মহামারীতে মানুষের প্রাণহানির কারণে শ্রমের অভাবে ইউরোপে ভূমিদাস ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে, ত্বরাণ্বিত হয়েছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন। কখনও কখনও যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মহামারী।
মহামারীর ইতিহাস মানব সভ্যতার মতোই প্রাচীন। বিভিন্ন সময় সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনও আবার বিশ্বব্যাপী। প্লেগ, কলেরা, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটিবসন্ত বিভিন্ন রোগ নানা সময়ে মহামারীর আকার নিয়েছে। সে রকম কিছু মহামারীর তথ্য তুলে ধরা হল-
লাইভসায়েন্স ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দের দিকে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঁচ বছর ধরে চলা এই মহামারীতে এক লাখের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। রোগের মূল লক্ষণ ছিল জ্বর, প্রচণ্ড তেষ্টা, গলা ও জিব রক্তাক্ত হওয়া, ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া ও ক্ষত সৃষ্টি।
গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডিস (৪৬০-৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব) লিখেছেন, “সুস্থ-সবল মানুষের হঠাৎ করে শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। চোখ লাল হয়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছিল। জিভ ও গলা লালচে হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল।”
এই মহামারী আসলে কী ছিল, তা পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে রয়েছে। এই আলোচনায় টাইফয়েড, ইবোলাসহ নানা রোগের নাম এসেছে। অনেক পণ্ডিতের মতে, স্পার্টার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষায় ‘লং ওয়াল’ খ্যাত বিভিন্ন দুর্গের পেছনে গাদাগাদি করে আশ্রয় নেন এথেন্সবাসী।
আর এটাই মহামারীকে ত্বরান্বিত করেছিল। বলা হয়ে থাকে, এই মহামারীর কারণেই স্পার্টানদের কাছে যুদ্ধে হারতে হয়েছিল এথেনিয়ানদের।
# ৫৪১ খ্রিস্টাব্দ: জাস্টিনিয়ান প্লেগ
সিএনএনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলেও এই মহামারী চলে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ নেয় এই মহামারী। ব্যাকটেরিয়াজনিত এই রোগ ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যানসিয়েন্ট হিস্টোরি এনসাইক্লোপিডিয়ায় জন হর্গানের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মিশরে প্রথম মহামারী আকারে দেখা দেয় এই প্লেগ। সেখান থেকে পুরো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারী। পরে পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই প্লেগ তাণ্ডব চালায়। রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামে এই রোগের নামকরণ করা হয়।
সম্রাট নিজেও এ রোগে আক্রান্ত হন, তবে পরে সেরে ওঠেন। বর্তমান ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত ‘হায়া সোফিয়া’ গির্জা জাস্টিনিয়ানের আমলেই তৈরি। এই সম্রাটের আমলেই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শীর্ষে উঠেছিল। তবে মহামারীর কারণে অধিকৃত এলাকা হারাতে হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে।
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর সেই সময়কার জনসংখ্যার ১০ ভাগ এই মহামারীতে মারা যায়। চীন ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে এই রোগের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। সমুদ্র পথে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
# ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দ: দ্য ব্ল্যাক ডেথ
ইউরোপের অন্যতম প্রাণসংহারী মহামারী ‘ব্ল্যাক ডেথ’। লাইভসায়েন্সের তথ্য মতে, এশিয়া থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায় এই প্লেগ। অনেকের মতে, এই মহামারীতে ইউরোপের অর্ধেকের মতো মানুষ প্রাণ হারায়।
মৃতদের গণকবরে সমাহিত করা হয়। এটি এমনই এক মহামারী ছিল, এর কারণে সমগ্র ইউরোপের অর্থনৈতিকসহ সার্বিক জীবন কাঠামো বদলে যায়। প্রভাবিত হয় শিল্প-সাহিত্যও। বহু মানুষের প্রাণহানির কারণে শ্রমিক পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে।
অবসান ঘটে ইউরোপের ভূমিদাস ব্যবস্থার। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের ভালো মজুরি হয়, তাদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটে। এই ধাক্কায় সস্তা শ্রমের অভাব প্রযুক্তির উদ্ভাবনকেও এগিয়ে দেয়।
# কলেরা মহামারী
বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকের সাহিত্যকর্মে কলেরার কথা উঠে এসেছে। এই রোগের কারণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দুই গ্রিক চিকিৎসকের লেখায় বহু আগেই গঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় কলেরার মতো রোগের কথা উল্লেখ করা হলেও এই রোগটি প্রথম বৈশ্বিকভাবে মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে ১৮১৭ সালে। ওই বছর বাংলাদেশের যশোরে এই রোগের প্রাদুর্ভাবে মানুষের প্রাণহানি ঘটতে থাকে।
