম।

মোবাইলের টর্চের আলোতে দেখলাম- ফ্ল্যাটের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এক কর্নারে পড়ে রয়েছে একটা বাচ্চা মেয়ের নগ্ন লাশ- আমার মুন্নি! আমার চোখের সামনে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো, হাঁটু ভাজ হয়ে পড়ে যাচ্ছি... 

“স্যার! সার্কিট বক্সে প্রবলেম ছিলো। ঠিক কইরা দিছি”। 

বদি মেকানিকের কথায় আমি আবার বর্তমানে ফিরে এলাম।

“দেখেন তো লাইট-ফ্যানের লাইন সব ঠিক মতো কাজ করছে কি না?” 

বদি টুল থেকে নামলো। টুলটা এগিয়ে নিয়ে সুইচ বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। টেস্টার দিয়ে টেস্ট করতে করতে বললো- “স্যার, এইখানেও একটু ঝামেলা আছে মনে হইতাছে।

লাইন পাইয়া পাইয়া ছাইড়া দেয়। আমি ঠিক কইরা দিতাছি, সমস্যা নাই”। 

বদি তার কাজ করছে মনোযোগ দিয়ে... আমি আবার ফিরে গেলাম অতীতে... 

মুন্নির লাশ পাওয়ার পর আমার মা-বাবা দুজনেই বেহুশ হয়ে গেলো। মুন্নিকে আর কী দেখবো? তাদের নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে গেলো। পুলিশ এলো।

মুন্নির লাশ নিয়ে গেলো। ময়না তদন্ত হলো। পরদিন দুপুরে জানা গেলো মুন্নিকে সারাদিন আটকে রেখে কয়েকবার রেপ করা হয়েছে।

রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে তার। ভাবতেই আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আমার ফুলের মতো নিস্পাপ বোনটিকে! কিন্তু কোন পিশাচ এই কাজ করেছে তা জানার কোন উপায় নেই! কারণ মুন্নি ঐ ফ্ল্যাটে কখন গেছে তা কেউ দেখেনি! 

তখনও জানতাম না কি চমক অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য!

পরদিন বিকেলে মুন্নির এক বন্ধু বললো- মুন্নিকে আইসক্রিম কিনে দেবে বলে সাথে নিয়ে গিয়েছিলো জহির। 

জহির! নামটা শুনতেই আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো! হ্যাঁ! জহির! তার মতো নরপশুর পক্ষেই কেবল সম্ভব এমন একটা কাজ করা!

ওহ মাই গড! জহিরকে কত ভালোবাসতো মুন্নি... বাসায় এলেই “জহির ভাইয়া” বলে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তো তার কোলে... 

খবরটা জানাজানি হতেই জহির পালালো বাসা থেকে। পুলিশ লেগে গেলো চারিদিকে। কিন্তু জহিরকে কেউ খুঁজে পেলো না। আমার বাবা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো জহিরকে খুঁজে বের করার। কিন্তু জহিরকে পাওয়া গেলো না মানে গেলোই না!

উধাও হয়ে গেছে যেনো! এরপর কেটে গেছে ১০ বছর... জহিরের সন্ধান আজও পাওয়া যায় নি! 

এদিকে নিজের ভেতর গিলটি ফিলিংস নিয়ে ধুকে ধুকে বেচে আছি আমি! সেদিন বাসের মধ্যে ঐ মেয়েটির “গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না” আর্জিটা যদি শুনতাম, তার পক্ষ হয়ে যদি প্রতিবাদ করতাম,

তাহলে হয়তো জহির এতদূর এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেতো না! আর আমার মুন্নিও বেচে থাকতো! মুন্নির মৃত্যুর জন্য আসলে আমিই দায়ি। আমি এবং আমার মতো মেরুদন্ডহীন কাপুরুষরাই দায়ী! 

“স্যার, মুছার মতো কিছু আছে?” বদি জিজ্ঞেস করলো। “একটা ন্যাকড়া দেওয়া যায়? ভিতরে অনেক ধুলা বালি জইমা কারেন্টের লাইন জাম কইরা দিছে মনে হয়”।

“না, মুছার জন্য তো কিছু নেই... দাঁড়ান...” বলে পকেটে হাত দিলাম আমি। একটা খবরের কাগজ বের করে আনলাম। “এইটা কাজে লাগাতে পারেন কিনা দেখেন”।

কাগজটা হাতে নিলো বদি। বললো, “কাপড় হইলে ভাল হইতো”।

“কাপড় তো নাই ভাই”। আমি মাথা নাড়লাম। “পুরান খবরের কাগজ মনে হইতাছে?” আমি হাসলাম। “খবরের কাগজ পুরনো, কিন্তু খবরটা আজও নতুনের মতো বুকের ভেতর জ্বলছে!” 

