গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ছিলেন আরেক গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র। সক্রেটিস পর্যাপ্ত বিশাল দার্শনিক হলেও তাঁর কোনো লেখা পাওয়া যায় না।
প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতেরা স্মৃতিবিদ্যায় পটু ছিলেন। তাঁরা একটি প্রাসাদ কল্পনা করে সেখানকার একেক কামরায় নানারকম ইনফরমেশন রেখে দিতেন। পরে ওই প্রাসাদে কাল্পনিক ভ্রমণের মাধ্যমে সেই ডেটাগুলো পুনরুদ্ধার করতেন।
এই পদ্ধতি মেথড অব লোসাই নামে পরিচিত (Method of Loci, গ্রিক ল্যাংগুয়েজে লোসাই মানে স্থান)। প্লেটো স্মরণ হতে সক্রেটিসের নানারকম আলাপআলোচনা ও তাঁর বিচারের জবানবন্দি সংলাপ আকারে লিখে রেখে গিয়েছিলেন।
প্লেটো নিজেও প্রচুর লিখেছেন। তবে তিনি আবার লেখনীর প্রচলন দেখে অন্যদের সাবধানও করে দিয়েছিলেন। তার ত্রাস ছিল, লেখনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে সমসাময়িক গ্রিকরা স্মৃতিশক্তি ইউজ করা থেকে নিরুত্সাহিত হবে।
আধুনিক যুগেও এমন অনেককে পাওয়া যাবে, যাঁরা মনে করেন গুগল আমাদের নির্ভেজাল অজ্ঞ বানাচ্ছে, সোশ্যাল মাধ্যম আমাদের অসামাজিক করে তুলছে আর স্মার্টফোন আমাদের করে তুলছে অস্থির, চপলমতি, খামখেয়ালি।
এই ধরনের কথাবার্তা স্মার্ট প্রযুক্তির পজিটিভ দিকগুলোকে মোটেই ধর্তব্যের মধ্যে না এনে একচোখা সমালোচনা করে।
টেকনোলজি আমাদের ওপর কী ইফেক্ট ফেলছে, তা এককথায় বলা হয় দেওয়ার জন্য যথাৰ্থ অবস্থা বেশ জটিল। কিন্তু প্রযুক্তির একটা নেগেটিভ প্রভাব যে রয়েছে, সেটি আমরা অনুভব করতে পারি।
অল্পসংখ্যক বছর প্রথমে যেখানে এক ডজন ফোন নম্বর মনে থাকত, অধুনা নিজের নম্বরই মনে করতে দুঃখ হয়ে যায়। অর্ধেকের বেশি অনলাইন বক্তা বিশাল প্রবন্ধের জায়গায় শ শব্দের ছোট লিখনি পড়তে পছন্দ করেন।
আর আমরা প্রত্যেকেই এইরকম কাউকে চিনি, যিনি আধা ঘণ্টাও স্মার্টফোনে একবার অক্ষি না বুলিয়ে থাকতে পারেন না।
প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্ককে বদলে দিচ্ছে কি না, সে-বিষয়ক কতিপয় গবেষণার খোজ-খবর জানা যাক।
আমরা গোল্ডফিশের নিয়ে হাসিঠাট্টা করি, যেটার স্থায়িত্ব নাকি ৩ সেকেন্ড। এটা মিথ। অ্যাকুরিয়ামে পোষা এই মাছের পাঁচ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যদি বলি, গোল্ডফিশের অভিনিবেশ দেওয়ার ক্ষমতা মানুষকে টেক্কা দেবে, তাহলে আমাদের অহংবোধে বেদনা লাগবে কি?
২০১৫ সালে কানাডায় পরিচালিত এক তত্ত্বানুসন্ধানে দেখা গেছে, তারা কোনো বিষয়ে গড়ে মাত্র ৮ সেকেন্ড মনোযোগ ধরে রাখার জন্য পারে, যেখানে গোল্ডফিশ মানুষের চেয়ে এক সেকেন্ড অধিক অভিনিবেশ ধরে রাখার জন্য পারে।
এর ১৫ বছর আগের একটি তত্ত্বানুসন্ধান অনুসারে মানুষের অভিনিবেশ ধরে রাখার স্থায়িত্ব ছিল গড়ে ১২ সেকেন্ড। কেবলমাত্র উক্ত গবেষণা নয়, ২০১২ বছরের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পুয়ের্তো রিকোর হাজার হাজার শিক্ষকের চালিত জরিপ বলছে,
এখনকার স্কুল শিক্ষার্থীরা বেশিক্ষণ অভিনিবেশ ধরে রাখতে পারে না। মাত্র ১৫ সালের এইরকম কী হচ্ছে যে পুষ্ট বিশ্বের নাগরিকদের অভিনিবেশ ধরে রাখার ক্ষমতার এত অধোগতি ঘটল?
