ফ্রিল্যান্সিং বা স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করা এমন একটি ব্যাপার যা শুধুমাত্র আপনার পছন্দসই কাজ করারই সুযোগ দেয়না, সেই সাথে দেয় যে কোনো যায়গা থেকে যে কোনো সময়ে কাজ করার সুযোগ ।
এই আকর্ষণীয় সুবিধা আজ ফ্রিল্যান্সিং শিল্পের দিকে অসংখ্য তরুণ-তরুণীদের নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সুবিধার পাশাপাশি ফ্রীল্যান্সিঙে কিছু অসুবিধাও আছে । আর তা হচ্ছে প্রতিযোগিতা ।
সম্প্রতি আপ ওয়ার্কের একটি সমীক্ষা অনুসারে, আমেরিকায় কর্মজীবী মানুষের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ফ্রিল্যান্সিং করছে। বাংলাদেশেও বর্তমানে পাঁচ লক্ষেরও অধিক একটিভ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে । তাই প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা খুব সহজেই আঁচ করা যায় ।
তাই, কিভাবে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করবেন? যদি একজন ফ্রিল্যান্সার হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ নিতে চান – তবে কাজটি কিভাবে শুরু করবেন তা নিশ্চিত হোন । আপনার স্কিল এবং এক্সপেরিয়েন্স অনুযায়ী সঠিক কাজটি বেছে নিন । এখনে 202২ সালে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হওয়ার সাতটি স্টেপ নিয়ে আলোচনা করা হোল ।
১) যে কাজে আপনার দক্ষতা রয়েছে তাকে সংজ্ঞায়িত করুনঃ
আপনার দক্ষতাকে একটি পরিসেবা বা সার্ভিসে পরিণত করা, একজন ফ্রিল্যান্সার হওয়ার প্রথম ধাপ। এটি করার জন্য আপনাকে বুঝতে হবে, কিভাবে আপনার দক্ষতা একজন ক্লায়েন্টকে সাহায্য করতে পারে। নিজেকে আপনার আদর্শ ক্লায়েন্টের যায়গায় কল্পনা করার চেষ্টা করুন।
তাদের কোন সমস্যা রয়েছে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কিভাবে আপনার দক্ষতাকে ব্যবহার করবে?
তা বোঝার চেষ্টা করুন। একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হতে, আপনাকে ক্লায়েন্টের পরিস্থিতি বুঝতে হবে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার পরিসেবা বা সার্ভিস ব্যবহার করতে হবে। এই প্রশ্নগুলির উত্তরের ওপরই নির্ভর করবে হবে আপনি কিভাবে আপনার দক্ষতাকে একটি সার্ভিস হিসাবে প্যাকেজ করবেন তার মুল ভিত্তি।
এখন এই সার্ভিসটির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ - যা আপনাকে কোম্পানির কাছে আপনার ফ্রিল্যান্স সার্ভিস বিক্রি করতে সাহায্য করবে ( যেমনঃ- আপনি কি করতে পারেন, আপনি কিভাবে এটি করেন এবং কই ধরনের ব্যবসা বা ক্লায়েন্টের জন্য ) তৈরি করার চেষ্টা করুন। এখনি দাম সম্পর্কে চিন্তা করবেন না; সে কাজটি আমরা পরবর্তী একটি ধাপে করবো।
২) কারা আপনার সেবা নিতে পারে (টার্গেট অডিএন্স) খুজে বের করুনঃ
ধরুন আপনার কাছে অফার করার মত একটি ফ্রিল্যান্স সার্ভিস আছে । আপনাকে এটির টার্গেট অডিএন্স খুজে বের করতে হবে। আপনার সার্ভিসের জন্য উপযুক্ত, এমন ক্লায়েন্টদের ধরন শনাক্ত করতে শুরু করুন। এই ক্লায়েন্টদের কি একটি নির্দিষ্ট সমস্যা এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে?
তারা কি একটি নির্দিষ্ট শিল্পে জড়িত? একজন নতুন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে, আপনি যা করেন, তাতে কেবল দক্ষ হলেই যে ক্লায়েন্টরা আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুজে বের করবে তা মোটেও ভাবতে যাবেননা ।
আপনার সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের সামনে নিজেকে যথাযথ ভাবে পেশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা আপনার সার্ভিসগুলো সম্পর্কে জানতে পারে। সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট খুঁজে পেতে আপনাকে সক্রিয় হতে হবে। বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সারদের জন্য, ক্লায়েন্ট অর্জনের তিনটি উপায় রয়েছে:
- ফ্রিল্যান্স কাজের পোস্টিং প্ল্যাটফর্ম
- বিদ্যমান জনসংযোগ এবং নেটওয়ার্ক থেকে সুবিধা গ্রহন
- বিপণন, বিজ্ঞাপন, এবং প্রচার
এই উপায়গুলোর মধ্যে কোনটি আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত তা বোঝা, আপনার সার্ভিসের সাথে সম্পর্কযুক্ত ক্লায়েন্টদের খুজে বের করার মুল চাবিকাঠি।
৩) আপনার সার্ভিসের একটি মূল্য কাঠামো তৈরি করুনঃ
আপনার সার্ভিস এবং ক্লায়েন্টদেরকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার পর, এবার আপনার সার্ভিসের জন্য মূল্য সেট করার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে আপনার লক্ষ্য হবে, সাম্ভাব্য কাজটি না হারিয়ে আপনার সার্ভিসের জন্য প্রদেয় অর্থের পরিমাণ যেন সর্বাধিক হয় তা নিশ্চিত করা।
সুতরাং, বাজারে আপনার প্রতিযোগীদের দেখে শুরু করুন। তারা অনুরূপ ফ্রিল্যান্সিং সেবার জন্য কি চার্জ করছে?
