রনি সচারাচর কাউকে গুনেনা। নিজের মতো করে চলে। নিজে যা বলবে তাই, অন্য কারো কথায় কান দেয় না। অবশ্য অনেক চালাক। স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি জীবনে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ছিল।
তবে ঐখানেও একই কাহিনি। কারও কথায় কান দিতো না। সহপাঠীদের কথা দূরে থাক, শিক্ষক আর নিজের মা-বাবকেই দাম দেয় না। রনির বাবা একজন সাধারণ কৃষক। অনেক কষ্ট করে রনিকে লালন-পালন করেছে।
কিন্তু রনি তার বাবার পেশা পছন্দই করে না। আজ রনি দেশের অনেক বড় ব্যবসায়ী। শুধু তাই না দেশের সবথেকে বড় ধনীদের মধ্যে একজন। দেশের সবথেকে বড় কোম্পানীর (রনি ফ্যাডারেশনের) চেয়ারম্যান রনি। আর ঐদিকে তার মা-বাবা কি করছে তাকে জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে পারবে না।
কারণ সে তার মা-বাবার খবরই রাখে না। গত দশ বছর রনি একবারের জন্যও তার বাবা-মাকে দেখতে যায়নি। তার বাবা ভীষণ অসুস্থ চিকিৎসার জন্য টাকা নেই।
রনিকে অনেকবার কল করেছে কিন্তু রনি এতো ব্যস্ত যে মা-বাবার ফোনটা ধরার সময় নেই।
আজ রনির মা রনিকে আবার কল করল। রনি একটা মিটিং এ। তার মা পাঁচবার কল দিলো কিন্তু ধরল না। আরেকবার যখন দিল, তখন রনি মিটিং থেকে একটু বের হয়ে কল ধরে বলল, ‘কি হইছে? এতো কল দিতেছো কেন?
জানো না আমি অনেক ব্যস্ত থাকি।’ রনির মা কেদে দিল আর বলল, ‘রনিরে তোর বাবা অনেক অসুস্থ। মনে হয় আর বাচবে না।
তোকে একবার দেখতে চাইছে। একবার এসে একটু দেখে যা বাবা।’ রনি বলল, ‘মা, আমার হাতে এখন একদম সময় নেই। সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে আমার। সেখানে উপস্থিত থাকতেই হবে। উনাকে দেখতে আসলে আমার আর সেই মিটিং এ যাওয়া হবে না।
আমি কিছু টাকা দিচ্ছি উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও। এখন রাখি আমি অনেক ব্যস্ত আর ডিসটার্ব করো না।’ এই বলে রনি কল কেটে দিল। আবার মিটিং এ চলে গেল। রনির কথা শুনে তার মার চোখ দিয়ে শুধু পানি আর পানি পরে।
এত কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছি আজ সে আমাদের একটু দেখতে আসতে চায়না শুধু একটা মিটিং এর জন্য। তারপর আর কি। চোখ মুছে রনির বাবার কাছে গিয়ে বসল।
রনির বাবা বলল, ‘কিগো রনির মা? আমার ছেলেটা কী কল ধরেছে?’ রনির মা উত্তরে বলল, ‘হ্যা। ধরেছে।’ ‘তা কি বলেছে? আসবেতো আমাকে দেখতে?’ রনির বাবার কথা শুনে রনির মার চোখে পানি এসে গেলে।
চোখে পানি দেখে রনির বাবা বলল, ‘ও বুঝেছি। আসবে না তাহলে।’ রনির মা চোখের পানি মুছে একটু মুচকি হেসে বলল, ‘আরে না।
রনি বলেছে, ও কিছু টাকা পাঠাচ্ছে তোমার চিকিৎসার জন্য তারপর কিছুদিন পরেই তোমাকে দেখতে আসবে, এসে কয়েকদিন থেকেও যাবে।’ রনির বাবা খুশি হয়ে বলল, ‘সত্যি’! হ্যা সত্যি, এই বলে রনির মা গেল রান্না ঘরে রনির বাবার জন্য খাবার আনতে।
রনির মা খাবার নিয়ে আসল আর রনির বাবাকে বলল, ‘একটু কষ্ট করে উঠে খেয়ে নাও।’ ঠিক তখনই ফোনে একটা মেসেজ আসল।
