শীতের সকালে ফযরের নামায পড়ে যখন কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির স্পর্শ নিতে বের হই তখনই চোখে পড়ে কনকনে শীতের সাথে লড়াই করা জীবন যুদ্ধের লড়াকু সৈনিকদের। মনে হয় যেন, এরাই প্রকৃতির
সূচনা
ধারক। প্রকৃতির সৌন্দর্য, এদের কারণেই শীত তার মহিমা খুঁজে পায়।
শীত মানেই পিঠাপুলির ধুম। বাড়িতে বাড়িতে চাঁদের হাট। এসময়ে নানা রকম বিহারি পিঠার আয়োজন বাঙালি সংস্কৃতির একটা অংশ। বিশেষ করে নানীর বাড়ি পিঠা খাওয়ার আনন্দের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে।! এছাড়াও এই সময়কে দাওয়াতের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ পিঠা।
আর পিঠার কথা যখন চলে আসে তখন খেজুরের গুড়ের কথা না বললেই নয়। নভেম্বরের শুরুর দিকে গ্রামের কৃষক ভাইয়েরা যখন খেজুরের গাছ ঝুড়তে শুরু করে তখনই শরীর ও হৃদয়ে শীতের শিহরণ বয়ে যায়।
কুয়াশার সৈনিক
শীতের সকালে ফযরের নামায পড়ে যখন কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির স্পর্শ নিতে বের হই তখনই চোখে পড়ে কনকনে শীতের সাথে লড়াই করা জীবন যুদ্ধের লড়াকু সৈনিকদের। মনে হয় যেন, এরাই প্রকৃতির ধারক। প্রকৃতির সৌন্দর্য, এদের কারণেই শীত তার মহিমা খুঁজে পায়।
যাদের গ্রামের ভাষায় বলে "গাছি "।
মাঝে মাঝে তাদের গল্প শুনি মুগ্ধ হই। তাদের জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি খুব কাছ থেকে দেখি। যে শীতের তীব্রতায় আমরা লেপ-কম্বল গায়ে দিয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকি। সেই একই শীতকে আলিঙ্গন করে তারা বেড়িয়ে পড়েন গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ ধরে। মাথায় গামছা, পরনে সামান্য জামা। এগাছ থেকে ওগাছে চলছে রস সংগ্রহ।
এমন নয় যে, শীত তাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। তারাও ঠান্ডায় বরফ হয়ে যায়। প্রতিবছর তাদের করুণ মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে আছে এই পৃথিবী। তাদেরও কষ্ট হয় লেপ কাথার উস্মতা ত্যাগ করতে। কিন্তু জীবনযুদ্ধ তাদের শিখিয়েছে কিভাবে শীতের সাথে পাঞ্জা লড়তে হয়।
খেজুরের গুড় নিয়ে কাজ শুরু
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস। সদ্য অনার্স ৩ বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছি। খেজুরের অরন্যে বাড়ি হওয়ার কারণে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছিল খাটি খেজুরের গুড় নিয়ে কাজ করতে। যে নোংরা মার্কেট চিনি, হাইডোজ, ফিটকিরি, রঙ ইত্যাদি দিয়ে দেশের মানুষকে ধোকা দিচ্ছে।
অন্যদিকে খেজুরের গুড় দেশব্যাপী তার গ্রহনযোগ্যতা হারাচ্ছে। সেই নোংরা মার্কেটের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, গাছি ভাইদের সাথে মিলে এমন মার্কেট তৈরি করি।
আমিও বিষয়টা আমলে নিলাম। যেহুতু এই সময়টাতে পড়াশোনার চাপ কম। অন্যদিকে খাটি গুড় দিতে পারলে মানুষের মধ্যে গুড়ের আস্থা ফিরে আসবে আবার হাতখরচের কিছু টাকাও হবে।
সেই সুবাদে দীর্ঘ ৩ মাস কৃষক ভাইদের মাঠ ঘাট চষে বেড়িয়েছি। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাদের সংগ্রাম। খাটি খেজুরের গুড় তৈরি করতে কি পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়। আমারও কষ্ট হয়েছে অনেক ফযরের নামায পড়ে চলে যেতাম তাদের সাথে রস নামাতে। বেলা ১০ পর্যন্ত সময় কাটত তাদের সাথে।
সত্যি বলতে এটা এক দিক দিয়ে কষ্টের অন্যদিকে মজার। এমন হাড় কাপানো শীতে টাটকা খেজুরের রসের মজা কি টাকা দিয়ে কেনা যায়?
কৃষকদের সমস্যা
বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি সমস্যা থেকেই যায়। তাহল, কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পায়ন। খেজুরের গুড়ের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। যারা তাদের থেকে খেজুরের গুড় নিয়ে বিক্রি করে, তারা খুব ভালো পরিমাণ অর্থ নিয়েই বিক্রি করে। কিন্তু গুড় প্রস্তুতকারীরা তাদের পরিশ্রম অনুযায়ী উপযুক্ত মূল্য পায় না।
অনেকাংশে দেখা যায় যে অনেক কৃষক হতাশ হয়ে এই খেজুরের গাছ কেটে ফেলেন এবং খেজুরের গুড় তৈরি করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন । এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে একদিন বাংলাদেশের বুক থেকে খেজুরের গুড়ের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।
এজন্য আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে কৃষকদেরকে তাদের ন্যায্য মূল্য দিয়ে তাদেরকে এই পেশায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। এবং খেজুরের গাছ যেন না কাটা হয় সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে ভূমিকা রাখতে হবে।
ফারুক আহমাদ
বিএ অনার্স (আরবী সাহিত্য)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
You must be logged in to post a comment.