কিছু দিনের মধ্যে তা বর্তমান ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২০ সাল নাগাদ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সে মহামারী আকারে এই রোগ দেখা দেয়। ওই সময় ইন্দোনেশিয়ার শুধু জাভা দ্বীপেই কলেরায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
পরের বছর ইরাকের বসরায় তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রাণ হারান ১৮ হাজার মানুষ। এরপর আরব থেকে বাণিজ্য পথ ধরে পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা মহামারী।
ব্রিটানিকা ডটকম বলছে, ১৮১৭ সালে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কলেরা চলে গেলেও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকায় এই রোগ টিকে ছিল।
দ্বিতীয় দফায় কলেরা বৈশ্বিক মহামারী আকারে দেখা দেয় ১৮২৯ সালে, ইউরোপ ও আমেরিকায় বিপুল প্রাণহানি ঘটায় এই সময়। ১৮৩০ সালে মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা, এরপর ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডে দেখা দেয় এই রোগ। বাণিজ্যপথ ধরে দ্রুতই তা জার্মানির হামবুর্গ এবং প্রথমবারের মতো ১৮৩১ সালে ইংল্যান্ডে দেখা দেয়। পরের বছর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা। ১৮৩৩ সালে মহামারী শুরু হয় মেক্সিকো ও কিউবায়।
তৃতীয় দফা মহামারী হয় ১৮৫২ সালে এবং এবারই সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে বলে ধারণা করা হয়। ভারত থেকে শুরু হয়ে ইরান হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয় আফ্রিকা। এই দফায় ১৮৫৪ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে, শুধু যুক্তরাজ্যেই মারা যায় ২৩ হাজার মানুষ।
চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় কলেরা মহামারী শুরু হয় ১৮৬৩ ও ১৮৮১ সালে। আগের তুলনায় এই দুই দফায় রোগটির তীব্রতা কম হয় বলে ধরা করা হয়ে থাকে। তারপরেও ইউরোপের কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ১৮৮৪ সালে নেপলসের ৫ হাজারের বেশি বাসিন্দার মৃত্যু হয়, পরের বছর স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া ও মুরসিয়া প্রদেশে মারা যায় ৬০ হাজার মানুষ।
১৮৯৩-৯৪ সালে রাশিয়ায় দুই লাখের মতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় কলেরা। এই দফায় আবারও আক্রান্ত হয় জার্মানির হামবুর্গ, ১৮৯২ সালে সেখানকার ১.৫ শতাংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় কলেরা মহামারী। উনিশ শতকের চুতর্থ প্রান্তিকে চীন ও জাপানে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা মহামারী, ১৮৭৭ থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে সেখানে ৯০ হাজার মানুষের মৃত্যু রেকর্ড হয়। ১৮৯০ দশকের শুরুর দিকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে।
এরপরও দুই দফায় কলেরা ছড়িয়ে এ পর্যন্ত সাতবার তা বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নিয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেও লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে কলেরা মহামারী। এর চিকিৎসা স্যালাইন ও খাবার স্যালাইন পেতে দেড় শতকের বেশি সময় লেগে যায়।
২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, এখনও প্রতি বছর এই রোগে প্রায় ৯৫ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে এই রোগ নির্মূলে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
# স্প্যানিশ ফ্লু (১৯১৮-১৯২০)
মৃতের সংখ্যার হিসাবে আধুনিক যুগের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারীর একটি হচ্ছে ১৯১৮ সালে ধরা পড়া স্প্যানিশ ফ্লু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেখানে পাঁচ বছরে ১ কোটি ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, সেখানে স্প্যানিশ ফ্লুতে মাত্র দুই বছরে মারা যায় ২ কোটি মানুষ।
লাইভসায়েন্স ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সাগর থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত ৫০ কোটির মতো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। তাদের এক পঞ্চমাংশের মৃত্যু ঘটে, অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী বিলুপ্তির পথে চলে যায়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সৈনিকদের গাদাগাদি করে থাকা এবং যুদ্ধকালীন অপুষ্টি এই রোগের বিস্তার ও এতে প্রাণহানি বাড়িয়ে দেয়।
স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল এইচ১এন১ ভাইরাস। স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারীতে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম সেই সংবাদ প্রচারে বাধা-নিষেধ আরোপ করলেও স্পেনের মিডিয়া ফলাও করে এই ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের কথা প্রচার করেছিল। তাই এই মহামারীর নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু, যদিও এর প্রভাব ছিল পুরো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাজুড়েই।