বদি খবরের কাগজটা চোখের সামনে আনলো। কাগজে একটা ছবি দেখা যাচ্ছে- একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের লাশের সামনে বসে একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি পাগলের মতো কাঁদছে।

ছবির উপরে খবরের হেডলাইন– “খুলনায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার”। ছবির নিচে বিস্তারিত রিপোর্ট… 

বদি খবরটা পড়ছে। আমি পকেটে হাত দিলাম, বের করে আনলাম একটা লম্বা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। বদির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

তার মাথার পেছনে পিস্তলের বাট দিয়ে গায়ের জোরে আঘাত করলাম আমি। আঘাতটা একদম যায়গামতো লেগেছে। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে ঢলে পড়লো বদি। আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে। দুই পা ধরে বদির দেহটা টানতে টানতে নিয়ে গেলাম ঘরের এক কোনায়। 

খবরের কাগজটা ভাজ করে আবার কোটের পকেটে রাখলাম আমি। হাতে সময় খুব কম। যা করার দ্রুত করতে হবে।

পরবর্তী আধা ঘন্টা ধরে একটা দৃশ্য সাজালাম আমি। সন্তুষ্ট হওয়ার পর থামলাম। এবার বদির জ্ঞান ফিরানোর পালা।

বোতল খুলে হাতে পানি নিয়ে বদির চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলাম আমি। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে চোখ করলো বদি, জ্ঞান ফিরে আসছে তার... 

চোখ খুলতেই নিজেকে সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় আবিষ্কার করল বদি। তার দুই হাত মোটা দড়ি দিয়ে জানালার গ্রিলের সাথে শক্ত করে বাঁধা।

পা দুটোও একই রকম দড়ি দিয়ে কষে বাঁধা আছে। চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে থামালো সে। আমার হাতে ধরে থাকা পিস্তলের দিকে নজর পড়েছে তার। 

“কেমন লাগছে বদি? নাকি জহির নামে ডাকব তোমায়?” আমি বিদ্রূপের সুরে প্রশ্ন করলাম। 

বদির চোখে মুখে আতংক দেখা দিলো। 

মুহূর্তের মাঝে গত ১০ বছরের দুঃসহ স্মৃতি ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে গেলো আমার চোখের সামনে। পালিয়ে যাওয়ার পর জহিরকে আমি কোথায় না খুঁজেছি! অনেক খুঁজে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বের করেছি জহির সেদিন পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে।

সাথে বেশ কিছু টাকা পয়সা নিয়ে এসেছিলো, তাই দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকে বছর খানেক। তারপর ভাগ্যের সন্ধানে কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরে একসময় জামাল উস্তাদের কাছে আশ্রয় পায়।

তার কাছ থেকেই মেকানিকের কাজ শেখে বদি। এভাবেই আমার বন্ধু জহিরের বদি মেকানিক হয়ে ওঠা! 

জহিরকে খুঁজে বের করার পর বেশ লম্বা সময় নিয়ে প্ল্যান সাজালাম আমি। বদির দোকানের কাছাকাছি ভুয়া নাম-পরিচয়ে একটা বাসা ভাড়া নিলাম। নিজেই বাসার বিদ্যুতের লাইন নষ্ট করলাম, তারপর… সব কিছু একদম প্ল্যানমাফিক হয়েছে! 

জহির একটা ঢোক গিললো। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে। বললো, “কে আপনে? আমারে বাইন্ধা রাখছেন ক্যান? আমার কাপড় খুলছেন ক্যান?”

“সেটা একটু পরেই টের পাবি”। বললাম আমি। “কি টের পামু?” জহির অস্থির কণ্ঠে বললো।

“রিল্যাক্স! এতো তাড়া কিসের? দুই বন্ধু এতদিন পর দেখা হলো, একটু খোশ গল্প করি…”

“কিসের বন্ধু? আমি আপনারে চিনি না!” 