এই শতাব্দীর শুরু থেকেই মোবাইল ফোন ফোন, বিশেষ করে স্মার্টফোন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সহজলভ্য এই প্রযুক্তি পারস্পরিক যোগাযোগ যেমন করে দিয়েছে,
তেমনি মেসেজ, চ্যাট, ফেবু নোটিফিকেশনসহ প্রচুর তথ্যে ক্ষণে ক্ষণে আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। নানারকম টেকনোলজির প্রসার এবং মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায় যাওয়া-এ দুইটা ঘটনা ঘটেছে, সে জন্য তাদের মধ্যে কার্যকারণ রিলেশন আছে এমনটা আমরা বৈজ্ঞানিক ঠিক হিসেবে দাবি করতে পারব না।
কিন্তু অনেকে এমনটাই ভাবছেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী অধ্যাপক রাসেল পোল্ডরাক উদাহরণসরূপ ভাবছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি নিশ্চিত যে প্রযুক্তির কারণে আমাদের অপেক্ষা করে অভিনিবেশ দেওয়ার গেছে।
আর তাত্ক্ষণিক তথ্যের ডিমান্ড বেড়ে গেছে।’
তথ্যপ্রযুক্তি মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে কি না—এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি শিওর থেকে না পারলেও অধিক টেকনোলজি প্রয়োগে মানুষের মেজাজ বদলে দেওয়ার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন সোশ্যাল যোগাযোগমাধ্যম বহু ব্যবহার করলে আত্মবিশ্বাস নিজেকে অপটু মনে হতে পারে। অনলাইনে সকলেই নিজের সর্বসেরা পিকচার আর ইতিবাচক ঘটনার খবরই প্রধারনত সবাইকে দেখান।
এ ছাড়া নানারকম বিজ্ঞাপনে পর্যাপ্ত ছবি সম্পাদনার মাধ্যমে নিখুঁত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে প্রচারিত হয়। এই ধরনের অজস্র পিকচার নোটিশ হলে তা মস্তিষ্কের অ্যামিগডালার মতো অঞ্চলের কিছু স্নায়ুজালিকা সক্রিয় করে। সেই স্নায়ুজালিকা ডর ও দুশ্চিন্তার সাথে জড়িত।
১টি রিসার্চে লক্ষ্য গেছে, মেয়েরা তাদের মায়েদের খুদে মেসেজ পাঠালে তাদের মধ্যে কর্টিসোল হরমোন উত্পন্ন হয়। কর্টিসোল হরমোন মানসিক চাপের জন্য দায়ী, যেখানে সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল চমৎকার অনুভূতি উদ্রেককারী অক্সিটোসিন।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমরা প্রিয় মানুষদের সাহচর্যে একটি ন্যূনতম সময় কাটানোর জন্য অভিযোজিত। মানুষের পরস্পর আবেগীয় মিথস্ক্রিয়া না হলে তা শারীরিক বা মানসিক প্রবলেম প্রস্তুত করার জন্য পারে।
সোশ্যাল যোগাযোগমাধ্যমে অধিক আসক্তি আমাদের সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার টাইম কমিয়ে দেয়।
স্মৃতির উপর টেকনোলজির ইফেক্ট কী, এটা অবশ্য পরিষ্কার নয়। দিনকে দিন আমরা ফোন নম্বর এবং অন্যান্য ছোটখাটো ইনফরমেশন মনে করার জন্য স্মার্টফোন ও অনুসন্ধান ইঞ্জিনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি।
এটাকে অনেকে ইতিবাচক, অনেকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। যেমন অনেকে মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য অন্য যন্ত্র বা ইন্টারনেট ইউজ করলে মস্তিষ্কের ওপর চাপ কমে।
ফলে তুলনামূলক মুল্যবান তথ্য সহজেই স্মৃতিতে জমা রাখার জন্য যায়। অন্যদিকে, পিসি গেমে আসক্ত ব্যক্তিদের উপর করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের মস্তিষ্কের সম্মুখে ফ্রন্টাল লোবের ধূসর পদার্থ গুটানো হয়ে যায়।
ফ্রন্টাল লোব পরিকল্পনা এবং উচ্চতর টেনশনের কাজে সাহায্য করে। পিসি গেমে আসক্তি এইজন্য স্বাভাবিক স্মরণ করার ক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে।
তবে ইন্টারনেটে আসক্ত এবং সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে তুলনামূলক এক্সাম করলে বোঝা যাবে যে প্রযুক্তির এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা কতটুকু।
প্রযুক্তি আমাদের ঘুমের ওপর একটা বিশাল প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশই দিনে যতটা টাইম ঘুমান, তার চেয়ে বেশি টাইম ব্যয় করেন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।