স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম ধাক্কাটি আসে মে-জুন মাসে। লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েলকাম ট্রাস্টের গবেষক মার্ক হনিগসবাউম ১৯১৮ সালে এই মহামারী নিয়ে ‘লিভিং উইথ এঞ্জা’ নামে একটি বই লিখেছেন। মার্ক হনিগসবাউম বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জার খবর প্রথম এসেছিল আমেরিকায় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প থেকে। ওই ক্যাম্পটি ছিল কেন্টাকিতে।
# এশিয়ান ফ্লু (১৯৫৭-১৯৫৮)
বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার ধাক্কার আরেক নাম এশিয়ান ফ্লু। এইচ২এন২ ভাইরাস ঘটিত এই ইনফ্লুয়েঞ্জা চীনে দেখা দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যুক্তরাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-সিডিসির থ্য মতে, ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুরে এবং এপ্রিলে হংকংয়ে এশিয়ান ফ্লু শনাক্ত হয়।
ওই বছর গ্রীষ্মেই যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় শহরগুলোতে এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এশিয়ান ফ্লুতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। পরে ভ্যাকসিন দিয়ে ওই মহামারী প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল।
# গুটি বসন্ত
বেশ পুরানো ইতিহাস এই রোগের। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে গুটি বসন্ত ছিল এই পৃথিবীতে। সিডিসির তথ্য মতে, তিন হাজার বছর আগের মিশরীয় মমিতে গুটি বসন্তের প্রমাণ পাওয়া যায়। গুটি বসন্তের সঙ্গে মিলে যায় এমন রোগের সবচেয়ে পুরনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় চীনে, চতুর্থ শতকের।
এছাড়া ভারতে সপ্তম শতকে এবং এশিয়া মাইনরে (বর্তমান তুরস্ক) দশম শতকে এই রোগের লিখিত বিবরণ পাওয়া গেছে। ষষ্ঠ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক নাগাদ বিশ্বজুড়ে এই রোগের দাপট ছিল।
সিডিসি বলছে, গুটি বসন্ত ছিল ধ্বংসাত্মক এক ব্যাধি। গড়ে আক্রান্তদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু ঘটে। যারা বেঁচে যেতেন তাদের শরীরের ক্ষতচিহ্ন তার আক্রান্ত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিত।
শতকের পর শতক বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাণহানি ঘটিয়ে চলা এই রোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনের সহকারী ডিন এবং প্রফেসর অব মেডিসিন হিসাবে কর্মরত সেজান মাহমুদ লিখেছেন, “খ্রিষ্টপূর্ব ১০ হাজার বছর থেকে মানুষের মধ্যে অস্তিত্ব ধরলে বলা যায়, এই রোগ ১২ হাজার বছর ধরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখন এটি পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নিয়েছে টিকার কারণে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৯৭৭ সালে গুটি বসন্তের শেষ রোগী সোমালিয়াতে পাওয়া যায়। তবে তার পরে গবেষণাগারের দুর্ঘটনায় ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে এক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৯৭৯ সালে বিশ্বকে গুটি বসন্ত মুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
# এইচআইভি: ১৯৮১ থেকে চলমান
হিউম্যান ইমিউনোডিফিসিয়েন্সি ভাইরাস-এইচআইভি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৮০-র দশকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বর্তমানে আনুমানিক তিন কোটি ৬৯ লাখ মানুষের দেহে এই ভাইরাস রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে এইডসে প্রাণ হারিয়েছেন তিন কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ, যাতে এখনও চিকিৎসা আবিষ্কার না হওয়া এই রোগ ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্ম মহামারীর একটিতে পরিণত হয়েছে।
লাইভসায়েন্স ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ধারণা করা হয় ১৯২০ এর দশকে পশ্চিম আফ্রিকায় শিম্পাঞ্জি থেকে এইচআইভি ভাইরাস মানুষের দেহে যায়। এরপর ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উনিশ শতকের শেষ দিকে বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেয়। বর্তমানে ৩৬.৯ মিলিয়ন মানুষের দেহে এই ভাইরাস রয়েছে, তাদের প্রায় ৬৪ শতাংশই সাব-সাহারা আফ্রিকার।
চার দশকেও এই রোগের প্রতিকার আবিষ্কার হয়নি। তবে নব্বই দশকে কিছু ওষুধ বেরিয়েছে যাতে সেগুলো নিয়ে আক্রান্তরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। ২০২০ এর প্রথম দিকে দুই ব্যক্তি এইচআইভি থেকে সেরে উঠেছেন বলে জানিয়ে লাইভসায়েন্স।
সার্স
