আসলে আমরা যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষ আছি তারা চাইলেও এমন অসহায় মানুষ গুলোকে সাহায্য করতে পারি না।তবে সাহায্য করার মন মানুষিকতা থাকলে স্বল্প রোজগার থেকেই কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারি যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী।
রফিক সাহেব বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সবজির দোকান গুলো ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর দোকানদার কে জিজ্ঞেস করছেন কোন সবজির কি দাম।হয়তো বাজারের সব থেকে সস্তার তরিতরকারি গুলোই কিনবেন তাই। তিনি বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটির পর খেয়াল করলেন বৃদ্ধ এক চাচা একটা ছেঁড়া বস্তা বিছিয়ে তারউপর গুটিশুটি হয়ে বসে আছেন সামনে কিছু সবজি নিয়ে।
তবে উনার কাছ থেকে কেউই কিছু নিচ্ছেন না।উনার সামনে দিয়ে যখন কেউ বাজারের ব্যাগ নিয়ে অন্য দোকান থেকে তরিতরকারি কিনে চলে যায় তখন উনি শুধু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।বিষয়টা খেয়াল করতেই রিফিক সাহেব বৃদ্ধ লোকটির দিকে এগিয়ে গেলেন।
কাছে এসে দেখলেন উনার সামনে সবজি বলতে ওই কয়েক কেজি টমেটো।এছাড়া আর কিছুই নেই।
তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন..
--চাচা আপনাকে তো এখানে আগে কখনো দেখি নি।এই এলাকায় নতুন এসেছেন নাকি?
--না স্যার আমি এই এলাকায় অনেক বছর ধরেই আছি।তয় রিকশা চালাই।আইজ শরীলডা ভালা না। রোজা রাইখা রিকশা চালাইতে কষ্ট হইবো তাই আফনের চাচী রিকশা নিয়া বাইর হইতে দেয় নাই।
--ও আচ্ছা।চাচা টমেটো গুলো তো বেশ টাটকা আর সতেজ মনে হচ্ছে।কত করে কেজি?
বৃদ্ধ লোকটিকে দাম জিজ্ঞেস করতেই তখন উনি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন
--এহানে দু কেজি টমেটো আছে। স্যার আফনে নিলে ২০টেহা কেজি দিয়েন।
--কি বলেন এত কম দাম?
--আসলে স্যার সেই দুপুর থাইকা বইসা রইছি।একটু পরেই ইফতারের সময় হইয়া যাইবো।আফনের চাচী আমার অপেক্ষায় বইসা রইছে।আমি চাউল নিয়া গেলে তারপর রান্না করবো।কাল পান্তা ভাত খাইয়া রোজা রাখছি। কিন্তু আজ যদি এগুলো বিক্রি না হয় তাইলে আজকে কপালে পান্তাটাও জুটবো না।
--আপনার কোনো ছেলেমেয়ে নেই?
--আছে স্যার। একটাই পুলা আমার। বছর খানেক আগে এক্সিডেন্টে ডান পা ভাইঙ্গা গেছে।ভালা চিকিৎসা করাইতে পারি নাই।এহন কোনো কাজকাম করতে পারে না।তাই ঘরেই বইসা থাহে।
--খুবই দুঃখজনক। তা চাচা সংসার চলে কিভাবে তাহলে?
--রিকসা চালায়া যে কয়টেহা রোজগার করি তাই দিয়া তিনজনের কোনো রকমে চলে আর কি।
--আপনি থাকেন কোথায়?
--ওই যে তিন রাস্তার মোড়ে বাঁ দিকে যে রাস্তা ডা গেছে ওইখানে এক বস্তিতে থাহি।বস্তিতে যেই ঘরডা নিয়া থাহি হের পাশেই একটু জায়গা খালি ছিলো।আফনের চাচী বুদ্ধি কইরা কয়টা টমেটো গাছ লাগাইছিলো।এইগুলা সেই গাছেরই টমেটো স্যার।কোনো ভেজাল নাই।এক্কেবারে টাটকা।আফনে নিবেন স্যার?
--হুম দেখেই বুঝা যাচ্ছে।তা আজ না হয় এগুলো বিক্রি করে চাউল কিনবেন তা কাল কি করবেন?
