বর্তমানে বসে অতীতের ছবি তোলা যেভাবে সম্ভব হয় জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে!

ক্লাসের এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি জানেন কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পূর্বের মহাকাশের একটি ছবি প্রকাশ করেছে, যেটি তোলা হয়েছে এই বর্তমান সময়ে বসে।

অবাক হয়ে পাশের কয়েকজন বলল, আরে বর্তমানে বসে অতীতকে ছবি তোলা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? উত্তর দিলাম, মহাকাশ গবেষক নাসা সংস্থা গত বছর একটি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেছে, যার নাম ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’।

এই টেলিস্কোপ দিয়ে বর্তমান সময়ে বসে অতীতের অবস্থা দেখা যায়। কথাটা শেষ হতে না হতেই কয়েকজন বললো, দূর এসব ভূয়া! সব বানোয়াট কথা! মানুষকে ওরা বোকা বানাচ্ছে। আমি বললাম, ভূয়া নয়! এটা একেবারেই সত্য। সকল বিজ্ঞানীরাই এতে একমত।

কথাটা শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করলো এবং ঠাট্টা বিদ্রুপের সুরে বলতে লাগলো, বিজ্ঞানীরা তো কতকিছুই বলে। বর্তমান সময়ে বসে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পূর্বের ছবি তোলা যায় এটা মাথায় কিভাবে ধরে?

এসব কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। প্রতিউত্তরে বললাম, আপনি কি এটা জানেন, আমাদের আশেপাশে আমরা যা কিছু দেখি কোনোটাই তার বর্তমান অবস্থা নয়, সবই আমরা অতীত দেখি। বাহিরে যে সূর্যটা দেখছেন, এটাও আমরা অতীত দেখছি। এমনকি আপনি যে আমার সামনে বসে আছেন,

এটাও আমি আপনার হুবহু বর্তমান অবস্থা দেখছি না। বরং সবাই আমরা একে অপরের কিছুটা অতীত দেখছি। এই ধরণের অবাস্তব কথা বলার পর তো সবার কাছে আমি এক প্রকার পাবনার বাসিন্দা হয়ে গেলাম।

তারপরের দিন সেই বড় ভাই আমাকে প্রশ্ন করলো, তুমি যে এখন ফোন টিপতেছো এবং হাসতেছো, এটাও কি তাহলে তোমার অতীত? উত্তরে বললাম, আমি যে এখন ফোন টিপতেছি এটা আমার বর্তমান, কিন্তু ফোনটা যে আমি দেখতেছি এটা হলো অতীত।

তদ্রুপ, এখন যে আমি হাসতেছি এটা আমার বর্তমান, কিন্তু হাসিটা যে আপনি দেখতেছেন এটা হলো অতীত। আমার এমন আজব কথা সে তার মাথার ভিতরেই ঢুকায়নি। যেকারণে এর ব্যাখ্যা চাওয়াটাও প্রয়োজন মনে করেনি।

এটার ব্যাখ্যা বুঝতে হলে আলোর গতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতে হবে। আমরা জানি আলোর একটি নির্দিষ্ট গতি রয়েছে। সেই অনুপাতে বলা যায়, অন্ধকারে চলার জন্য আমরা যে টর্চ লাইটের আলোটা রাস্তার উপর ধরি, তা মাটি হতে টর্চের দূরত্ব অনুযায়ী রাস্তার উপর পড়তে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়।

তবে সেটা অতি অল্প, যা আমাদের সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। ফলে মনে হয় এর কোনো গতি নেই। অথচ, শূন্যস্থানে আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। অর্থাৎ, ৩ লক্ষ কিলোমিটার স্থান পারি দিতে আলোর সময় লাগে মাত্র ১ সেকেন্ড।

আকাশপানে তাকিয়ে আলোকজ্জ্বল যেই সূর্যটা আপনি প্রতিনিয়ত দেখে থাকেন, পৃথিবী থেকে এটা এতোটাই দূরে অবস্থিত যে, এর আলো আমাদের পৃথিবীতে পৌছতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। অর্থাৎ, ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগে সূর্যের আলোটা পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলো। অতঃপর সেই আলো তার নির্দিষ্ট গতি অনুসারে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড পর এসে পৃথিবীতে পৌছেছে।