আসলে, আপনার ফ্রিল্যান্সিং সেবার মূল্য নির্ধারণের জন্য কোন বাধাধরা সূত্র নেই। এখানে অনেক ধরনের ক্লায়েন্টদের দেখা আপনি পাবেন, এবং তারা আপনার সার্ভিসের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে ইচ্ছুক, তা আপনার রেট কে প্রভাবিত করতে পারে । কিন্তু হতাশ হবেন না ।
সার্ভিস রেটের এই অনিশ্চয়তা, আপনাকে যেন থামিয়ে না দেয় । আসলে, সার্ভিস রেট কখনই একটি স্থায়ী ব্যাপার নয় । আপনি ভবিষ্যতে এটি পরিবর্তন করতে পারবেন । তাই শুরুতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এমন একটি মূল্য দিয়ে শুরু করুন এবং এটি নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করার চেষ্টা করুন।
৪) অতীতের চাকরির বিবরণ সহ আপনার পোর্টফোলিও তৈরি করুনঃ
পোর্টফোলিও তৈরি করা একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হওয়ার জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য পদক্ষেপ। একজন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে, আপনার পোর্টফোলিও, আপনার কৃতিত্ব এবং অতীতের প্রজেক্টগুলো প্রদর্শনের মাধ্যমে আপনার কাজের মান স্থাপন করে। আপনি কি করতে সক্ষম এবং আপনার দক্ষতার মূল্য ক্লায়েন্টদেরকে শুধু বলবেনই না, বরঞ্চ এটি দেখানোর একটি অপূর্ব সুযোগ।
পোর্টফোলিওতে আপনার সার্ভিস অফারের সাথে সম্পর্কযুক্ত সেরা কাজগুলকে হাইলাইট করুন । পোর্টফোলিওর প্রতিটি অংশে আপনার অবদানের একটি পরিষ্কার চিত্র থাকা উচিত এবং সংশ্লিষ্ট প্রজেক্টটি ক্লায়েন্টকে কিভাবে উপকৃত করেছে তার উল্লেখ থাকা উচিত।
একটি শক্তিশালী পোর্টফোলিওতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমন কিছু বিষয় হলঃ কেস স্টাডি, প্রশংসাপত্র, ডেটা-চালিত ফলাফল, ছবি, চার্ট, কাজের নমুনা এবং মক-আপ।
৫) একটি সমাদর যোগ্য প্রপোজাল লিখুনঃ
ফ্রিল্যান্সার হিসাবে একটি সফল সূচনা নিশ্চিত করতে, আপনার প্রথম প্রজেক্টটি যেন আপনার কাজের অভিজ্ঞতা এবং ক্ষমতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলে সেদিকে খেয়াল রাখুন । আপনি যখন এমন একটি প্রজেক্ট বা কাজ খুঁজে পাবেন, যে কাজটি চমৎকার ভাবে সম্পন্ন করার জন্য আপনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস অনুভব করবেন, তখন বুঝতে হবে যে, এটি একটি প্রজেক্ট প্রপোজাল জমা দেয়ার মোক্ষম সময়।
একটি প্রজেক্ট নিশ্চিত হবে কি – না, তা নির্ভর করে একটি সঠিক প্রপোজালের ওপর । তাই আপনার জন্য কাজ করে এমন একটি প্রপোজাল তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রজেক্ট প্রপোজাল তৈরির অনুশীলনের জন্য, কীভাবে সেরা প্রপোজাল তৈরি করতে হয়, সে সম্পর্কে ফ্রিল্যান্স কপিরাইটার আন্দ্রিইয়া-লুসিয়া মিহালাচের নিবন্ধটি দেখুন। সংক্ষেপে, আপনার প্রপোজালটি যেন আপনার সার্ভিসের জন্য একটি শক্তিশালী সেলিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। এটিতে, কোম্পানির চাহিদা, আপনি কিভাবে সাহায্য করতে পারেন এবং আপনার পরশংসাপত্র এবং যোগ্যতা প্রদান করতে হবে। অবশেষে, পেশাদার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ থাকাটাই মূল বিষয় । তাই আর দশটা-পাঁচটা প্রপোজাল থেকে আপনার প্রপোজালটিকে আলাদা করতে, পেশাদার ভাষা ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
একটি টেমপ্লেট, আপনার প্রপোজালটিকে যথাযথ ভাবে সাজাতে সাহায্য করতে পারে, তবে সবচেয়ে সফল ফ্রিল্যান্সাররা এটি নির্দিষ্ট ক্লায়েন্ট এবং প্রজেক্টের জন্য তৈরি করে। সেই অতিরিক্ত আপ-ফ্রন্ট সময় এবং প্রচেষ্টা নেওয়া আপনার আন্তরিকতা, উদ্যম এবং পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করবে।
৬) আপনার ক্লায়েন্টের সাথে একটি সম্পর্ক তৈরি করুনঃ
