আগামীদিনের সাহায্যকারী মানুষ - রোবোট

রোবট শব্দটি আজকাল ছোট ছেলেমেয়েদেরও জানা। কেননা, যুদ্ধক্ষেত্র হতে শুরু করে খেলনার জগতে এর বিচরণ নজরে পড়ার মত । এটি বিজ্ঞানের একটি নতুন ও চমকপ্রদ আবিষ্কার।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

সঠিক প্রোগ্রাম করা হলে মানুষের মত স্নায়ুবিক নানা ক্রিয়াকর্মে একে প্রবৃত্ত করা সম্ভব এবং যথাযথ কাজ পেতে কোন অসুবিধে নেই, যেটা অনেক সময় মানুষও পারে না ।

মানুষ কোন কর্মসূচি ভুলে যেতে পারে; কিন্তু রোবোট কিছুতেই ভুল করে না। তবে মানুষ যেমন নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে রোবোটের জন্য এটা একটু কষ্টকর। প্রোগ্রাম করা একটি রোবোট নির্ধারিত স্থান হতে একটি জিনিস তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে দিতে পারে।

মসৃণ ও সমতল একটি জায়গায় রোবোট নিশ্চিন্তে চলতে পারে তবে সঠিকভাবে নির্দেশিত না হলে হঠাৎ করে থেমে যায় বা হেলেদুলে পড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষ একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম; কেননা সে নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য নতুন নতুন চিন্তা করতে পারে এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

শিল্প ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোট তৈরির কাজে প্রচুর গবেষণা হয়েছে যাতে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুর মত রোবোটের কর্মক্ষম স্নায়ু সৃষ্টি করা যায় বৈজ্ঞানিকরা গাণিতিক মডেলের সাহায্যে রোবোট সুচারুরূপে স্নায়ুবিক কাজকর্ম সম্পন্ন করতে পারে তার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছেন।

আমেরিকার ওয়েলেস্‌লী কলেজের মাইকেল কুপার স্টেইন রোবোটের মস্তিষ্কে রক্ষিত ক্যামেরার সাথে হাতে নাড়াচড়ার একটা বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি গবেষণার মাধ্যমে রোবোটে পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য একটি কম্পিউটার কলাকৌশল নির্ণয় করেছেন ।

এ ক্ষেত্রে রোবোট নানারূপ আভ্যন্তরীণ সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজে নিজেই নানারূপ পরিবর্তন সামলে নেয়ার চেষ্টা করে। বাইরের যেকোন পরিবর্তন বুঝে চলার মোটামুটি কলাকৌশল এর মধ্যে নিহিত আছে।

কুপার স্টেইনের তৈরি এক হাত ও দুই চোখবিশিষ্ট রোবোটের মডেল অনেকটা কার্টুনিস্টদের আঁকা ছবির মতো মনে হয়। এতে এক জোড়া ক্যামেরা এবং দুটি জোড়াবিশিষ্ট একটি হাত একটি ব্লকে আলাদাভাবে থাকে।

তিনি রোবোটের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জীববিদ্যা বিষয়ক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। চোখ দিয়ে কোনকিছু দেখেই আমরা ক্ষান্ত হই না; কেননা দেখবার সাথে সাথে মস্তিষ্কের স্নায়ুও কাজ করে এবং চোখের দৃষ্টি স্থান পরিবর্তনের সাথে আমাদের চিন্তারও পরিবর্তন ঘটে ।

কোন দৃশ্যমান জিনিস অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে আমাদের চিন্তারও পরিবর্তন ঘটে ।

কোন দৃশ্যমান জিনিস অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে কাছে এলে বড় দেখায় — এরূপ একটি ধারণা তিনি রোবোটের মধ্যে স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং রোবোটের হাতের পেশীর নড়াচড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কে রক্ষিত ক্যামেরার লেন্সেরও নড়াচড়া হয় এবং বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন সহসাই উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।

অপরপক্ষে উক্ত জিনিসটির অবস্থানের পরিবর্তন না ঘটিয়ে যদি ক্যামেরার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে সেক্ষেত্রেও মস্তিষ্কের স্নায়ু ও পেশীর পরিবর্তন ঘটিয়ে বাস্তব ঘটনা বিশ্লেষণের ক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়, কেননা মস্তিষ্কের স্নায়ুর সাথে দ্রব্যের অবস্থানের পরিবর্তনের সহসম্বন্ধ আছে যাতে করে চোখের গতিবিধি পরিবর্তন সময়ানুযায়ী সম্ভব হয়।

কুপার স্টেইন বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত অবস্থায় কোন জিনিসের অবস্থানের কিরূপ পরিবর্তন হয় তা বুঝে নেয়ার জন্য চোখ ও হাতের পেশীর পরিবর্তনের এক ধরনের ভাষা সৃষ্টি করেন যার সাহায্যে ঐ জিনিসটির অবিকল বর্ণনা রোবোটের মেমোরীতে জমা হয়ে যায়।

একথা সবার জানা আছে যে, কোন বস্তু চোখে দেখার পর অথবা কোন শব্দ কানে শোনার পর অথবা শরীরের কোন অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হলে মানুষের ইন্দ্রিয় হতে অনুভূতি বহনক্ষম কতগুলো স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে খবর প্রেরণ হয় এবং মেধাশক্তি সে-মুহূর্তে কি করতে হবে তার নির্দেশ দেয়।

এমনকি মুহূর্তে চোখের দৃষ্টি এদিক-সেদিক হলেও সে খবর মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং করণীয় বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়।

