সম্মানিত প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছেন। সবাইকে জানাই অগ্রিম ইদের শুভেচ্ছা।
দীর্ঘ রমজান মাস রোজা রাখার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পাপ মোচনের পাশাপাশি খুশির ইদ উপহার দিয়েছেন।তাই প্রতিটি মুসলমানের কাছে এটি অত্যন্ত আনন্দের একটি দিন।
প্রতি বছরই আমরা দুটি ইদ পেয়ে থাকি।আর এই ইদকে ঘিরে থাকে অনেক আয়োজন। এ দিন ঘরে ঘরে চলে মিষ্টান্ন খাবারের উৎসব। আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে ইদের মিষ্টান্ন খাবারের নাম বললে প্রথমেই যে খাবার আসবে, তা হলো সেমাই।
সেমাই ছাড়া এই অঞ্চলের ইদের কথা ভাবাই যায় না।এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারেও আর কিছু না থাকলেও সেমাই পাওয়া যাবে। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা ইদের আগেই রোজাদার সবাইকে ফিতরা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে ধনী গরিব সবাই মিলে ইদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
এছাড়া ইদের আগেই বেশির ভাগ ধনীরা যাকাতের টাকা দিয়ে থাকে এবং বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিরা গরিব, অসহায়, দুস্থ মানুষদের ইদ উপহার হিসেবে সেমাই ও কিছু ইদ সামগ্রী দিয়ে থাকে। ফলে ধনী গরিব সবাই খুশির আমেজে ইদ পালন করে।
ইদ উপলক্ষে বাজারের দোকানগুলোতে অহরহ সেমাই বিক্রি করতে দেখা যায়। অতি নিম্ন মানের, নিম্ন মূল্যের সেমাই থেকে অতি উচ্চ মানের সব ধরনের সেমাই পাওয়া যায় দোকানগুলোতে।তবে সেমাই কেনার আগে অবশ্যই দেখে শুনে সেমাই কেনা ভালো।
কারণ ইদ উপলক্ষে বেশি সেমাই তৈরি করতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও বিভিন্ন ভেজাল মিশিয়ে সেমাই তৈরি করার ফলে সেগুলো খেয়ে প্রতিবছরই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তাই প্যাকেট সেমাই কিনতে পারলে, খোলা সেমাই এড়িয়ে যাবেন এবং প্যাকেট সেমাইটিও স্বাস্থ্যসম্মত কি না তা জেনে নিয়ে দেখে কেনা ভালো।বাজারে এখন বিভিন্ন ধরনের সেমাই পাওয়া যায়। সেখান থেকে আপনার পছন্দের সেমাই কিনতে পাবেন।
আর আজকে আমি আপনাদের, ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন, এই সেমাই রান্নার রেসিপি সম্পর্কেই বলব।যেহেতু বাজারে এখন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সেমাই পাওয়া যায়, তাই রাঁধুনিরাও চেষ্টা করে সেমাইয়ের সুন্দর সুন্দর সব রেসিপি বানিয়ে সবার মন জয় করতে। তাহলে চলুন রেসিপিগুলো শুরু করা যাক।
(১)লাচ্চা সেমাই রেসিপি
বাজারে লাচ্চা সেমাই এর চাহিদা অনেক বেশি।ঘিয়ে ভাজা লাচ্চা সেমাই ছোট বড় সবাই পছন্দ করে। বাজারের খোলা সেমাই খেতে যেমন ভিন্ন, তেমনি লাচ্চা সেমাই খেতেও কিছুটা ভিন্ন এবং দারুন।