--হা হা!! রিজিকের মালিক আল্লাহ।রিজিক নিয়া চিন্তা করি না স্যার।আল্লাহ একটা না একটা ব্যবস্থা করবোই।রিজিকে যদি না থাকে তাইলে না খাইয়া থাকমু আর কি।
দূর থেকে আমি তাদের কথোপকথন শুনছিলাম।বৃদ্ধ চাচা সহজ সরল ভাবে হাসিমুখে কথা গুলো বলে যাচ্ছিলেন।তবুও কথাগুলো শুনে বুকের মধ্য চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলাম।
রফিক সাহেব তখন মানিব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার দুইটা নোট বের করে চাচার হাতে ধরিয়ে দিলেন ।বললেন
--চাচা এই টাকাটা রাখেন।আর সবজি গুলোও বাড়ি নিয়ে যান।আর এই মাছটাও রাখেন।চাচী কে বলবেন এই মাছটা দিয়ে টমেটোর ঝোল করতে।খুব ভালো লাগবে।রফিক সাহেব তখন তার বাজারের ব্যাগ থেকে দেড় কেজি ওজনের রুই মাছটা চাচার হাতে দিয়ে কথা গুলো বললেন।
বৃদ্ধ চাচা নিতে চাইলেন না। তবুও একপ্রকার জোর করেই দিয়েছে বলা চলে।চাচা তখন ছলছল চোখে রফিক সাহেবের দিকে তাকালেন।বৃদ্ধ চাচার চোখের জল গড়িয়ে পড়লো ভাজ পড়া গালের উপর।
রফিক সাহেব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন...
--আহা চাচা কাঁদছেন কেনো?
--সেই দুপুর থাইকা বইসা রইছি এ কয়টা টমেটো নিয়া।কেউ একবারও ফিরাও তাকায় নাই আর আফনে,,,,,,
এই বলেই বৃদ্ধা চাচা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
রফিক সাহেব তখন চাচাকে জড়িয়ে ধরে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
রফিক সাহেব আবারও বৃদ্ধ চাচাকে বললেন
--চাচা আমি আপনার ছেলের বয়সী আমাকে স্যার বইলেন না।আর শোনেন একটু পরেই মাগরিবের আযান দিবে।বাড়ি চলে যান।চাচী আপনার অপেক্ষায় বসে আছে তো।
--হ বাজান যামু।আফনের চাচী রুই মাছ খুব পছন্দ করে।টেহার লাইগা খাওয়াইতে পারি না।আজ পেট ভইরা খাইতে পারবো।আল্লাহ আফনের মঙ্গল করুক।
--জ্বী চাচা দোয়া করবেন।আর আপনার গায়ে তো অনেক জ্বর। যাওয়ার সময় জ্বরের ঔষধ নিবেন মনে করে।
--আইচ্চা বাজান।
এই বলেই বৃদ্ধ চাচা বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলেন।যাওয়ার সময় গলায় ঝুলিয়ে রাখা গামছায় চোখের পানি মুছতে মুছতে পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে বারবার।
রফিক সাহেব বৃদ্ধ চাচাকে বিদায় করে নিজেও বাড়ির ফিরলেন।
উনার স্ত্রী এসে বাজারের ব্যাগ হাত থেকে নিয়ে বললেন
--কি গো শুধু সবজি আর মাছ?গরুর গোস পাও নি?মেয়েটা সেই কবে থেকে গরুর গোস খাওয়ার বায়না করছে।
--হুম পেয়েছি তবে কেনা হয় নি।
--কেনো?
তারপর তিনি তার স্ত্রীকে সবটা বললেন।উনার স্ত্রীও তখন পাশে বসে হাতের উপর হাত রেখে বললেন
--খুব ভালো করেছো।আমি সত্যিই খুব খুসি হয়েছি।আমাদের যদি অনেক টাকা থাকতো তাহলে এমন আরও অনেক মানুষের পাশে আমরা দাড়াতে পারতাম তাই না বলো?
--আমাদের অনেক টাকা নেই তবে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য তো করতেই পারি তাই না?আসলে সাহায্য করার জন্য অনেক অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় মন মানুষিকতার।আমরা চাইলেই আমাদের স্বল্প রোজগার থেকেই কিছু টাকা সাহায্যের জন্য রাখতেই পারি।
--হুম তা ঠিক বলেছো।এই বলেই রফিক সাহেবের স্ত্রী বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্না ঘরে রাখলেন।একটু পরেই আযানের শব্দ কানে এলো।রফিক সাহেব তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে লেবুর শরবত, ছোলা আর কয়েকটা পিয়াজু দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে ইফতার সেরে নামাজে গেলেন।
ওই দিকে বৃদ্ধ সেই চাচা যখন চাউল আর টাটকা রুই মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তখন তার স্ত্রীর চোখে মুখে যে খুসির ঝঁলক ফুঁটে উঠেছে তা হয়তো লক্ষ টাকাতেও কিনতে পাওয়া যাবে না।কি দারুণ ছিলো সেই মুহুর্ত।ধন্যবাদ?
লেখা: শারমিন আক্তার
You must be logged in to post a comment.