কুপার স্টেইনের রোবোটের মডেল মানুষ যেভাবে দেখেশুনে কাজ করে তারই অনুরূপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মাত্র। এতে একটি ব্লকে ঘুরতে-ফিরতে পারে এমন দুটি ক্যামেরা থাকে এবং অন্য ব্লকে দু'জোড়াবিশিষ্ট একটি অংগ থাকে যার সংযোগস্থল হচ্ছে কাঁধ ও কনুই।

কাঁধের সংযোগস্থলে দু'জোড়া কাজে প্রবৃত্তকারী পেশী আছে যা এ অংগের উপরের অংশকে দু'দিকে ঘুরতে সাহায্য করে এবং কনুইর সংযোগস্থলে একজোড়া পেশী বিদ্যমান যা একদিকে ঘুরতে পারে।

স্টিরিও ক্যামেরায় চোখ সামনের ও পিছনে এবং উপরে ও নিচে ঘুরতে পারে । ক্যামেরার নড়াচড়ার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এ ধরনের রোবোটকে কুপার স্টেইন ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিফেন গ্রসবার্জ এর পূর্বেকার তৈরি এক চক্ষু ও এক সংযোগস্থলবিশিষ্ট রোবোটের বংশধর বলা চলে; কেননা, কুপার স্ট্রেইনের রোবোট আসলে এরই আধুনিক সংস্করণ মাত্র ।

এরূপ রোবোট মেধাশক্তির প্রচুর ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে মেধাশক্তিই পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সংগতি রেখে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দেয়।

প্রথমদিকের রোবোট তার চারদিকের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারতো না; কেননা এতে পরিস্থিতি পূর্বে জ্ঞাত হওয়ার কোন পদ্ধতি নাই । হাতের বিবিধ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেই রোবোটের কর্মকাণ্ড শুরু হয় এবং লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে মানচিত্র তৈরি হয়।

হাতের বিশেষ কোন ভঙ্গি শেষ হলেই রোবোটের চোখের কাজ শুরু হয় এবং লক্ষ্যবস্তুর প্রতি স্থির হয়। এ দুই অবস্থায় সঠিক সম্বন্ধ নির্ধারণ সম্ভব হলে রোবোটকে দিয়ে যেকোন কাজ করা সম্ভব হয়।

এরূপ অবস্থায় রোবোটের চোখ হাতের অংগভংগির উপর নির্ভরশীল হবে এবং হাতের অংগভংগির উপর নির্ভর করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে রোবোটের চোখ নিবদ্ধ হবে ।

অপরপক্ষে ক্যামেরা লক্ষ্যবস্তুর উপর স্থির দৃষ্টি ফেললেই রোবোট হেলেদুলে এগিয়ে তার হাত সে অংশে গিয়ে পৌঁছায়। স্থির লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য ক্যামেরা ও বাহুর নড়াচড়ার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। প্রকৃতপক্ষে রোবোট প্রথম অবস্থায় নানারূপ ‘ভুল করে আবার শুদ্ধ করে' নেয়ার চেষ্টা করে অগ্রযাত্রা শুরু করে।

কুপার স্টেইন বলেন তাঁর রোবোটের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যে, সে কম্পিউটার কলাকৌশলের মাধ্যমে নিজে পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে। ইচ্ছে করলে বাহুর পেশী শক্তির কম বৃদ্ধি সম্ভব, সংযোগ দৈর্ঘ্য বাড়ানো - কমানো সম্ভব।

ক্যামেরার লেন্সের দূরত্ব ও পাওয়ার কম-বেশি করাও সম্ভব। অর্থাৎ যেকোন অবস্থায় থাকুক না কেন, রোবোট তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সংগতিপূর্ণ থাকে। কুপার স্টেইনের রোবোটের স্নায়ুর মডেল এমন করে তৈরি যাতে পারিপার্শ্বিক অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সক্ষম এবং প্রয়োজনে পরিবর্তন অনুধাবন করেও মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় ।

তার মডেল যান্ত্রিক কোন দোষ-ত্রুটির জন্য অচল হয়ে যায় না বরং সহ্য করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করে। কুপার স্টেইন মনে করেন যে, তাঁর রোবোটে প্রস্তাবিত স্নায়ুবিক কলাকৌশল ‘রোবোটের পেটেন্ট' নির্ধারিত হয়।

আধুনিক রোবোট হিসেবে এটি বহুল পরিচিত। ক্রমে রোবোটের আরো উন্নতি হয়েছে নানা বিজ্ঞানীর হাতে এবং ব্যবহারের দিক দিয়ে এগুলো আরো সর্বজনীন হয়েছে।

সম্প্রতি এমন রোবোটের কথাও জানা যায় যে, জটিল শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি দারুণ ভূমিকা রাখছে। এগুলো হাঁটতে পারে, অপরিচিত বস্তু, পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে স্নায়ুবিক কলাকৌশল আরো উন্নত করে এমন রোবোট তৈরি করা সম্ভব হবে যা দেখতে পারবে, স্পর্শ করতে পারবে এবং শুনতেও পারবে।

অতএব এটা সহজেই অনুমেয় যে, এমনদিন আসছে যখন কল - কারখানায়, যুদ্ধক্ষেত্রে এমনকি মহাকাশযানেও রোবোট হামেশা কাজ করবে।

আমাদের দেশে এখনও রোবোটের তেমন ব্যবহার শুরু হয়নি। তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে খেলনার স্তর হতে বহুল ব্যবহারের দিন আর বেশি দূরে নয়।

শ্রমিক জনসংখ্যা বহুল আমাদের দেশে রোবোটের প্রচলন বা ব্যবহার সম্পর্কে অনেকের অনীহা থাকতে পারে; তবু দক্ষ ও নিয়ম-শৃংখলা মান্যকারী শ্রমিকের সংখ্যা যে হারে দেশে কমে যাচ্ছে তাতে রোবোটই এক সময় আমাদের সম্বল হবে বলে আমার বিশ্বাস ।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