ধনী ব্যক্তিরা সাধারণত লাচ্চা সেমাই দিয়েই ইদ পালন করে।লাচ্চা সেমাই রান্নার উপকরণ ও রান্নার পদ্ধতি তাহলে দেখে নিই চলুন।
উপকরণ
১,লাচ্চা সেমাই এক প্যাকেট
২,দুধ ১ লিটার বা আধা লিটার
৩,পরিমাণ মতন চিনি
৪,কুড়ানো নারকেল
৫,রকমারি সব বাদাম
৬,কিসমিস
৭,এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা মসলা
৮,ঘি অথবা তেল
৯,পানি ও সামান্য লবণ।
যেভাবে রান্না করবেন,
১,লাচ্চা সেমাই রান্না করতে প্রথমে, ঘি বা তেল দিয়ে সেমাই সামান্য ভেজে নিতে হবে, যদি সেমাই আগেই ভাজা থাকে তাহলে এটি করার দরকার নেই।
২,এরপর পাতিলে তরল দুধ গরম করতে হবে ও দুধের মধ্য চিনি, এলাচ,তেজপাতা,কুড়ানো নারকেল ও বাকি সব মসলা দিয়ে দিবেন।আপনে চাইলে কিসমিস ও কাচা চিনাবাদাম দুধের মধ্য দিতে পারেন।
যদিও অনেকে এগুলো পরে দিতে পছন্দ করে।আপনে আপনার পছন্দ মতন করবেন। দুধ গরম করে বলক উঠলে এর মধ্যে সেমাই দিয়ে দেবেন অথবা একটা সুন্দর বাটিতে অল্প সেমাই দিয়ে এর উপর বলক তোলা দুধ দিবেন,এরপর আবার অল্প সেমাই দিয়ে তাতে দুধ ঢেলে দিবেন।
এভাবে বাটিতে সেমাই ও বেশি পরিমাণ দুধ দিয়ে সামান্য ক্ষণ রাখলেই তৈরি হবে লাচ্ছা সেমাই রান্নার রেসিপি। এতে কিছু কুঁচি করে কাটা বাদাম বা আপনার পছন্দের গোটা বাদামই(যেমন,কাজুবাদাম)দিতে পারেন। এরপর পরিবেশন করুন মজাদার লাচ্ছা সেমাই।
(২)চিকন সেমাই রেসিপি
লাচ্চা সেমাই এর মতো চিকন সেমাইও বাজারে সহজেই পেয়ে যাবেন।তবে লাচ্চা সেমাই, প্যাকেট ও খোলা পাওয়া গেলেও,চিকন সেমাই প্যাকেট ছাড়া সাধারণত পাবেন না।
এমন অনেকে আছেন যারা লাচ্ছা সেমাই থেকে চিকন সেমাই বেশি পছন্দ করেন।আমিও তাদের মধ্যে একজন।তবে কিছু চিকন সেমাই আছে যেগুলো একেবারে গলে যায়,ফলে তেমন ভালো লাগে না,আটা দেয়া মনে হয়।
তাই দেখে শুনে কেনা ভালো।যেগুলো গলে যায় না সেগুলো কিনবেন। সেগুলো খেতে দারুন লাগে।
উপকরণ
১,চিকন সেমাই এক প্যাকেট
২,দুধ ১ লিটার বা আধা লিটার
৩,পরিমাণ মতন চিনি
৪,কুড়ানো নারকেল
৫,রকমারি সব বাদাম
৬,কিসমিস
৭,সাদা এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা ইত্যাদি মসলা
৮,ঘি অথবা তেল
৯,পানি ও সামান্য লবণ।
চিকন সেমাই রান্নার পদ্ধতি
১,চিকন সেমাই রান্নার নিয়ম লাচ্চা সেমাই রান্নার মতোই সবকিছু। এতে অতিরিক্ত কিছু করার দরকার নেই। এখানে শুধু চিকন সেমাই দিবেন লাচ্ছা সেমাই এর বদলে।আগেই বলেছি কেউ লাচ্চার বদলে চিকন সেমাই পছন্দ করে।
অর্থাৎ রান্নার পদ্ধতি একই হলেও স্বাদে রয়েছে ভিন্নতা। চিকন সেমাই প্রেমীদের কাছে এই সেমাই ছাড়া অন্য সেমাই তেমন গুরুত্ব পায় না।
লাচ্চা ও চিকন সেমাই প্রেমীদের জন্য রেসিপি গুলো কাজে দিবে আশা করি।
(৩)জর্দা সেমাই রেসিপি