কি জানি লিখা মেসেজে। রনির বাবাকে সবগুলো খাবার খেতে বলে রনির মা ফোনটা নিয়ে পাশের বাড়িতে গেল রমেশকে দেখাতে। রমেশের বাড়িতে গিয়ে রমেশকে ডাক দিয়ে বলল, ‘রমেশ বাবা দেখতো ফোনে কি জানি বাজল। রনি বলেছিল ওর বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠাবে।
দেখত বাবা পাঠালো কি না?’ রমেশ বলল, ‘দাওতো দেখি। হে কাকি রনি ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে।’ রনির মা কথাটা শুনে অনেক খুশি হলো। ফোনটা নিয়ে দোকানের দিকে রওনা হলো।
রমেশ বলল, ‘কিগো কাকি? কই যাও?’ রনির মা পেছনে না ফিরেই বলল, ‘আরে তোর কাকাতো অনেক অসুস্থ টাকাটা উঠিয়ে উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এখন যাই।’ এই বলে চলে গেল। রমেশও তার কাকির কান্ড দেখে মুচকি হেসে আবার ঘরে চলে গেল।
রনির মা দোকান থেকে টাকাটা উঠিয়ে ঘরে এসে রনির বাবাকে বলল, ‘কইগো রনির বাবা। খাওয়া কি শেষ?’ রনির বাবা কোনো সারা দিল না।
সারা না পেয়ে রনির মা দেখল কি করছে। মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। কাথাটা উঠিয়ে গায়ে দিতে গিয়ে গায়ে হাত লাগাতেই দেখল শরীর পুরো ঠান্ডা হয়ে আছে।
কোনো নিশ্বাস নিচ্ছে না। ভয় পেয়ে একটু ধীর কণ্ঠে গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, ‘রনির বাবা, এই রনির বাবা।’ তাও কোনো সারা নেই। কান্না কান্না ভাব রনির মার। কিছু বুঝতে পারছেনা। কাদতে কাদতে জোরে ডাকতে লাগল, ‘এই রনির বাবা উঠো।
তোমার ছেলে তোমার চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠিয়েছে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’ কিন্তু ডেকে আর লাভ নেই। কারণ রনির বাবা আর নেই। কি চিৎকার রনির মার। সবাই এসে পরল চিৎকারের শব্দে।
এসে দেখে রনির বাবা চির নিদ্রায় চলে গেছে। রমেশ এসে কাকির কাছে গিয়ে বলল, ‘ও কাকি। কেদো না। রনিকে ফোন দাও। তোমার কান্না শুনে আমারও কান্না পাচ্ছে।’ রনির মা বলল, ‘কাকে ফোন দিবোরে বাবা? সে তো অনেক ব্যস্ত।
তার কাছে টাকাই সব, মা-বাবা কিছুই না।’ কাকির কথা শুনে রমেশ নিজেই গেল রনিকে কল করতে। কাকিকে বলল, ‘কাকি মোবাইলটা দাও। আমার ফোনতো ভুলেও ধরবে না।
তোমারটা দিয়ে ফোন দি।’ এই বলে রমেশ তার কাকির ফোন নিয়ে রনির নাম্বারে কল দিল। রনি কল ধরে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘মা তোমাকে না বলেছি আমি এখন অনেক ব্যস্ত কল দিও না। টাকা তো পাঠিয়েই দিয়েছি।
আর কী?’ রমেশ বলল, ‘আমি রমেশ রনি ভাই।’ কাদা স্বরে বলল, ‘কাকা একটু আগে চির নিদ্রায় চলে গেছে। তুমি একটু সময় করে যলদি আসো।’ রনি বলল, ‘মরে গেছে বাবা।
কিন্তু আমার তো এখানে অনেক কাজ তোরা সব কাজ করে নে আমি কিছুদিন পরে আসবো।’ এই বলে কেটে দিল। রনির মা রমেশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি রে রমেশ? কী বলল রনি?