আমি মৃদু হাসলাম। মুখ থেকে নকল দাঁড়ি-গোঁফ খুলে নিলাম।

“এবার চিনতে পেরেছিস?” 

জহিরের চোখ বলছে সে চিনতে পেরেছে আমাকে। কিন্তু না চেনার নাটকটা চালিয়ে যাচ্ছে- “কে আপনে? আমি আপনেরে চিনি না! আগে কখনো দেখি নাই!” 

“এক্ষুনি চিনতে পারবি...” বলে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করলাম আমি। আঙ্গুল দিয়ে ধার পরীক্ষা করে বললাম, “বাহ! বেশ ধার আছে দেখছি! এক পোঁচেই কেটে ফেলা যাবে”। 

প্রচণ্ড আতংক গ্রাস করল জহিরকে। তোতলাতে শুরু করলো, “আ... আমি কিন্তু চিৎকার কইরা সবাইরে ডাকুম। আপনে… আপনে মনে করছেন পার পাইয়া যাবেন? এত… এত সহজ না… এই এলাকার সবাই আমারে চিনে… আমার কিছু হইলে আপনের খবর আছে”।

আমি ছুরি হাতে এগিয়ে গেলাম বদি মেকানিক ওরফে আমার বন্ধু জহিরের দিকে। ঠোঁটের কোণে টিটকারির হাসি, “বুঝলাম তোর কিছু হলে এলাকার লোকজন দুনিয়া উলটে ফেলবে।

কিন্তু তাতে তোর কি লাভ হবে বল? তোর যে ক্ষতি এখন হতে যাচ্ছে তা কি পূরণ হবে?” 

এবার আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না জহির। ভয়ে আতংকে তার চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে থাকলো, “দোস্ত... আমারে মাফ কইরা দে দোস্ত! আমি অনেক বড় পাপ কইরা ফালাইছি রে... মাফ কইরা দে আমারে...” 

“উপরে গিয়ে ছোট্ট মুন্নির কাছে মাফ চাস।” বলে জহিরের মুখের ভেতর একটা রুমাল ঢুকিয়ে দিলাম আমি। 

জহির একটানা কিছু বলে যাচ্ছে। মুখের ভেতর রুমাল থাকায় শুধু গম গম আওয়াজ হচ্ছে, কি বলছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

এবার আমি পকেট থেকে বের করলাম একটা কালো রঙের গ্লাভস। বাম হাতে পড়ে নিলাম। 

গ্লাভস পরা হাতে আমি জহিরের পুরুষাঙ্গ ধরলাম, অন্য হাতে ছুরি প্রস্তুত। বললো, “জহির, তুই যা করেছিস তার শাস্তি একটাই- মৃত্যু!” 

কাজটা করতে মাত্র পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগলো আমার। সমস্ত শক্তি এক করে একটানা চিৎকার করে চললো জহির।

চিৎকারের সময় তার গলার সবগুলো রগ ফুলে উঠলো। চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোটর ছেড়ে ইঞ্চি খানেক বেরিয়ে এসেছে, অসহ্য ব্যাথায় অশ্রু গড়াছে গালে। মুখে রুমাল থাকায় তার সেই চিৎকার ঘরের বাইরে কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

মিনিট খানেক টানা চিৎকার করে গেল জহির। তারপর অসহ্য ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে জ্ঞান হারালো। মাথাটা ঝুলে পড়লো বুকের ওপর। 

জানালার গ্রিলে হাত বাঁধা অবস্থায় ঝুলে আছে আরব্য রজনীর সেই খোঁজা চাকরদের মত পুরুষাঙ্গ হারানো এক যুবকের অজ্ঞান দেহ।

দুই পা বেয়ে নামা রক্তে ভেসে যাচ্ছে ড্রয়িং রুমের ফ্লোর। ফ্ল্যাটের দরজায় বাইরে থেকে তালা আটকে দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। গুলি খরচ করার প্রয়োজন হয়নি। রক্তক্ষরণেই মরবে জহির। যেমন মরেছিল ছোট্ট মুন্নি! 

“গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না!” মেয়েটির সেই চিৎকার আজও আমার কানে বাজে। সেদিন যদি তার হয়ে প্রতিবাদ করলাম, তাহলে হয়তো আজকের দিনটি আমার জীবনে কখনো আসতো না!

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