বিলাসবহুল ভোজন রসিকরা প্রতি ইদেই অন্য সব আইটেমের পাশাপাশি জর্দা সেমাই রেসিপিটি খেয়ে থাকে।আর রান্না প্রিয় বিলাসী রাঁধুনিরাও এটি তৈরি করতে না পারলে তাদের রান্না পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করে না।
চলুন দেখে নেয়া যাক কিভাবে এটি তৈরি করে ও উপকরণ কি কি লাগছে।
উপকরণ
১,সেমাই এক প্যাকেট
২,পরিমাণ মতন চিনি
৩,কুড়ানো নারকেল
৪,রকমারি সব বাদাম
৫,কিসমিস
৬,সাদা এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা মসলা
৭,ঘি অথবা তেল
৮,উষ্ণ গরম পানি ও সামান্য লবণ।
যে নিয়ম এ তৈরি করবেন
১,হালকা গরম পানিতে সেমাই ভিজিয়ে রাখবেন ২০ থেকে ৩০ মিনিট।
২,এরপর পানি থেকে উঠিয়ে পানি ঝরতে দিবেন।
৩,এবার চুলায় কড়াই বসিয়ে,এতে কুড়ানো নারকেল ও মসলা সব দিয়ে সামান্য ভেজে পানি ঝরানো সেমাই দিয়ে দিবেন এবং নাড়তে থাকবেন।
৪,যতক্ষণ পর্যন্ত না সেমাই এর পানি না শুকাই ততক্ষণ পর্যন্ত নাড়তে হবে।এরপর এতে চিনি দিয়ে আবার ভালো করে ঘি দিয়ে ভেজে নামিয়ে ফেলুন।
এতে কিসমিস ও বাদাম দিয়ে দিন।আপনে চাইলে ভাজার সময়ও এগুলো দিতে পারেন। তৈরি হয়ে গেল সেমাই জর্দা রেসিপি। পরিবেশন করুন প্রিয়জনদের সাথে।
(৪)চুটকি সেমাই রেসিপি
দোকানে কিনতে পাওয়া যায় এবং আপনি চাইলে বাড়িতে বসে হাতেও তৈরি করতে পারেন এই চুটকি সেমাই।অনেকই এটি খেতে দারুন পছন্দ করে।
হাতে তৈরির ক্ষেত্রে এটি বানানো হয় চালের আটা দিয়ে এবং রোদে শুকিয়ে রাখা হয়।গ্রামে এ টি বেশি বানানো হয়।তাহলে চুটকি সেমাই রান্নার নিয়ম ও উপকরণ গুলো দেখে নিন।
উপকরণ
১,চুটকি সেমাই এক প্যাকেট বা সমপরিমাণ
২,দুধ ১ লিটার বা আধা লিটার
৩,পরিমাণ মতন চিনি
৪,কুড়ানো নারকেল
৫,রকমারি সব বাদাম
৬,কিসমিস
৭,সাদা এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা মসলা
৮,ঘি অথবা তেল
৯,উষ্ণ গরম পানি ও সামান্য লবণ।
কিভাবে বানাবেন
১,চুটকি সেমাই রান্নার পদ্ধতি লাচ্ছা বা চিকন সেমাই রান্নার মতোই।এক্ষেত্রে বাটিতে রেখে করা যাবে না, পাতিলের গরম দুধের মধ্যে দিয়েই বেশিক্ষণ ধরে জ্বাল করে রান্না করতে হবে,যাতে চুটকি সেমাই শক্ত না থাকে।
কারণ চুটকি সেমাই নরম না হলে খেতে ভালো লাগবে না।আপনারা চাইলে রান্নার আগে হালকা গরম পানিতে চুটকি সেমাই ভিজিয়ে রাখতে পারেন কিছুক্ষণ।এতে চুটকি সেমাই তারাতাড়ি সিদ্ধ হবে।
(৫)ভাজা সেমাই রেসিপি
ভাজা সেমাই খেতে যে কতটা ভালো লাগে,তা যারা একবার হলেও খেয়েছে তারা বলতে পারবে।আপনি চাইলে এটি কাচের জার বা বোয়ামে করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারবেন।
যেহেতু খেতে দারুন,বেশিদিন রাখার আগেই সবাই খেয়ে শেষ করে দিবে হয়তো।তাই সাবধানে রাখতে পারেন।
উপকরণ
১,সেমাই এক প্যাকেট
২,পরিমাণ মতন চিনি
৪,কুড়ানো নারকেল
৫,রকমারি সব বাদাম
৬,কিসমিস
৭,সাদা এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা মসলা
