আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ আশা করি সবাই ভাল আছেন আমিও ভাল আছি আজকে আপনাদের সামনে নিয়ে এলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল যেখানে জেলেদের জীবনে নিয়ে একটি করুন ঘটনা। তাহলে চলুন দেখে আসি
জেলেদের জীবন আর যাত্রার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে । আর সেই তফাৎট্টা তৈরি করেছে রহস্যময়ী বিশাল নদী বা সাগর । আজ সেই রহস্যময়ী নদী ও জেলেদের মধ্যকার একটি জীবন্ত গল্প আমি বলবো ।
আজ আমরা বাজারে গিয়ে মাছ কিনে নিয়ে আসি ; সেই মাছ আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে কত জেলের জীবন যে বিসর্জন দিতে হয় , তা কি আমরা কেউ কখনো ভেবে দেখেছি !
তাদের জীবন যে কতটা কষ্টে অতিবাহিত হয় ; তা আমরা কেউ কখনো বোঝার ক্ষমতা রাখি না বা বুঝতেও চাই না ! আজ আমি জেলেদের জীবনের সেই কষ্টের একটি গল্প বলবো ; যেই কষ্ট আ নিজে জেলে পাড়ায় গিয়ে অনুভব করে ।
এসেছি ! যেই কষ্ট আমাকে কাঁদিয়েছে । যে কষ্ট আজও আমাকে কাঁদায় ! কুয়াকাটার একটি গ্রামের নাম মহিপুর । মহিপুর এক অজোপাড়া গাঁ ।
মাঠ - ঘাট , বন জঙ্গল পেড়িয়ে বিশাল সমুদ্রের কিনারায় এ গ্রাম । এ গ্রামটি মূলত একটি জেলে পাড়া । এই জেলে পাড়ার এক জেলে ; নাম তার মতি মিয়া ।
বিশাল সমুদ্রের বুকে এই মতি মিয়া আরো অনেক জেলেদের সাথে বিশাল বড় নৌকোতে করে মাছ ধরতে যায় প্রতিনিয়ত ।
এভাবেই চলে তার দিন । হঠাৎ একদিন ...... বিশাল বড় এক মাছের বারিতে মতি মিয়ার কোমরের এক অংশ ভেঙে যায় ! মতি মিয়া হয়ে যান পঙ্গু !
চিকিৎসার জন্য এলাকার এক প্রভাবশালী লোকের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা এক সপ্তাহের কথা বলে ধার নেন মতি মিয়া । চিকিৎসা করান মতি মিয়া সেই টাকা দিয়ে ।
দুই সপ্তাহ পরের কথা । মতি মিয়ার ষোল বছরের একটা ছেলে ছিলো । নাম ছিলো তার মুকুল । স্কুলে পড়তো মুকুল ।
একদিন সকালবেলা মুকুল স্কুলের ড্রেস পড়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রওনা হবে ; এমন সময় মুকুলের বাবার সেই পাওনাদার এসে তার দশ হাজার টাকা দাবি করে বললো যে , এক সপ্তাহের কথা বলে দুই সপ্তাহ হয়ে যাওয়ার পরেও কেন তার পাওনা টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে না ।
পাওনাদার কঠিনভাবে তার পাওনা টাকা আগামী এক সপ্তাহ পর ফেরত চাইলো । মুকুল কোনো উপায় না দেখে তার শরীর থেকে খুলে ফেললো স্কুল ড্রেস ।
তৈরি হলো আরো দশ জন জেলের মত জেলে হবার জন্য ! মুকুল তার হৃদয় থেকে লেখাপড়া করার ইচ্ছে চিরদিনের মত মুছে ফেললো শুধুমাত্র তার বাবার পাওনা টাকা পরিশোধ করার জন্য ! সেদিন সকালে কিছুক্ষণ পরেই এক বিশাল নৌকো ছাড়ার কথা ছিলো ।
সেই নৌকোতে দশ জন জেলে যাত্রা করবে মাছ ধরার জন্য । সেই দশ জন জেলের একজন জেলে হলো মুকুল ! ওই নৌকোতে আরেকজন জেলে ছিলো , যার মাত্র ছয় বছরের একটি অবুঝ শিশু ছিলো । যে শিশু তার বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না ।
শিশুটি তার বাবাকে বাড়ি থেকে বের হবার সময় বলেছিলো ফেরার পথে যেন তার জন্য গরুর গোশত নিয়ে আসে । বাবা বের হবার সময় মেয়ের আবদার শুনে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আনবে বলে চলে যায় নৌকোতে করে সমুদ্রের গভীরে !
দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়ালো , সন্ধ্যাও শেষ হলো । কিন্তু মুকুলরা ফিরলো না ! রাতে মতি মিয়া তার বউকে আরো নয়জনের বাড়ি খোঁজ নিতে বললেন যে সবাই ফিরেছে কি না ?
মুকুলের মা খোঁজ নিয়ে জানলেন যে কেউই এখনো ফেরেননি । তিনি ভাবলেন ফিরতে হয়তো দেরি হবে । তাই তিনি ছেলে মুকুলের জন্য ভাত বেরে ঘুমিয়ে যান ; যেন ছেলে এসে ভাত খেতে পারেন ।
এদিকে ছোট্ট মেয়েটিও বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার মাকে বলে যে কখন তার বাবা তার জন্য গরুর গোশত নিয়ে আসবে ! বাবা কেন আসছে না !