এর মানে হলো, প্রতিদিন যে আলোকময় সূর্যটা আপনি দেখতে পান, এটা তার বর্তমান অবস্থা নয়। বরং আপনি তার ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগের অবস্থাটা দেখে থাকেন। হতে পারে এই সূর্য আমাদের ঘুর্ণায়মান পৃথিবীর আড়ালে পড়ে কয়েক মিনিট আগেই অস্তমিত হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এখনো আপনি তাকে পশ্চিমাকাশে দেখতে পাচ্ছেন। কেননা, যদিও সূর্যটা অস্তমিত হয়ে গেছে, তবে তার অস্তমিত হওয়ার দৃশ্যটা মহাশূন্যে এখনো গতিশীল অবস্থায় রয়ে গেছে। যেটি কিছু সময় পর এসে আপনার চোখে ধরা দিবে।

মেঘমুক্ত রাতের ঝকঝকে আকাশে মিঠিমিঠি জ্বলতে থাকা যে তারকারাজী আপনি দেখেন, সেগুলোও কিন্তু তার বর্তমান অবস্থা নয়। এগুলো আমাদের পৃথিবী থেকে এতোটাই সুবিশাল দূরত্বে অবস্থিত যে, হতে পারে তাদের শত বছর থেকে হাজার বছর পূর্বের অতীত অবস্থাটি আপনি বর্তমানে বসে দেখতেছেন।

মোবাইল, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপের মাধ্যমে এখন আমার এই লেখাটি যে আপনি পড়তেছেন, এটাও কিন্তু হুবহু বর্তমান অবস্থা নয়। আপনার চোখ থেকে স্কিনের দূরত্ব অনুযায়ী আলোর গতি অনুসারে কিছুটা হলেও আপনি অতীত দেখতেছেন।

এভাবে আমাদের আশেপাশে যা কিছুই দেখি না কেন, বলা চলে সবই আমরা তার অতীত দেখি। কেননা, যখন আমরা কোনো জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন তার আকৃতিটা আলোর গতিতে আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌছতে কিছুটা হলেও সময় লাগে। তবে সেটা খুবই অল্প হওয়াতে আমাদের তা উপলব্ধি হয় না।

পরন্ত বিকেলে প্রকৃতির বুকে দাড়িয়ে আপনার সাধের ক্যামেরাটা দিয়ে যে আপনি কারো ছবি তুলতেছেন, সেটাও কিন্তু আপনি তার অতীত তুলতেছেন। ক্যামেরা থেকে সে যত বেশি দূরে থাকবে, ছবিটাও ঠিক ততোটাই অতীতের উঠবে। কেননা, ক্যামেরার সামনে দাড়ানো লোকটা থেকে ক্যামেরার সেন্সর পর্যন্ত আলো পৌছতে অল্প কিছুটা হলেও সময়ের প্রয়োজন।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়। এটা দিয়ে যত বেশি দূরের দৃশ্য দেখা যাবে, ঠিক ততোটাই অতীত দেখা হবে। তাইতো বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে শূন্যস্থানে অবস্থিত মহাকাশের গ্যালাক্সি সমুহের অবস্থানের দৃশ্য যখন এই টেলিস্কোপের সেন্সরে এসে পড়ে, তখন তার মাধ্যমে বিলিয়ন বছর পূর্বের দৃশ্যটি দেখতে পাওয়া যায়। যেটি আমাদের খালি চোখে ধরা পড়ে না।

জেমস ওয়েবে ধারণকৃত মহাবিশ্বের প্রথম যে ছবিটি নাসা প্রকাশ করেছে, সেই ছবির অবস্থাটি পৃথিবী থেকে এতটাই দূরে অবস্থিত যে, সেখান থেকে আমাদের কাছে আলো পৌছতে সময় লাগে ১৩৫০ কোটি বছর। যার মানে হলো, সেই ছবির দৃশ্যটি আজ থেকে প্রায় ১৩৫০ কোটি বছর আগের অবস্থার দৃশ্য।

যেটি বর্তমান সময়ে ক্যাপচার করা সম্ভব হয়েছে একমাত্র আলোর গতিবেগের কারণে। আলোর যদি গতি না থাকতো তাহলে এটা কোনভাবেই সম্ভব হতো না। আলোই হলো জেমস ওয়েবের রহস্য!

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ

নতুন কিছু জানতে, শিখতে ও নতুন বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে ভালোবাসি।