একুশ শতকে প্রথম যে সংক্রামক রোগ আতঙ্ক হয়ে এসেছিল তার নাম ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম’- সার্সও; এটিও এক ধরনের করোনাভাইরাস।
প্রথম সার্স আক্রান্ত রোগী মিলেছিল চীনেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। ফ্লু উপসর্গের এই রোগে প্রায় ২৬টি দেশে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ; মারা গিয়েছিল অন্তত আটশ জন। তবে মানব শরীরে কী করে এই জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছিল সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বায়ুবাহিত এ রোগের জীবাণু সহজেই ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম বলে জনমনে সংক্রমণের আশঙ্কাটা ছিল বেশি। এশিয়ার কিছু অংশসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় সার্স ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৩ সালে সার্সের প্রাদুর্ভাবের সময় সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
সার্সের জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, জ্বর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে শুষ্ক কাশি শুরু হয়, যা এক সময় নিউমোনিয়ায় রূপ নেয়। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সার্স নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
# ইবোলা
প্রাণঘাতী ইবোলা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ দেখা দেয় ১৯৭৬ সালে, একইসঙ্গে কঙ্গো ও দক্ষিণ সুদানের দুটি অঞ্চলে। পরে ইবোলা নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ভাইরাসটি ইবোলা নাম পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ভয়াবহ এই রোগে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশের মতো। ১৯৭৬ সালে ইবোলা প্রথম শনাক্ত হলেও এর সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে ২০১৪-২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায়।
২০১৪ সালে বিশ্বে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায় ইবোলা ভাইরাস। ভাইরাসজনিত এ রোগ পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে শুরু হয়ে লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনসহ কয়েকটি দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে সিয়েরা লিওনে ১৪ হাজার ১২৪ জন আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৯৫৬ জনের মৃত্যু হয়। ওই দুই বছরে লাইবেরিয়ায় ১০ হাজার ৬৭৫ জন এবং তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৮০৯ জনের মৃত্যু হয়। আর গিনিতে আক্রান্ত ৩ হাজার ৮১১ জনের মধ্যে ২ হাজার ৫৪৩ জনেরই মৃত্যু হয়।
এই ভাইরাসের প্রভাব পশ্চিম আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন সূত্রে ইবোলা রোগী বা সন্দেহভাজন আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দূরবর্তী ভূখণ্ডেও।
২০১৮ সালে ডিআর কঙ্গোতে এই রোগ আবার ছড়িয়ে এখনও এর প্রকোপ চলছে। সেখানে ইবোলার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই দফায় দেশটিতে ২ হাজার ৩৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এই রোগে।
# কোভিড-১৯
২০২০ সাল শুরুর আগ মুহূর্তে চীনের উহানে যে নতুন ভাইরাস বাসা বেঁধেছিল মানুষের শরীরে, সেই ভাইরাস লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল বছরজুড়ে। বছরব্যাপী দুনিয়াজুড়ে আতঙ্ক হয়ে থাকা এই ভাইরাস নাম পেয়েছে নভেল করোনাভাইরাস (সার্স সিওভি-২), আর রোগের নাম হয়েছে কোভিড-১৯।
এ যাবৎ পৃথিবীতে যত মহামারী এসেছে তার মধ্যে করোনাভাইরাসই সবচেয়ে দ্রুত এত ছড়িয়েছে। এরইমধ্যে বিশ্বে এই রোগে আট কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ১৭ লাখের বেশি মানুষের।
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়া মারাত্মক সংক্রামক এ রোগে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো বিশ্ব।
মহামারী আকারে যা চলছে এখনও। স্বস্তির খবর এই নতুন করোনাভাইরাসের টিকা এরইমধ্যে কয়েকটি দেশে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে, যা আবার বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেছেন, “স্প্যানিশ ফ্লুর যখন প্রাদুর্ভাব ঘটল তখন মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। সে কারণে রোগ ছড়াতে একটু সময় লেগেছিল। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত বলে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে দ্রুত।”
করোনাভাইরাস মহামারী বছর পার করলেও জীবাণুটি এখনও দুর্বল হয়নি জানিয়ে কেমব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই গবেষক বলেন, “ভাইরাস থেকে যেসব রোগ মহামারী আকারে ছড়ায় সেগুলো বিভিন্ন কারণে এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে করোনাভাইরাস দুর্বল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।”
Informative...content..!
You must be logged in to post a comment.