আসতে পারবেনা, অনেক ব্যস্ত এটাইতো বলেছে তাই না?’ রমেশ কেদে বলল, ‘তুমি ওর কথা বাদ দাও কাকি। আমি কেন আছি? আমি সব করব।’
রনির বাবাকে আছর নামাজের পর জানাজা পরিয়ে মাটি দিবে বলে সবাই ঠিক করল। তাই সবাই মিলে কার কি কি করতে হবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
এখন রনির বাবাকে গোসল করানো শুরু হয়েছে। গোসল শেষ। তারপর সবকিছু করার পর তাকে কাফনের কাপর দিয়ে বাধা হলো।
আছরের নামাজ পরে সবাই রনির বাবার জানাজাতে উপস্থিত হলো। অনেক মানুষ এসেছে জানাজাতে।
রনির বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিল। গ্রামের সবাই তাকে খুব পছন্দ করতো। তাই হয়তো এত মানুষ। ঐদিকে রনির মা কেদে অবস্থা খারাপ। আর রনির বাবাকে কবরের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
রমেশ ও লাশের খাঁট কাধে নিয়েছে। তার চোখ দিয়ে শুধু পানি আর পানি পরছে আর কাকার লাশ কাধে নিয়ে কবরের দিকে হাটছে।
অবশেষে কবরের কাছে যাওয়ার পর কয়েকজন মিলে লাশ কবরে রাখল। তারপর সবাই লাশের উপরের দিকে কাটা বাঁশ রাখা শুরু করলো তার উপর কলা পাতা। অবশেষে সবাই মাটি দিতে শুরু করল।
মাটি দেয়ার সাথে সাথে কবর গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল। রমেশ কাঁদে আর মাটি দেয় তার কাকার কবরে। রনির বাবা মরেও তার ছেলের কাছ থেকে এক মুষ্ঠি মাটি পেলো না।
সব কাজ শেষ করে সবাই চলে আসল রনির বাবাকে সেই গভীর অন্ধকার না ফেরার ঘরে রেখে।
অনেক দিন কেটে গেল। রনি আসবে বলে তার মা অপেক্ষায় বসে আছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। কল দিলে ধরেনা।
বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু রনির কোনো দেখা নেই। রনির মা ঠিকমত খাবারও খায় না। রমেশ অনেক বলে কয়ে খাওয়ায়। এভাবে কত দিন চলবে।
আর ঐদিকে রনি তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। পরিবারের জন্য কোনো সময়ই নেই। তার একবছর পর রনির মাও তার অপেক্ষা করতে করতে চলে গেল দুনিয়া ছেড়ে। রমেশ রনিকে কল করলো কিন্তু কোনো সারা নেই। মেসেজ করে জানিয়ে দিলো।
তাও রিপ্লাই নেই। এখন তার গ্রামের বাড়ি পুরো ফাকা। রমেশ ফাকা ঘরটিকেই অনেক যতœ করে রাখে। যতবার ঘরে আসে মনে পরে তার কাকির হাতের সেই রান্না, কাকির স্নেহ, কাকার আদর।
মনে করে আর চোখ দিয়ে পানি পরে। ঐদিকে রনি বিয়ে করে তার ঘরে এখন ২ টা ছেলে। একটার নাম সাফিন আর ছোটটার নাম রাফিন।
রনির বউ অনেক সুন্দর। দিন ভালোই যাচ্ছে তাদের। রনি বুরো হচ্ছে দিন দিন। অনেক বছর কেটে গেছে হয়তো ২০ বছর।
একদিন রনি কাজের সময় মাথা ঘুরে পরে গেল। কোম্পানির লোকেরা রনিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর তার কিছু টেস্ট দেওয়া হলো। সকল টেস্টের রেজাল্ট আসার পর ডাক্তার রনির কাছে গেল আর বলল, ‘আপনি কখনো কি আপনার মেডিকেল টেস্ট করান না?’ রনি বলল, ‘সময় পাই না ডাক্তার। কি করব বলেন?