তার মাকে আরো নানা ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে করে অস্থির করে তুলছে ! মা শেষে নানা কিছু বুঝিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে শিশুটিকে ঘুম পাড়ায় !
পরেরদিন সকালবেলা মুকুলের মা ঘুম থেকে উঠে দেখে যে মুকুলের ভাত এখনো সেভাবেই আছে যেভাবে রাতে তিনি রেখেছিলেন ! তিনি বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে মুকুল বাড়ি ফেরেনি ! মুকুলের মা তখন পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ।
দশজন জেলের বাড়ি থেকেই লোক নেমে পড়লো নৌকো নিয়ে বিশাল সমুদ্রে । তবুও কেউ খুঁজে পাচ্ছিলো না মুকুলদের নৌকো ! চারদিকে কান্নাকাটির রোল পরে গেলো ! এমন খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলো সপ্তাহের পর সপ্তাহ , মাসের পর মাস !
তবুও বিশাল সমদ্র আর ফিরিয়ে দিলো না মুকুলদের কাঙ্ক্ষিত সেই হারিয়ে যাওয়া নৌকো ! এদিকে মুকুলের বাবার সেই পাওনাদার প্রতিনিয়ত এসে তার পাওনা টাকার জন্য নানা কটু কথা শুনিয়ে যান ও টাকা দিতে বলেন । আরো বলেন এমন হবে জানলে মতি মিয়া মরে গেলেও তিনি টাকা দিতেন না ।
আর কী হবে মাত্র ছয় বছরের সেই ছোট্ট শিশুর ! যে আজও তার বাবার জন্য বসে আছে ! বসে আছে তার বাবার ভালোবাসা পাবার জন্য ! বসে আছে কখন তার বাবা মুরগি নিয়ে আসবে আর কখন সে তা খাবে ; বাবার কোলে উঠবে !
আর মেয়ের মা চিৎকার করে বলতে থাকেন – ” তোমাগো হাতে ধরি পায়ে ধরি , তোমরা মাইয়ার বাপের লাশটারেই আইন্না দাও । আমি নিজ হাতে মাডি দিয়া দিলডারে শান্তি করি ।
” এই গল্প যখন আমি শুনি , তখন আতকে উঠি ! আমি তখন জিজ্ঞেস করি কোনো সংস্থা বা মিডিয়া তাদের সাহায্য করেছিলো কি না ?
তখন তারা আমাকে যা বলেছিলো তাতে আমি না কেঁদে থাকতে পারিনি ! তারা বলেছিলো তারা নাকি কোনো মানুষের কাতারে নাকি পড়ে না ! তাই তাদের কোনো সাহায্য কেউ করেনি ! জেলেদের জীবন নাকি কোনো জীবন না !
এমনকি গভীর কষ্টে তারা আমার কাছ থেকেও সাহায্য চাইছিলো না ! শুধু বলেছিলো - ” তোমরা পারলে আমাগো মানুষগো আইন্না দাও ; ইট্টু শেষ দ্যাহা দেহি ! ” আমি আর স্থির থাকতে পারছিলাম না ! চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম !
আমি যখন জেলে পাড়া থেকে চলে আসছিলাম , তখন কান্না ভরা নয়নে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের " পদ্মা নদীর মাঝি ” উপন্যাসের কিছু কথা বার বার মনে পড়ছিলো" ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে ; এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না ! ” একটু কী ভেবে দেখেছেন যে , এই মানুষগুলো জীবনে কতটা করুণ !
কেউ বাবা হারিয়ে এতিম , কেউ বা হারায় ছেলে হারিয়ে নিঃস্ব ! আবার কেউ স্বামীকে হারিয়ে অভাগিনী ! হয়তো বা বাবা হারানো এই সন্তান আগামী দিনের জেলে !
সেই জেলে , যে নিজের জীবনের ঝুঁকি জেনেও আপনার পছন্দের মাছটা আপনার সামনে হাজির করে । অথচ আমরা কী করি ? তারা যদি আমাদের কাছে দেড়শো টাকার মাছ দুইশ টাকা চায় , তবেই আমরা তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করি ।
আমাদের কাছে খুব বেশি দাম হয়ে যায় ! আমরা ভাবি কেন পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়ে মাছ কিনবো ! আর এই সামান্য কিছু টাকা বেশি দিয়ে মাছতো কিনি না ।
কেন করি বলেন তো ? কারণ আমরা তাদেরকে সম্মান করি না , সম্মান দিতে চাই না । মনে করি তাদেরকে সম্মান দিলে হয়তো আমরা আমাদের মান - সম্মানের কমতি ঘটাবো ! সত্য কিন্তু তা নয় ।
আমরা একটু ভাবলেই দেখতে পাবো যে , তারা অনেক সাহসী নাবিক ! যারা কি না কাজের জন্য নিজের জীবনের মায়া পর্যন্ত করে না !
চলুন না , আমরা সবাই তাদেরকে একটু বেশি টাকা দিতে পারি না । অন্তত পক্ষে একটু ভালো ব্যবহারতো করতে পারি ? তাদের প্রতি একটু ভালো ব্যবহার আজ থেকে আমরা করবো , তাদেরকে সম্মান করবো । আর এটাই আপনার কাছে চাওয়া !
You must be logged in to post a comment.