যেমন কম্পিউটারে কাজ করা, ফোনে কথা বলা, খুদে মেসেজ লেনদেন, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও সোশাল যোগাযোগমাধ্যমসমূহে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। এসব কর্মকাণ্ড দুইভাবে ঘুমকে প্রভাবিত করছে।
প্রথমত, বিষয়বস্তু, যা হতে পারে ছবি, লেখা বা ভিডিও, যেটার জন্য আমরা ঘুমের সময়ও জেগে থাকি। দ্বিতীয়ত, মোবাইল বা এই ধরনের ডিভাইস নীল শিখা নিঃসরণ করে।
এ নীল শিখা মস্তিষ্কে ঘুমের জন্য মুল্যবান হরমোন মেলাটনিন উত্পন্ন করতে বাধা দেয়। সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল যে দিন আমরা দেখি, সেখানেও একই কম্পাঙ্কের নীল শিখা থাকে।
মুঠোফোন হতে আসা এই আলো মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থিকে বলা হয়ে থাকে দিন হয়ে গেছে, সুতরাং মেলাটনিন সৃষ্টি করা অফ করো।
আমাদের যদি মুল্যবান হিসাব ঘুম না হয়, তাহলে বিষণ্নতা, স্থূলতা, পড়াশোনা ভালো না হওয়া প্রভৃতি প্রবলেম থেকে পারে।
বিজ্ঞানীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে ঘুমের ঝামেলার রিলেশন খুঁজে পেয়েছেন। ঘুমের সময় মোবাইল ব্যবহার আশঙ্কাজনক সনামধন্য অভ্যাস হলেও তা আমাদের ঘুমে প্রবলেম এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘুম না হওয়া সংশ্লিষ্ট মনোদৈহিক বিপদের রিজন থেকে পারে।
যে দুই হাতে সমান কাজ করতে পারে, তাকে আমরা সব্যসাচী বলি। যন্ত্রের সাহায্যে আমরা একাধার প্রচুর কাজ করে ফেলতে পারি—অন্তত আমরা এজন্য ভাবি। কেউ হয়তো পড়ার টাইম বন্ধুর সঙ্গে মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে গল্প করছে,
অন্যদিকে ইয়ারফোন দ্বারা গানও শুনছে। পড়ার ফাঁকে আবার ই-মেইল বা ফেসবুক থেকেও ঘুরে আসতে চলেছে নিউ কী ঘটল তা দেখার জন্য। নানারকম গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, আমাদের ঘিলু একই পাত্র একের অধিক কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়নি।
যেমন ১টি গবেষণায় দুই টিম শিক্ষার্থীর একটিকে সুনির্দিষ্ট কাজ করার জন্য দেওয়া হলো। এর ভিতরে একটি টিম শুধুমাত্র ওই কাজটিই করছে, অন্য টিম কাজের মধ্যে খুদে বার্তাও পাঠাচ্ছে। লক্ষ্য গেল, এক কাজের মধ্যে যারা অন্য কাজ করে, তাদের অন্যদের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ অধিক সময় লাগে (বার্তা পাঠানোর টাইম বাদ দিয়েও)।
যন্ত্রের ব্যবহার হয়তো-বা আমাদের একই পাত্র প্রচুর কাজ করার জন্য সামর্থ্য দিয়েছে। কিন্তু এর জন্য কাজে অতিরিক্ত টাইম লাগার মতো মূল্যও দিতে হচ্ছে।
প্রযুক্তি আমাদের জীবন বদলে দিচ্ছে, প্রচুর কতিপয় সোজা এবং মসৃণ করে দিচ্ছে—এ ব্যাপারে কোনো নেই। তা সত্ত্বেও প্রযুক্তি কি আমাদের মস্তিষ্কও বদলে দিচ্ছে?
অবশ্যই। স্মার্টফোন, কম্পিউটার, জিপিএস ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের স্নায়ুসংযোগের ধরনও বদলে যায়।
তা সত্ত্বেও কলম কর্তৃক লেখা, রান্না করা অথবা স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করলেও স্নায়ুসংযোগ বদলে যায়। সুতরাং টেকনোলজি আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে বদলে দিচ্ছে,
সেটি নিয়ে না চিন্তা করে আমাদের বরং ধ্যান করা কর্তব্য আজকের মডার্ন পর্দায় বন্দী অনলাইনে যুক্ত জীবনধারায় কীভাবে অভিযোজিত হচ্ছে।
প্রযুক্তি প্রচুর দ্রুত আগুয়ান হলেও আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের গড়ন শিলা যুগের মানুষ হতে প্রচুর একটা বদলায়নি। কাজেই পুষ্ট টেকনোলজি কীভাবে আমাদের জীবনধারায় সংযুক্ত করলে শারীরবৃত্তীয় সমস্যা হবে না,
সেটা আমাদের যাচাই করা দরকার। লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড, যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র: বিবিসি ফোকাস, প্রতিদিন মেইল ও স্যাকরেড টেক্সট ওয়েবসাইট
You must be logged in to post a comment.