৮,ঘি অথবা তেল
৯,সামান্য লবণ।
১০,পেঁয়াজ কুঁচি
১১,সামান্য আদা রসুন এর পেস্ট
কিভাবে বানাবেন
১,প্রথমে চুলাই কড়াই বসিয়ে তাতে তেল দিয়ে একে একে এলাচ,পেঁয়াজ কুঁচি,বাদাম,কিসমিস ও বাকি মসলা সব দিয়ে নাড়তে থাকুন।
২,ভালো করে ভাজা হয়ে গেলে,এর মধ্যে সেমাই দিয়ে দিন এবং নাড়তে থাকুন।
৩,নাড়তে নাড়তে দেখবেন সেমাই ছোট ছোট টুকরো সাইজে হয়ে যাবে,এরপর এর মধ্যে পরিমাণ মত চিনি ছিটিয়ে দিয়ে আবার নাড়তে থাকুন।
সেমাই বাদামি রঙের হয়ে গেলে নামিয়ে ফেলুন এবং পরিবেশন করুন মজাদার সেমাই ভাজি।এটি খেতে খুবই ভালো লাগবে।
(৬)সেমাই সুজির বরফি রেসিপি
যারা ইদে অল্প আইটেম এ সন্তুষ্ট হতে পারেন না,তারা সাধারণত অধিক আইটেম করতে সেমাই সুজির বরফি রেসিপি করতে পারেন।
উপকরণ
১,সেমাই পরিমাণ মত ও
২,সুজি পরিমাণ মত
৩,দুধ ১ লিটার বা আধা লিটার
৪,পরিমাণ মতন চিনি
৫,কুড়ানো নারকেল
৬,রকমারি সব বাদাম
৭,কিসমিস
৮,সাদা এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা মসলা
৯,ঘি অথবা তেল
১০, সামান্য লবণ।
বানানোর নিয়ম
১,পাতলা করে সেমাই রান্না করে নিবেন এবং
২,পাতলা করে সুজি রান্না করে, সেমাই ও সুজি একসাথে পাতিলে জ্বাল করে হালকা ঘন হলে বাটিতে করে নামিয়ে ফেলবেন।
বাটিটি কিছুক্ষণ ফ্রীজে রাখতে পারেন, না রাখলেও সমস্যা নাই কিছুক্ষণ রাখলে এমনিতেই জমে যাবে।জমে গেলে আপনার ইচ্ছা মত সাইজে কেটে পরিবেশন করুন।
(৭)সেমাই পায়েশ রেসিপি
সেমাই ও পায়েস, দুটি খাবারই সবার খুবই পছন্দের। আর এই দুটি খাবার একসাথে করলে খেতে আরও দারুণ লাগবে,এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপকরণ
১,সেমাই এক প্যাকেট
২,সুগন্ধিযুক্ত চাল
৩,পরিমান মত চিনি
৪,কুড়ানো নারকেল
৫,রকমারি সব বাদাম
৬,কিসমিস
৭,সাদা এলাচ,দারুচিনি, তেজপাতা মসলা
৮,ঘি অথবা তেল
৯,সামান্য লবণ।
১০,পরিমাণ মতো দুধ
যেভাবে বানাবেন
১,সেমাই পাতলা করে রান্না করে নিবেন।
২,এরপর পায়েস রান্নার পদ্ধতি তো সবাই জানা।তাও সংক্ষেপে বলছি। সুগন্ধিযুক্ত চাল হালকা সিদ্ধ করে, অন্য পাতিলে দুধের মধ্যে সব উপকরণ দিয়ে জ্বাল করে এতে সিদ্ধ চাল দিয়ে ভালো করে ঘেটে ঘেটে তৈরি করুন পায়েস।
৩,এবার সেমাই ও পায়েস একসাথে করে হালকা জ্বাল করে নামিয়ে ফেলুন এবং পরিবেশন করুন মজাদার সেমাইয়ের পায়েস রেসিপি। এটি খেতে দারুন লাগে।আপনারা বাসায় তৈরি করে দেখবেন।
সবশেষে এটাই বলব,আপনাদের ইদ কাটুক আনন্দের সাথে।সুন্দর সুন্দর রেসিপি উপহার দিন পরিবারকে। অবশ্য উপরোক্ত রেসিপি গুলো ছাড়াও আপনারা সেমাই এর বিভিন্ন ডেজার্ট, লাড্ডু, ফালুদা ইত্যাদি তৈরি করতে পারবেন।
আজকের আর্টিকেলটি পড়ার জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।
You must be logged in to post a comment.