অনেক কাজ আমার, একটা কোম্পানির দায়িত্ব বলে কথা।’ ডাক্তার বলল, ‘মানুষ বাচলে তারপর তো কাজ। যাই হোক শুনুন এখন আপনার ক্যান্সার ধরা পরেছে। তাও ফাইনাল স্টেজ।’ রনি একটু থমকে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ডাক্তারকে বলল, ‘আর কেউতো জানে না এই ব্যাপারে, না কি?’ ডাক্তার বলল, ‘না। আমি শুধু আপনাকেই জানিয়েছি।’ রনি বলল, ‘আর কাউকে বলার দরকার নেই।
এটা আমার আর আপনার মধ্যেই থাকুক। আমার হাতে আর কত দিন সময় আছে?’ ‘বেশি নেই। কয়েক মাস, তিন মাসের মত।
তবে আমি বলব এখন যত তারাতারি সম্ভব হাসাপাতালে এডমিট হওয়ার জন্য, তাহলে আপনার কষ্ট একটু কম হবে আর আগের থেকে বেশি দিন বাচতেও পারবেন।’ রনি বলল, ‘হাসপাতালে ভর্তি হলে কী আমি বাচতে পারবো? পারবোনা, তাহলে কিছুদিন বেশি জীবিত থেকে কী হবে? যত দিন বাচি এভাবেই চলবো।’ এই বলে রনি চলে গেল।
যেতে যেতে ভাবছিল তার জীবনের এই সময়গুলো সে কি করেছে। ভেবেছিল অনেক টাকা কামাই করবে তারপর আরামে জীবন কাটাবে। কিন্তু টাকা কামানোর নেশাতে এতটাই মগ্ন ছিল যে, এখন আর শান্তিতে জীবন কাটানোর সময় নেই। বাসায় গিয়ে ভাবল এত সম্পত্তি কাকে দিবে।
তো ভাবল ওর বড় ছেলেকে কোম্পানীর চেয়াম্যান বানাবে। আর ছোট ছেলে আরেকটু বড় হলে বড় ছেলেই ভাববে কি করবে। এই ভেবে পরের দিন সেই অনুযায়ী কাজ করল। বউ আর ছেলেদের নামে সব সম্পত্তি করে দিল। আর কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর নিল।
এখন বাকি যে কয়দিন আছে দুনিয়াতে একটু শান্তিমত জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু সে আসা মনে হয় আর পুরন হবে না।
তার বউ আর ছেলেরা সম্পত্তি পাওয়ার পর তার সাথে আর ভালো ব্যবহার করে না। যা ইচ্ছা তাই বলে। রনি অসুস্থের কারনে কোনো কাজ করতে পারে না তাই সবাই তাকে অনেক খোটা দেয়।
রনি তা মুখবুজে সহ্য করে যায়। কি করবে কিছু বলতেও পারে না। একদিন প্রতিবাদ করল। তারপর তাকে সবাই ঘর থেকেই বের করে দিল। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কি করবে।
অনেক্ষন বারান্দায় বসেছিল। কিন্তু কেউ তাকে দেখে না। বড় ছেলে কাজ থেকে এসে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। ছোট ছেলে একই অবস্থা। স্ত্রীকে বলল, ‘সুমি, আমি অনেক অসুস্থ বাহিরে থাকতে পারছি না।
দয়া করে একটু জায়গা দাও ঘরে। আর প্রতিবাদ করবো না।’ তার স্ত্রীর একটু গায়েও লাগে নি। উল্টো দাড়োয়ানকে বলল, ‘কইরে রবি?
এই বুরোটাকে বের করতো এখান থেকে, ঘেন ঘেন আর ভালো লাগে না।’ দারোয়ান রবি এসে রণিকে বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, কিন্তু আমার হাত বাধা আপনাকে বাহিরে যেতেই হবে।’ রনি বলল, ‘ব্যাপার না রে, আমিই যাচ্ছি বাহিরে।’ বাহিরে যাওয়ার পর রবি বলল, ‘স্যার আপনি এতো বড় একটা কোম্পানী চালিয়েছেন, এতো মানুষের সাথে চলেছেন। কিন্তু এতোদিনে নিজের পরিবারকে চিনতে পারলেন না।
নিজের নামে কিছু সম্পত্তিতো রাখার প্রয়োজন ছিল। সবাই বলে, দেশের সবথেকে বড় বিজনেসমেন, রনি দা কিং অব বিজনেস ওয়ার্লড, যে কিনা কখনো একটি প্ল্যান এ কাজ করে না, সবসময় ২য় প্ল্যান রাখে, যার সিদ্ধান্তে আজ পর্যন্ত কোনো ভুল খুজে পাওয়া যায়নি তার মত ব্যাক্তি এত বড় ভুল মানা যায় না স্যার।’ রবির কথা শুনে রনির মুখে হাসি শুরু হলো। ‘হা!হা!হা!হা!হা!’ অনেক জোর গলায় হাসছে।