একজন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে, ক্লায়েন্টরাই হচ্ছে আপনার ব্যবসা। তাই, ক্লায়েন্টদের সাথে একটি ইতিবাচক কাজের সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্তন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সফল ফ্রিল্যান্সাররা কাজকে চুক্তি হিসাবে দেখেননা, বরঞ্চ তারা এটিকে ক্লায়েন্টদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার একটি সোপান হিসেবে ভাবেন ।
একটি দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ফলে ব্যবসার পুনরাবৃত্তি এবং নতুন ক্লায়েন্ট রেফারেল হতে পারে। আপনার ক্লায়েন্টদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার সময় এখানে কিছু মূল বিষয় মাথায় রাখতে হবে:
চমৎকার কাজ করুন: ক্লায়েন্ট সন্তুষ্টির জন্য উচ্চ-মানের কাজ প্রয়োজন। ক্লায়েন্টের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পেতে আপনাকে মূল্য প্রদান করতে হবে এবং ক্লায়েন্টের সমস্যা সমাধান করতে হবে।
ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ করুন: কার্যকর ক্লায়েন্ট যোগাযোগ একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করে এবং ক্লায়েন্টদের ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলির জন্য আপনার সাথে কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
ধারাবাহিকতার মাধ্যমে আস্থা অর্জন করুন: ধারাবাহিকভাবে, সময়মতো কাজ শেষ করে এবং সঠিক ডেলিভারি প্রদান করে আপনি ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জন করতে পারেন এবং দেখাতে পারেন যে আপনার ক্লায়েন্ট ভবিষ্যতে আপনার উপর নির্ভর করতে পারে।
আরও মূল্য সংজোজনের সুযোগ খুঁজুন: উদ্যোগ গ্রহণ করে, নতুন সমাধানগুলি চিহ্নিত করে এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে, ক্লায়েন্টের কাছে আপনার যথাযোগ্য মূল্য তুলে ধরতে এবং একসাথে কাজ করার নতুন উপায় উন্মুক্ত করতে পারেন।
৭) আপনার দক্ষতার বিকাশ চালিয়ে যান:
ফ্রিল্যান্সাররা তাদের ক্লায়েন্টদের যে সেবা এবং দক্ষতা অফার করে তার জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। ফলস্বরূপ, ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ক্রমাগতভাবে তাদের দক্ষতা উন্নত করা, পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া এবং তাদের জ্ঞান প্রসারিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার ক্লায়েন্টদের সর্বোচ্চ স্তরের সেবা প্রদানের জন্য বর্তমান প্রবণতার সাথে তাল মিলিয়ে চলাও অপরিহার্য। অনলাইন লার্নিং ইন্সটিটিউটস যেমনঃ- Udemy, LinkedIn Learning, Coursera, এমনকি YouTube ও হতে পারে আপনার দক্ষতা সবসময় আপ-টু-ডেট আছে কি-না, তা নিশ্চিত করার দুর্দান্ত স্টারটিং পয়েন্ট।
আপনার ফ্রিল্যান্স ক্যারিয়ার শুরু করুনঃ
আপনি কি ২০২২ সালে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে প্রস্তুত? এটা আপনার উপর নির্ভর করছে । একজন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আপনার, এবং আপনিই পারেন আপনার ব্যবসার জন্য যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে। ক্লায়েন্টরা সক্রিয়ভাবে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের নতুন উপায় খুঁজছেন, এবং আপনার ফ্রিল্যান্সিং সেবাগূলো তার সমাধান হতে পারে।
এই নিবন্ধের সাতটি ধাপ অনুসরণ করে, আপনি ২০২২ সালে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করতে পারেন। পরিকল্পনা পর্যায়ে আটকে যাবেন না। আপনার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য আপনাকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। আপনার সার্বিক সাফল্য কামনা করে এখানেই শেষ করছি ।
You must be logged in to post a comment.