রবি তার হাসি দেখে ভয় পেতে শুরু করল। ‘কী হয়েছে, স্যার? হাসছেন কেন?’ রনি বলল, ‘এইগুলো আমার কর্মেরই ফল তাই হাসছি।
রনি দা কিং অব বিজনেস ওয়ার্লড, যে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সবাই এটা বলে তাই না? কিন্তু কেউ এটা জানেনা যে রনি তার লাইফে অনেক আগে থেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেছে। আর আজ সেই ভুলের মাসুল দেয়া শুরু হয়েছে।
সামনে আরও দিতে হবে। তুই বুঝবিনা। তোর কাছে কিছু টাকা হবে?’ ‘হ্যা স্যার, হবে।’ ‘কিছু টাকা দে আমাকে যদি বেচে থাকি পারলে দিয়ে দেবো।’ রবি কিছু টাকা দিয়ে বললো, ‘এগুলো রাখেন স্যার, ফেরত দিতে হবে না।’ টাকা নিয়ে রাতটা কোনো রকম কাটানোর জন্য রেলওয়ে স্টেশনেই চলে গেল।
প্রচন্ড ঠান্ডা, রেলওয়ে স্টেশন খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে রণি। গায়ে তার কাপড়গুলো ছাড়া আর কিছুই নেই।
একটা কম্বল থাকলেও একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারতো। ঠান্ডায় কাপতে কাপতে রাত কেটে গেল। সকাল হয়ে গেল স্টেশন মানুষে পুরে গেছে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ।
রণিও ট্রেনের এর জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে অনেক অপেক্ষার পর ট্রেনে আসল। খুব ধাক্কাধাক্কী করে উঠল ট্রেনে। ট্রেনে করে বাড়ির যাত্রা। চোখে পানি আর বুকে কষ্ট নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে রণি।
আজ অনেক বছর পর গ্রামে পা রাখল রনি, প্রায় ৩০ বছর। শহরের মতো রাস্তাঘাটে এতো মানুষ নেই, সব ফাকা। বাড়ির দিকে হাটতে লাগল।
যত পা বাড়ায় মনে পরে সেই ছোটবেলার দিনগুলো। কত শান্তি না ছিল তখন। কোনা চিন্তা ছিল না কোনো কাজ ছিল না সারাদিন মাস্তি করত। এগুলো ভেবে হাটতে হাটতে বাড়ি পৌঁছে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখল তার বাড়ি পুরো ফাকা।
রমেশ আগে বাড়ির খেয়াল রাখতো। কিন্তু রমেশ গত বছর মারা গেছে, তাই বাড়ির খেয়াল রাখার মত আর কেউ নেই। বাড়িতে ঢুকল।
পা বাড়ানোর সাথে সাথে মনে পরছে মা-বাবর সাথে কাটানো সেই দিনগুলো। কত ভালোই না ছিল সেই দিনগুলো। মা-বাবা কত আদর করত তাকে। খাওয়ার সময় হলে বলতে হতো না, মা তার আগেই খাবার এনে দিত। কিছু লাগলে বাবাকে বললে বাবা না পারলেও ধার করে এনে দিত।
একটু অসুস্থ হলে বাবা-মা দুইজনই অনেক চিন্তায় পরে যেত আর সারারাত তার পাশে বসে থাকত, যদি কোনো কিছু চায় সে। এইসব মনে করে কাদতে লাগল।
চোখের পানি মুছে রান্না ঘরের দিকে গেল কিছু খাবার আছে কি না দেখার জন্য। মনে পরল এত বছর ঘর ফাকা খাবার কোথা থেকে আসবে। হঠাৎ খেয়াল হলো বারান্দায় কিছু ফল গাছ দেখেছে। তাড়াতাড়ি করে বারান্দায় গেল। প্রথমে সে চিন্তার কারনে খেয়াল করে নি।
কিন্তু অনেক গাছ। রনির মা অনেক ধরনের ফল গাছ লাগিয়েছিল। যদি কখনো রনি আসে তাহলে তাকে যদি কিছু খেতে দিতে না পারে এইভেবে গাছগুলো লাগিয়েছিল। গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রনির চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগল।
কেন সে তার মা-বাবার সাথে এমন করল। তারা রনিকে এতো ভালোবাসতো এটাই বুঝি তাদের দোষ ছিল। তবুও তখনতো তাদের আসে-পাশে অনেক মানুষ ছিল যারা একটু হলেও তাদের কথা ভাবত। কিন্তু আজ রনি তাদের থেকেও একা। একটু কান্না শেষ রনি হাসতে লাগল।
হাসতে হাসতে আবার কাদতে লাগল। বুঝতেই পারছে না কি পরছে। কিছু পেয়ারা পেরে ঘরে নিয়ে গেল। পেয়ারাগুলো ধুয়ে খাটের ওপর গিয়ে বসল আর পেয়ারা খেতে শুরু করল। যত খায় তত কান্না আরও বারে। এভাবে পেয়ারা খাওয়া শেষ হলো।
তারপর চিত হয়ে শুয়ে পরল খাটে। একলা ঘরে রনি। একটা মানুষের ছায়াও নেই। এভাবেই ২ মাসেরও বেশি কেটে গেল।
এখন রনি অনেক অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠার শক্তি নেই। তাও অনেক কষ্ট করে উঠে। না উঠলে খাবে কি করে? আর না খেলে বাচবে কি করে? দেখার মতো কেউ নেই। কয়েকদিন পর আর বিছানা থেকে উঠতে পারে না। সব শক্তি শেষ। চিৎকারও করতে পারে না।
তার শব্দ যেন থমকে গেছে। পুরো জীবনের সব বাদ দিয়ে এখন শুধু একটু শান্তিতে মরতে চেয়েছিল। কিন্তু আর মনে হয় শান্তি পাবে না। তাও আবার ক্যান্সারের রোগী।
কত কষ্ট। আর সহ্য হয় না। নিজের মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। কখন তার মৃত্যু আসবে আর এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। রনি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকে। দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে।
এভাবেই একদিন তার মৃত্যু এসে গেল। এক সপ্তাহ মুখে কিছু পরেনি। বিছানা থেকে উঠতেই পারে না খাবে কি? জীবন যেন বেরিয়ে যাচ্ছে।
এতো কষ্ট সহ্য করতে করতে হঠাৎ তার মৃত্যুর সেই অপেক্ষা শেষ হলো। মৃত্যুর পরেও শান্তি পেল না। সেই বিছানাতেই তার লাশ পরে আছে। দিনের পর দিন যায় লাশ পচতে থাকে।
লাশের পাশে বিভিন্ন পতঙ্গ, মাছি। মৃত্যুর পরও কষ্ট। খবর নেয়ার মত কেউ নেই। আর থাকলে এখানে এভাবে তার লাশ পরে থাকতো না।
দেখতে দেখতে ৫টা বছর কেটে গেল। এতোদিনে রনির লাশ কঙ্কাল হয়ে গেছে। একদিন কিছু মানুষ শহর থেকে আসলো এই গ্রামটা দেখতে। শুনেছে গ্রামটা নাকি একদম ফাকা তবে অনেক সুন্দর।
তারা ঘুরতে ঘুরতে রনির বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলো। সকল বাড়ি থেকে এই বাড়িটা দেখতে একদম আলাদা। তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে শুরু করল।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখে বিছানায় একটা কঙ্কাল শুয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কত কষ্টে ছিল এই মানুষটা। কঙ্কালের সাথে একটা নোট ও পরে আছে। কিন্তু ভয়ে কেউ নোট টা নেয়ার সাহস পাচ্ছে না।
একজন একটু সাহস করে নোট টা নিতে গেল। প্রথমে ভেবেছিল লোকটা হয়তো সুসাইড করেছে তাই সে একটা নোট লিখেছে। কিন্তু না। তারা নোট পরতে শুরু করল।
রনি তার জীবনে যা যা করেছে সব লিখা ছিল সেই নোটে। কীভাবে সে তার মা-বাবাকে কষ্ট দিয়েছে। টাকার জন্য কী কী করেছে। অবশেষে তার পরিণতি কীভাবে ভোগ করল।
সব লিখেছিল এই শেষ সময়গুলোতে। লোকগুলো তার নোট পরার পর তাদের চোখে পানি এসে গেল। নোটের শেষে রণির মনের কিছু লিখা ছিল, জীবনে আর যাই করো কখনো টাকার মায়ায় পরো না, যদি মায়ায়ই পরতে হয় তাহলে মা-বাবর মায়ায় পরো জীবনে শান্তি পাবে।
আর নাহলে আমার মতো শেষ চাওয়া শান্তিতে মৃত্যুর যোগ্যও হতে পারবে না।
You must be logged in to post a comment.